শুক্রবার ২৪ মার্চ ২০২৩
Online Edition

৫০তম জন্মদিনে কবি সায়ীদ আবুবকরের মুখোমুখি

সায়ীদ আবুবকর বাংলাদেশের অন্যতম কবি। আধুনিককালের জনপ্রিয় কবিদের একজন। তাঁর কবিতার শক্তিমত্তার কথা ইতোমধ্যে সর্বমহলে স্বীকৃত। তিনি ‘নবিনামা’ ও ‘মুজিবনামা’ নামে দু-দুটি মহাকাব্যের রচয়িতা। তবে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ ‘প্রণয়ের প্রথম পাপ’ (১৯৯৬)।  বর্তমানে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৫। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রয়েছে তাঁর বিশেষ খ্যাতি। তাঁর  কবিতা ইংরেজি, চাইনিজ, রাশিয়ান, স্প্যানিশ, আরবি, কোরিয়ান, উড়িয়াসহ পৃথিবীর আরো কিছু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পোয়েমহান্টারের জরিপে তিনি বিশ্বের শীর্ষ ১০০ কবির অন্যতম। ২১ সেপ্টেম্বর ছিলো কবির ৫০তম জন্মদিন। কবি সায়ীদ আবুবকর ১৯৭২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কবির জন্মদিন উপলক্ষে সংগ্রামের পক্ষ থেকে কবির মুখোমুখি হন কবি ও সাংবাদিক শাহীন সৈকত। 

 

শাহীন সৈকত: আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় কবি। কেমন আছেন আপনি?

সায়ীদ আবুবকর: ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ। আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছি।

শাহীন সৈকত: ২১ সেপ্টেম্বর আপনার ৫০তম জন্মদিন। সাহিত্য সাধনার তিন দশক পার করে আজ আপনার অনুভূতি কেমন? 

সায়ীদ আবুবকর: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমার লেখার শক্তিকে গতিশীল রেখেছেন। দেখতে দেখতে  কখন তিন দশক পার হয়ে গেল, টের পেলাম না। অথচ অনেক লেখাই এখনো লিখতে বাকি। 

শাহীন সৈকত: এই তিন দশকে আপনার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী বলে আপনি মনে করেন?

সায়ীদ আবুবকর: সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো পাঠকদের ভালোবাসা। অনেকেই আমার কবিতা পছন্দ করেন, আমার কোনো কোনো কবিতা তাদেরকে ভাবায় ও আপ্লুত করে, এটা যখন জানতে পারি তখন ভালো লাগে।

শাহীন সৈকত: অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যায়, আপনি একটি নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণে সক্ষম হয়েছেন। কিভাবে সেটা সম্ভব হলো? এজন্য আলাদা কোন চেষ্টা কি আপনার ছিল অর্থাৎ এটা কি আপনি সচেতনভাবেই করেছেন?

 সায়ীদ আবুবকর: এটা আসলে প্রথমে বোঝা যায় না। আমার ‘প্রণয়ের প্রথম পাপ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকে বলেন, এ ধরনের কবিতা আমরা আগে পড়িনি। আমার যে-কোনো কবিতা পাঠ করেই বোঝা যায় এটা আমার কবিতা বলে অনেকে মন্তব্য করেন। আমার কবিতার ভাষা ও আমার উচ্চারণ অন্যদের থেকে আলাদা বলে অনেকেই এখন বলছেন। আসলে, আমি কখনো অন্য কারো মতো কবিতা লিখতে চাইনি। কবিতা আমি খুব সচেতনভাবেই লিখি। বিশেষ করে, কবিতার স্ট্রাকচার, ছন্দ, অলঙ্কার, অন্ত্যমিল, শব্দপ্রয়োগ প্রভৃতি ব্যাপারে আমি সবসময় চোখকান খোলা রাখি। আমার কান যতক্ষণ না বলছে, এটি আমার কবিতা ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এটাকে প্রকাশিত হতে দি না।

শাহীন সৈকত: সাহিত্যের শত্রু মিত্র বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন? 

