শুক্রবার ২৪ মার্চ ২০২৩
Online Edition

শরতের স্নিগ্ধতায় বাংলাদেশ

আবুল খায়ের বুলবুল 

সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা অনিন্দ্য সুন্দরে ভরা চির হরিৎ-এর দেশ, চির সবুজের দেশ বাংলাদেশ। যে দেশে প্রত্যহ ভোর হয় পাখির গানে, ভোরের সোনালী সূর্যের আভায় শিশিরের ফোঁটায় নানা ফুল ফোটে। এই দেশে বর্ষপরিক্রমায় ছয়টি ঋতুর আবির্ভাব ঘটে। এক একেটি ঋতুর বৈশিষ্ট্য একেক রকম। বিশেষ করে শরৎ ঋতু অনন্য সুন্দরের ডালি নিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে ঠাঁই হয়। আষাঢ় শ্রাবণ মাসের পরেই ভাদ্র আশ্বিন দুই মাস মিলে শরৎ ঋতু বাংলাদেশের প্রকৃতিতে স্থায়ী থাকে। শরতের স্নিগ্ধতা সত্যিই বড় মনোলোভা। শরৎ এর এই বিচিত্র সৌন্দর্য দেখে রবি ঠাকুর কবিতায় শরৎকে নিয়ে গেঁথেছেন কবিতার পঙক্তি -

“আজিকি তোমার মধুর মূরতি /হেরিণু শারদ প্রভাতে/

হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ/ঝলিছে অমল শোভাতে।”

সত্যিতো শরৎ প্রকৃতির রাজ্যকে জাগায় নব জাগরণে ফুলে ফলে ও ফসলে। এই সময় আমন ধান আসে। সুগন্ধি ধান পাকে। সেই ধানের পুষ্পময় রেণুর সুবাসে হৃদয়ে সান্ত¦না জোগায়। মনে হয় বৈষয়িক বৈষম্য দূর করতে সহায়তা করে এই সুবাস। শান্ত স্বচ্ছ ঋতু শরৎ ঋতু। বলতে গেলে যেমন কোন জায়গায় অনেক আর্বজনায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকে আর প্রবল বৃষ্টির ধারাপতনে ঐ সব আবর্জনা ধুয়ে মুছে যায় এবং ঐ জায়গাটিও পরিচ্ছন্ন বলে প্রতীয়মান হয়ে থাকে। ঠিক বর্ষার বৃষ্টিতে প্রকৃতি বৃক্ষে লেগে থাকা ধূলো বালি, ফুলের গায়ে লেগে থাকা ধূলো মাটিতে পুঁতে থাকা সব আবর্জনাসহ ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়, আর ঠিক তখনই চমকে চমকে ধীরু ধীরু পায়ে শরৎ রাণীর আবির্ভাব ঘটে আমাদের বাংলাদেশের প্রকৃতির জীবনে। মৃদু মৃদু ঝিরিঝিরি বাতাস বইতে থাকে এ সময়। আকাশে মেঘের তেমন কোন আনাগোনা থাকে না বললেই চলে। আকাশ যেন সম্পূর্ণ পরিপাটি থাকে। মাঝে মাঝে সাদা সাদা মেঘ বৃষ্টি হয়ে জমিন শান্ত স্নিগ্ধ করে তোলে। এ সময় বৃষ্টির ধারাপতন এতো স্থায়ী হয় না। বৃষ্টিরা চলে গেলে ঝিরিঝিরি বাতাস বইতে থাকে এ সময়। দূর দিগন্ত থেকে দিগন্তে চোখ মেললে সবই সতেজ দেখায়। মনে হয় দিগন্তে কিসের আঁকিবুকি সুন্দরের মাঝে সৌন্দর্যের ঢেউ খেলে চলে। এসময় মাঠের জলায় ছল ছল পানি থাকে। ঐ পানি যেন স্বচ্ছ পানি যে পানিতে আয়নার ন্যায় নিজের ছবি দেখা যায় আর ঐ স্বচ্ছ জলের উপর ফোটে থাকে শত সহস্র শাপলা ফুল। শাপলা ফুলের সুবাস যদিও নাইবা থাকুক না কেন কিন্তু সমগ্র জলাশয় কিম্বা পুকুর অনন্য সুন্দরেরচ্ছটায় মোহনীয় আভায় একাকার হয়ে থাকে। কেউ কেউ নৌকো করে, কেউ কেউ আবার বুকভরা জলে নেমে শাপলা তুলে নিয়ে আসে আর তা ভোগ করে নানাভাবে। শাপলা এমন এক প্রকার শাক যা  বৈজ্ঞানিকভাবেও শরীরের জন্য অনেক পুষ্টিকর। ক্যালসিয়াম থেকে প্রায়শ সব ভিটামিন রয়েছে তাতে। শরৎ এর সময় গাছে গাছে খঞ্জর পাখিদের গুনগুন গান বড় মিষ্টি মধুর লাগে। তারা গাছের এ শাখা থেকে ঐ শাখায় উড়ে বেড়ায়। দেখতে খুব চমৎকার লাগে। তাছাড়াও দোয়েল লেজ উঁচিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে ডেকে চলে যায়। নিত্য ডাকা ডাহুক ডাহুকীরা দিন কি রাত পাখা ঝাপটিয়ে ডেকে ডেকে গান গেয়ে যায়। তাদের সুরে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকার সুর পরিলক্ষিত হয়। 

