জ্বালানি তেলের দাম ৮ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম
স্টাফ রিপোর্টার: বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি সুখবর এসেছে জ¦ালানি তেলের দাম কমার মাধ্যমে। যে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য বিশ্ব অর্থনীতিক ওলোটপালট করে দিচ্ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে সেই তেলের বড় ধরনের দরপতন হয়েছে; নেমে এসেছে ৮ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম দামে।
প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৪ ডলার শূন্য সাত সেন্ট বা ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ কমে ৮৬ ডলার ৩৯ সেন্টে নেমে এসেছে। আর ডব্লিউটিআই ক্রুডের প্রতি ব্যারেলের দাম নেমে এসেছে ৭৯ ডলার ১২ সেন্টে; কমেছে ৪ ডলার ৩৭ সেন্ট বা ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। এই দর গত জানুয়ারির পর সবচেয়ে কম। গত শুক্রবার বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দর নিয়ে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশাঙ্কায় জ্বালানি তেলের বড় দরপতন হয়েছে। আমেরিকান মুদ্রা ডলার দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। ক্রমবর্ধমান সুদের হার বড় অর্থনীতিকে মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ আশঙ্কায় পড়ছে তেলের দাম। করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় বড় দেশ ঋণের সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে। ইউএস ফেডারেল রিজার্ভ বুধবারও সুদের হার ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে। অন্য বড় অর্থনীতির দেশগুলোও সেই একই পথ অনুসরণ করছে। আর এটাই বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে। এর জেরেই বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় সংকটে বিশ্ব অর্থনীতি। দিন দিন বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার একযোগে বাড়িয়েই চলেছে। এর জেরে বিশ্ব অর্থনীতি ২০২৩ সালে মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের বড় বড় শহরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে নতুন করে লকডাউন শুরু হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চাহিদা কমায় জ্বালানি তেলের দাম কমেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থাটি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূলত দুটি কারণে তেলের দাম নিম্নমুখী হয়েছে। প্রথমত, বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা মোটেও ভালো নয়। উন্নত দেশগুলোতে মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই তেলের চাহিদা কমছে। দ্বিতীয়ত, ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দর। ডলার প্রাইস ইনডেক্সের তথ্যানুসারে, চলতি বছর ডলারের দর ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডলারের দর বাড়লে আমদানি মূল্য বেড়ে যায়, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে। সে জন্য ডলারের দর বাড়লে উন্নয়নশীল দেশগুলো জ্বালানি তেল আমদানি হ্রাস করে, বাংলাদেশও যা করেছে। ডলার বাঁচাতে দেশে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম না কমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করা হবে।
বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম গড়ে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি ওঠানামা করছিল, ঠিক তখন বাংলাদেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। গত ৫ আগস্ট রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, ডিজেল ও কেরোসিনের প্রতি লিটারের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা আর অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই দিন মধ্যরাত থেকে নতুন দর কার্যকর করা হয়। এর পর থেকেই বাস, ট্রাক, অ্যাপের প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, লঞ্চ ও হিউম্যান হলারের ভাড়া বেড়ে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি ছিল, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে তা আরও একদফা বাড়ে।
সরকারের মন্ত্রীরা বলে আসছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশেও জ্বালানি তেলের দাম কমানো হবে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কাছুটা কমলে দেশের বাজারে লিটারে মাত্র পাঁচ টাকা কমানো হয়।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। করোনা মহামারির মধ্যেও টানা বেড়েছে তেলের দাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়। ২০২০ সালের করোনা মহামারির শুরুতে সারা বিশ্বে যখন লকডাউন চলছিল, তখন জ্বালানি তেলের দাম মাইনাস ৩৭ ডলারে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ এক ব্যারেল তেল কিনলে ক্রেতাকে উল্টো ৩৭ ডলার দেয়া হয়েছে। এরপর ওপেক ও রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে তেল সরবরাহ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করে। তেলের দাম খানিকটা কমে আসে। যুদ্ধের কারণে ফের তা বাড়তে থাকে। ইউক্রেনে রুশ হামলার সঙ্গে সঙ্গে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।