সায়ীদ আবুবকর: বিষয়টাকে আমি খুব পজিটিভলি দেখি। যে-কবির শত্রু বেশি, বুঝতে হবে তার কবিতা আসলে কবিতা হচ্ছে। ভালো কবিতা লেখার কারণে তার সমসাময়িক কবিরা ঈর্ষান্তিত হয়ে উঠতে পারেন। এটা খারাপ কিছু না। তবে কবিতার পাঠক কখনো কবির শত্রু হয় না। ব্যর্থ কবিরাই কেবল একজন শক্তিশালী কবির বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগে যায়, এটা সবসময় দেখা যায়। আগের কবিদের ক্ষেত্রেও এসব হয়েছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। 

শাহীন সৈকত: দুঃখশিল্প এবং বেহুলা বধু র মতো কবিতা যেমন আপনি লিখেছেন তেমনি ‘সকল প্রশংসা তার’ কবিতাও আপনার লেখা। বিষয়টাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

সায়ীদ আবুবকর: তিনটি কবিতা আমার তিনটি কাব্যগ্রন্থের। ‘মেসোপটেমিয়ার মেম’ কাব্যগন্থের কবিতা ‘দুঃখশিল্প’, ‘বেহুলাবধু’ ”তুমি বলো তুমি বৃষ্টি ভালবাসো” কাব্যগ্রন্থের এবং ‘সাদা অন্ধকারে, কালো জ্যোৎস্নায়’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘সকল প্রশংসা তাঁর’। তিনটিই নিরেট প্রেমের কবিতা, সেনচুয়াল ইমেজারিতে ভরা। কবিতা তিনটাই অনেকের কাছে প্রিয় বলে শুনতে পাই। তবে এসব কবিতার কারণে আমি ব্যাপক সমালোচিতও বটে। একটি সাহিত্যপত্রিকায় এক অখ্যাত লেখক আমার বিরুদ্ধে তার বিদ্বেষ উগরে দিতে গিয়ে ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ কবিতাটিকে অশ্লীল কবিতা বলে অভিহিত করেন। অথচ এটি নিরেট একটি আধ্যাত্মিক কবিতা যেখানে আল্লাহর জয়গান করা হয়েছে। আমি মানবিক প্রেমের কবিতাও লিখি, আধ্যাত্মিক কাবিতাও লিখি; এটাই আমার সহজাত প্রবণতা।

 শাহীন সৈকত:  আপনি নবিনামা ‘র মতো এত বিশাল কর্মযজ্ঞে উৎসাহী হলেন কিভাবে? 

সায়ীদ আবুবকর: আমি তো সারা জীবন প্রিয় রসুলের (স) আশেক। আমার ‘প্রণয়ের প্রথম পাপ’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা রসুলকে (স) নিয়ে রচিত। রসুলকে (স) নিয়ে হোমারের ইলিয়াডের আদলে একটা মহাকাব্য লেখার স্বপ্ন ছিলো আমার দীর্ঘদিনের। কিন্তু এত বড় কাজের জন্য যে-অবকাশ প্রয়োজন তা আমার ছিলো না। ২০২০-এর করোনাকালীন লকডাউন আমাকে সুযোগ করে দেয় কাজটি শেষ করার। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় পাঁচ মাস একটানা পরিশ্রম করে এটা লিখে শেষ করি আমি। এরপর এক মাস ফেলে রাখি। একমাস পর দুই মাস ধরে এটি এডিট করি। এরপর আরো এক মাস ফেলে রাখি। পরের মাসে এটি আবারো এডিট করে আমি সরলরেখাকে দিয়ে দেই প্রকাশ করার জন্য। 

শাহীন সৈকত:  নবিনামা ‘র ব্যাপারে পাঠকের প্রতিক্রিয়া কেমন? 