শরৎকে ঋতুর রাণীও বলা হয়ে থাকে। শরতে বেলী, জুঁই, শিউলি, কদম, চালতা ফুল ফুটে থাকে। এইসব ফুলের স্নিগ্ধতায় সমগ্র প্রকৃতিতে একটা আনকোরা বৈশিষ্ট্যের রুপ ধারণ করে। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে একটা স্নেহের সুবন্ধন তৈরী করে থাকে। ঝরা ফুল কুড়িয়ে ছেলে মেয়েরা মালা গাঁথে আপন মনে এবং একে অপরের গলায় তা দিয়ে সুখানুভব করে থাকে। তারা নিজেরাও সেই ফুলের সৌরভের মতো ভাবী জীবনে নিজেদের জীবনকে মানুষের তরে বিলিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। নদীর কিনারায় ফোটে কাশফুল। বাতাসে ফুলের ডগায় দোল খেয়ে খেয়ে যেন উঠা নামা করে এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে। হৃদয়ের অলিন্দে সান্ত¦নার মুঠো মুঠো হাওয়ায় সুশান্ত করে তোলে শরীর মনের রাগিনীকে। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই যেন হারিয়ে যায় শত বেদনা বিধুর জ্বালা যন্ত্রণা। মন সুশান্ত হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ফুলের সুঘ্রাণ পেয়ে। সাদা সাদা কাশ ফুলের বৈচিত্র্য আমাদের মানবীয় মনকেও সাদা শুভ্র করে তোলার প্রয়াসী করে তোলে।

শরৎ রাতের প্রকৃতি সাবলীল থাকে। জোনাকিরা ওড়াউড়ি করে। চাঁদের আলোয় ঝিকিমিকি করে প্রকৃতির বৃক্ষরাজি, ফুল, বন বনানী সকলই। এসময় সন্ধ্যারাতে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা লুকোচুরি খেলায় মেতে ওঠে।  শরতের ভোরে+ শিশির পড়ে। শীতার্ত বাতাস বইতে থাকে। গাছের ডগার উপর কিংবা দূর্বাঘাসের উপর ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দু জমা হয়। সকালের সোনা রোদে সেই শিশির বিন্দু ধীরে ধীরে ঝরে পড়তে শুরু করে। শরতের সময় গাছে গাছে তাল পাকে। বাদুড় পাখা ঝাপটিয়ে খেয়ে থাকে কিছু আবার পাকা পাকা তাল গাছ থেকে ঝরে ঝরে মাটিতে পড়ে। সেই তালের পিঠা, তালের রস কতোইনা সুমিষ্ট - না খেলে তার স্বাদ উপলব্ধি করা খুবই কঠিন। ডেউয়া ফল শরৎ ঋতুতে পাকে। চালতা শরতে ধরে, পাকেও। ছেলে মেয়েরা এই ফলগুলো খুব খেয়ে থাকে। সাধারণত লবণ মরিচ মিশিয়ে। তাতে তারা আনন্দবোধও করে থাকে।

প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্যে ভরে তোলে শরৎ। শরৎ ঋতু সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে হৃদয়ে সান্ত¦নার সুবাতাস এনে সুখের আবহে দোলায়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