সায়ীদ আবুবকর: আপনি জানেন আমি নিরবে নিভৃতে কাজ করা মানুষ। পাঠকদের থেকে আমি খুব দূরে থাকি। কোনো আড্ডা কিংবা সমাবেশে আামাকে সচরাচর পাবেন না। সুতরাং নবিনামা নিয়ে কোথায় কে কী বলছে, তা আমার জানার সুযোগ হয়ে ওঠে না। তবে ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে ফোনে যা জানতে পারি, তাতে বুঝতে পারি, আমার এত বড় কাজ নিয়ে কেউ কেউ প্রচ-ভাবে ঈর্ষান্বিত। এনারা বলে বেড়াচ্ছেন, এটা কিছুই হয়নি। যারা কখনো মহাকাব্যই পড়েনি, তারাও মন্তব্য করছেন। আবার অনেকে এটা পড়ে অভিভূত হয়েছেন বলেও শুনতে পাই। আশির দশকের অন্যতম প্রধান কবি সোলায়মান আহসান ভাই এর উপর একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন, দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন উপমা-সম্পাদক মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন ভাই। মহাকাব্য পড়তে গেলে মেধা লাগে। দ্বিতীয়ত লাগে ধৈর্য। ৫৭৫ পৃষ্ঠার একটা বই দশ মিনিটে পড়ে শেষ করে মন্তব্য করা যায় না। এর ছন্দ রপ্ত করে এটা পাঠ করতে না পারলে এর আসল মজা কখনোই পাওয়া যাবে না। দন্তহীনদের জন্য তরল খাবার, সুস্বাদু শক্ত খাবার উপভোগ করার প্রথম শর্তই হলো দাঁত। 

শাহীন সৈকত: আপনার লেখালেখি এখনও চলমান। সামনে আরও অনেক লেখা আপনার কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশা করি। এই সময়ে শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন করার চিন্তা কিভাবে এলো?  

সায়ীদ আবুবকর: এ ধরনের সংকলনের একটা গুরুত্ব আছে। পাঠকদের পক্ষে সহজ হয় এক জায়গাতে ভালো কবিতাগুলো পেয়ে যাওয়ার। তাছাড়া আর কোনো কারণ নেই। 

শাহীন সৈকত: সমাজ পরিবর্তনে ও সমাজ বিপ্লবে কখনো কখনো কবিদের ভূমিকা থাকে। কবিতা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। এ ব্যাপারে আপনি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছেন বলে মনে করেন? 

সায়ীদ আবুবকর: আমাকে তো কেউ কেউ বলছে প্রেম ও দ্রোহের কবি। বলা যায় আমার কবিতার অর্ধেকই প্রেমের কবিতা, বাকি অর্ধেক দ্রোহের কবিতা। পচা, রুগ্ন এ সমাজ ও নিষ্প্রাণ নিশ্চক্ষু এ সভ্যতার বিরুদ্ধে আমার কলম সবসময় শান দেয়া তরবারির মতো, কাটছে তো কাটছেই। কিন্তু কেবল কবিতা দিয়ে কি সমাজের পরিবর্তন হয়েছে কোথাও? ইতিহাসে এমন নজির কি কোথাও আছে? 

শাহীন সৈকত:  আলোর গীটার এর মতো কবিতা অথবা আকাক্সক্ষা র মতো ছড়া আমরা আর পাইনা কেন? 

সায়ীদ আবুবকর: পাচ্ছেন না কারণ কোনো কবি এক কবিতা দুই বার লেখেন না। এদের চেয়েও তীক্ষè কবিতা আমার আছে, সেগুলো হয়তো আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে। 

শাহীন সৈকত:  আপনার আজব শহরে” আর ইবনে বতুতার দেশ দর্শন” এই দুটি কবিতার সৃষ্টিকালীন ঘটনা কি আমাদের বলবেন? বিষয়টাকে আমার কাছে ইলহাম মনে হয়, আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? 

সায়ীদ আবুবকর: এস টি কোলরিজ তাঁর ‘কুবলাই খান’ কবিতাটি নাকি লিখেছিলেন ঘুমের মধ্যে। এই কবিতার শেষের অংশে কবি বলছেন, তিনি একবার মাউন্ট এবোরার পাদদেশে এক পাহাড়ি বালিকার গান শুনেছিলেন, যা ছিলো স্বর্গীয় সুধায় ভরা; তিনি তার সুর যদি সম্পূর্ণ আত্মস্থ করতে পারতেন তাহলে তিনি পরিপূর্ণ কবি হতে পারতেন এবং তার পক্ষে তখন কুবলাই খানের আনন্দ প্রাসাদের বর্ণনা করা সহজতর হতো, যা শুনে লোকেরা তাঁকে ঘিরে নৃত্য করতো আর বিস্ময় প্রকাশ করতো। পি বি শেলি ‘ওড টু স্কাইলার্ক’ কবিতায় স্কাইলার্ককে সম্বোধন করে বলছেন, সে যদি তার সঙ্গীতের অর্ধেক সুধা কবিকে দান করতো তাহলে সে এমন কবিতা রচনা করতে সক্ষম হতো, যা পৃথিবীর লোকেরা কান পেতে শুনতে থাকতো যেভাবে তারা স্কাইলাকের গান শোনে। অর্থাৎ সবসময়ই মনে করা হয়, কবিতায় স্বর্গীয় একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। আমি অবশ্য এসবে তেমন বিশ্বাস রাখি না। তবুও একথা অস্বীকারে কোনো অবকাশ নেই যে, কাব্যঘোর বলে একটা কথা আছে, এটা আমি নিজেও অনুভব করেছি। আমার ‘প্রণয়ের প্রথম পাপ’ একটা কাব্যঘোরের মধ্যে লেখা, এবং আমার ‘নবিনামা’ও। এরকম কাব্যঘোর কোনো কোনো কবিতার ক্ষেত্রেও আসে। 

গ্রিক ভাষায় পোয়েট বলতে তাদেরকে বুঝানো হতো যাদের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা আছে। নজরুল ১৯২২ সালের দিকে লিখলেন “ শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন্ মঙ্গল হতে আসছে উড়ে।” অথচ মানুষ চাঁদে গেল ১৯৬৯ সালে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি প্লেন আবিষ্কার করার চারশ বছর পূর্বে প্লেনের ছবি এঁকেছিলেন। এ ধরনের ঘটনা অনেক সময় ঘটে। আমার ‘ইবনে বতুতার দেশদর্শন’ কবিতা নিয়ে কবি আহমদ বাসিরসহ অনেকেই এরকম মন্তব্য করেছেন যে, বাংলাদেশের লোমহর্ষক সব রাজনৈতিক ঘটনা ঘটার পূর্বেই আমার এ কবিতাটি লেখা। দেশকে নিয়ে আমার অতিমাত্রায় নিমগ্নতার কারণে এবং আশংকার কারণে এ ধরনের কবিতা রচিত হয়ে থাকতে পারে। এসব কথা এখন আর আমার তেমন মনে নেই।

শাহীন সৈকত:  আপনার কবিতায় বাঁক বদল খুব স্পষ্ট। বঙ্গেতে বসতি, কপোতাক্ষ পাড়ের রোদ্দুর” কাব্যগ্রন্থের মতো সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ কাব্যগ্রন্থ দেশপ্রেমের কবিতায় ভরপুর। তারপরও এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো ভিন্ন মাত্রার, ভিন্ন আঙ্গিকের। আপনি কি সচেতনভাবেই এগুলো করেন? 

সায়ীদ আবুবকর: বঙ্গেতে বসতি (২০০৮)”, কপোতাক্ষ পাড়ের রোদ্দুর” (২০১২) ও বাংলাদেশ”(২০২২) তিনটি কাব্যগ্রন্থই দেশপ্রেমের কবিতায় ঠাসা। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। “বাংলাদেশ” কাব্যগ্রন্থটি আমার হৃদয়ে জাত বাংলাদেশের খাঁটি ছবি আঁকার ব্রত নিয়ে রচিত। দেশকে এতকাল মাতা বলে সম্বোধন করে আসা হয়েছে। আমার বাংলাদেশ এখানে অংকিত হয়েছে শুভ্র সুন্দর পবিত্র প্রিয়তমার রূপে, যার সৌন্দর্যের কোনো শেষ নেই। 

শাহীন সৈকত:  আপনার কাব্যে প্রচন্ডভাবে দেশপ্রেম আছে, আছে নিজের গ্রামের কথা। হৃদয়ে না থাকলে তো এমন করে ভাবা সম্ভব নয়। আপনি শহুরে নাগরিক, শহরে বাস করে কিভাবে নিজের মধ্যে গ্রামকে লালন করে করেন?

 সায়ীদ আবুবকর: আমি হলাম সেই নৌকার মতো, যা পানির উপর দিয়ে চলে কিন্তু তার ভেতরে কোনো পানি ঢোকে না। নগরে আমার বসবাস বটে কিন্তু নগরজীবন আমাকে কখনো নিমজ্জিত করতে পারেনি। বাংলাদেশ আমার শরীরে ও মনে আলো-বাতাসের মতো সর্বক্ষণ বিরাজমান।

শাহীন সৈকত: ধর্মের সাথে কাব্যের মিল বা অমিল কতটা? আপনার কবিতায় নারী-পুরুষের প্রেম বিরহ যেমন এসেছে, দেশপ্রেম এসেছে সমান তালে, আবার ইসলামকেও আপনি ধারণ করেছেন আপনার কবিতায়। এসবকে কখনো সাংঘর্ষিক মনে হয়নি আপনার কাছে?

সায়ীদ আবুবকর: ধর্মের সাথে কাব্যের অমিল বা বিরোধ থাকবে কেন? কাব্য তো জীবনকে নিয়ে, আর ধর্ম তো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা এতে বিশ্বাস করেন না, তাদের কথা আলাদা। তাদের সংখ্যাটা অবশ্য খুবই অল্প। ইসলামে তো নারী-পুরুষের প্রেম, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম এগুলো নিষিদ্ধ নয়। সুতবাং এসবকে আমার কাছে কখনো সাংঘর্ষিক মনে হয়নি। আমি নিজেকে সময়ের সবচেয়ে আধুনিক মানুষ বলে মনে করি, তবে এ আধুনিকতা ধর্মকে বর্জন করে নয়, আত্মস্থ করেই। 

শাহীন সৈকত: তাহলে মূল কথা হচ্ছে ইসলামের সাথে কাব্যচর্চার কোন বিরোধ নেই। একথাই কি আপনি বলতে চাচ্ছেন? 

সায়ীদ আবুবকর: হ্যাঁ, আমি তা-ই বলতে চাই। কাব্য তো মিথ্যে কথা দিয়ে হয় না। হৃদয়ে জাত সত্যই কবিতায় প্রকাশ পায়। রুমী, ফরিদউদ্দীন আত্তার, শেখ সাদী, ইকবাল এঁরা তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে। আধুনিক কবিতার পুরোধা যে টি এস এলিয়টকে মনে করা হয়, তিনিও তো নিবেদিতপ্রাণ খ্রিস্টান ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তো সারাজীবন থেকেছেন উপনিষদের ঘোরে। আমার বিশ্বাস আমার কবিতায় ফুটিয়ে তুললে তাহলে অসুবিধা কোথায়? তবে একটা কথা আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, ‘নবিনামা’ বলেন, ‘প্রণয়ের প্রথম পাপ’ বলেন আর ‘বাংলাদেশ’ বলেন, আমি সবসময় কেবল কবিতাই রচনা করেছি, ইসলামী কবিতা এ ধরনের শব্দপ্রয়োগে আমি বিশ্বাসী নই। তা যদি হয়, তাহলে এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ একটি খ্রিস্টান কবিতা। 

শাহীন সৈকত: বাউল দর্শনের সাথে ইসলামী দর্শনের সম্পর্ক বা বৈপরীত্য কতটা বলে আপনি মনে করেন? এই দুয়ের সমন্বয়ের চেষ্টা আপনার কবিতায় আছে, এই সমন্বয় কেন? 

সায়ীদ আবুবকর: বাউল জীবন বা বৈরাগ্য জীবনের সাথে ইসলামের কোনো মিল নেই। তবু আবু দারদা, আবু জার গিফারী প্রমুখ সাহাবীদের মধ্যে আমরা দেখতে পাই দরবেশি জীবন। পরবর্তীকালের বহু অলি-আউলিয়া আমরা দেখতে পাই, যাঁরা আল্লাহর প্রেমে বিভোর হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রেমের স্বাভাবিক ধর্ম হলো দিওয়ানা করে তোলা। এই দিওয়ানা ভাব আমার কবিতার মধ্যে আছে এটা আমি স্বীকার করি, বাংলায় যাকে বাউলজীবন বলা হয়। আমার মধ্যে বাউল এসেছে সুফীদরবেশের রূপ ধরে। বাংলায় এই ঐতিহ্য চলে আসছে প্রাচীন কাল থেকেই। 

শাহীন সৈকত: মৃত্যু নিয়ে আপনার চিন্তা কি? এ নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা আপনার মধ্যে কাজ করে কি? এরকম কোনো কবিতা শোনাবেন কি?

সায়ীদ আবুবকর: মৃত্যু তো জীবনের অনিবার্য সত্য, একে রোধ করার সাধ্য কারো নেই। মৃত্যু আমাকেও খুবই ভাবায়। ভাবাতো না, যদি আমার তেমন কোনো ঈমান আমল থাকতো। অনন্ত জীবন যে শুরু হয়ে যাবে, যার কোনো শেষ নেই, লম্বা সেই জিন্দেগির জন্যে তো আমার কোনো প্রস্তুতি নেই; এসব যখন ভাবি তখন খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি। ‘মার কবরে সন্ধ্যা’, গোরের গান’ প্রভৃতি কবিতায় আমার মৃত্যুচিন্তা প্রকট হয়ে উঠেছে। ‘গোরের গান’ আমার সর্বশেষ মৃত্যু বিষয়ক কবিতা:  

 

মাটির লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে আছি মাটির ‘পর

মাটির বেড়া, মাটির চৌকি, এই যে আমার মাটির ঘর।

 

ঠান্ডাতে যায় জমে শরীর, কোনখানে পাই একটু রোদ,

পুব দিগন্তে তাকিয়ে আছি, সূর্য ওঠার সয় না তর।

 

অন্ধকারে পড়ে আছি, অমাবশ্যা রাত কি আজ?

পাইনে খুঁজে হাত, পা ও চোখ, পাইনে খুঁজে যে অন্তর।

 

হারিয়ে গেছে কানও বুঝি, হায় রে আমার শখের কান!

এত চিল্লাই, শুনতে তবু পাইনে নিজের কণ্ঠস্বর।

 

আমার বাড়ির আঙিনাতে ফুটেছে কি গন্ধরাজ?

নাকই কোথাও পাইনে খুঁজে, এ-কি দশা ভয়ংকর!

 

মাটির ঘরে শুয়ে আছি, সঙ্গী কেবল নিঝুম রাত

কে জানে ভোর কবে হবে কত হাজার বছর পর!

 

কোথায় আমার শিশ মুহম্মদ, কোথায় হুমু, নুসায়বা?

আস্তে করে কাছে এসো, মনে যেন রয় না ডর।

 

নবির উপর দরূদ পড়ো, মুখে নিও আল্লাহ নাম

আমার কবর ভিজিয়ে দিও অঝোর দোয়ায় নিরন্তর।

শাহীন সৈকত: ৫০ তম জন্মদিনে আপনার জন্যে শুভকামনা ও দোয়া। আরও সুন্দর কবিতার প্রত্যাশায় আজ বিদায় নিচ্ছি। ভালো থাকবেন প্রিয় কবি, ফি-আমানিল্লাহ।

সায়ীদ আবুবকর: আপনিও ভালো থাকবেন, এই দোয়া করি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