সাহিত্যে নৈতিকতা

আহমদ মনসুর
‘There is nothing as a moral or immoral book. Books are well- written or badly written .’ কথাটি বলেছেন Oscar wilde. কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ‘কলা-কৈবল্যবাদ ’এ বা অৎঃং Arts for Art’s sake -এর প্রভাবে ভাঁটা এসেছে। কারণ শিল্পীকে এখন আর শুধুমাত্র আনন্দ বা সৌন্দর্যের রূপকার হিসেবে দেখা হয় না। এখন শিল্পীকে দেখা হয় সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামী কর্মী হিসেবে। তাই শিল্পের নামে অশ্লীলতা অনৈতিকতাকে গ্রাস করার ওয়াসকার ওয়াইল্ড-এর উপদেশে কেউ আজ আর কান দিচ্ছে না।
কালের দূরত্বে, সমাজ সভ্যতার পার্থক্যে জীবনের উদ্দেশ্য ও মূল্যবোধে দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য ঘটে। ফলে রূপান্তরিত চেতনার পটভূমিতে পরিবর্তনের সাথে হৃদয়ের ও অনুভূতির রূপও পাল্টে যায়। যে কারণে বিশ্বের শিল্প সাহিত্যে এত ব্যাপকতা ও বিচিত্রতা ।
“ শিল্প কখনো শূন্যতাকে অবলম্বন করে টিকে থাকতে পারে না-সমাজ, পরিবেশ, জীবন ইত্যাদির সাথে এর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তাই এই জীবনকে রূপ দেয়ার যে তাগিদ শিল্পী অনুভব করেন, তাকে এক ধরনের প্রয়োজন বলে ধরা যায়। আমরা দেখি আধুনিক শিল্পকর্মের একটি বড় অংশ ধর্মনিরপেক্ষ, কোনো কোনো স্থানে তাদের বিরোধও বটে। কিন্তু মধ্যযুগের অনেক শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মের পেছনে প্রেরণা যুগিয়েছে ধর্ম। এখানে ধর্মীয় অবেগ অনুভূতি বা নীতি বা শাস্ত্রচিন্তা catalyst হিসেবে কাজ করে মাত্র। শুদ্ধ শিল্প প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যায় তাকে কিছুতেই পরাভূত করতে পারে না।” (১)
বাহ্য পৃথিবীকে চিত্তের পুলক ও কল্পনার মধ্য দিয়ে অনুভব করে শিল্পবস্তুতে রূপ দান করাই শিল্পীর প্রাথমিক কাজ। তবে শিল্পী যেমন কল্পনার অনুভব দিয়ে তার শিল্পযাত্রা শুরু করতে পারেন তদ্রুপ ভাবের তরঙ্গে দোল খেতে খেতেও তার যাত্রা শুরু হতে পারে। যখনই কল্পনার সাথে আধ্যাত্মিক চিন্তা সাধনা শিল্পীর মনে প্রেরণা যোগায় তখন শিল্প হয়ে ওঠে অধিক সৌন্দর্যময়, অধিক কল্যাণময়। এলিয়ট বিশ্বাস করতেন শিল্পের প্রকাশে রূপ ও নক্সার Dynamism যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন এর সত্যান্বেষণের আগ্রহ। অধ্যাত্মচিন্তা সর্বত্রই কল্যাণকর।
শিল্পের জন্য অধ্যাত্মচিন্তা মোটেই অতিরিক্ত কিছু নয়। হেগেল, ক্রোচে ও জেন্তিলের মতে কল্পনার সহায়তা ছাড়া নির্মাণের কোনো অংশই সুন্দর হয়ে ওঠে না। শিল্পকর্ম নিসর্গ সুন্দর হয় শিল্পীর চিত্তের বিশোধন প্রক্রিয়া মাধ্যমেই। প্রকৃতির নিজস্ব যে সৌন্দর্য আছে, মন কল্পনার সাহায্যে তাতে সৌন্দর্যের মাত্রা আরও বাড়ায়। এ ভাবে উপলব্ধির বিশুদ্ধ গুণে আধ্যাত্মিক চিন্তাও শিল্পের জন্য সুন্দর ও কল্যাণময় হয়ে ওঠে। যে শিল্পীর এ গুণ আছে তার সৃষ্টি এবং আধ্যাত্মিক কর্মও পুলকের দ্বারা আমাদের মগ্ন চৈতন্যে আঘাত করে। ফলে আমাদের মাঝে আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য ও নৈতিকতার পরিচ্ছন্ন ভাব জেগে ওঠে।
সাহিত্য সৃষ্টিকে শুধু চিত্ত বিলাসের বস্তু হিসেবে ধরে নিলে ভুল হবে। আধুনিক সভ্যতার গুরু এরিস্টটল, প্লাটো আর্টকে নীতি শিক্ষামূলক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। প্লেটো এ কথাও বলেছেন যে, আধ্যাত্মিক সমুন্নতি শিল্পের অন্যতম আদর্শ হওয়া উচিত। প্লেটোর এই নৈতিকতার একটি বিশেষ প্রকাশ, যার সাথে রয়েছে সৌন্দর্য ও মানবিক কল্যাণের এক ঘনিষ্ঠ অন্বয়। তাই সাহিত্যে শিল্পে নৈতিকতার প্রকাশ থাকা প্রয়োজন।
নৈতিকতার সাথে শিল্পের সৌন্দর্যকে প্লেটো যে ভাবে সমন্বিত করে প্রকাশ করেছেন তাঁর শিষ্য এরিস্টটল প্রাথমিকভাবে ঐ একই ভাব গ্রহণ করলেও তাঁর বিশ্লেষণ ছিল অতি বেশি প্রাঞ্জল। শুধুমাত্র নান্দনিক দিকই শিল্প-সাহিত্যের জন্য যথেষ্ট নয় বলে তিনি মনে করতেন। বার্ণাড বোসাঙ্কের মতে শিল্প সৃষ্টিতে যে দু’টি জিনিস কাজ করে তার একটি হলো নান্দনিক এবং অন্যটি নৈতিক। এ দু’টি পরস্পর বিরোধী নয় আবার সমার্থকও নয়। এ দু’টি যেন রেলের পাটির মতো সমান্তরালভাবে চলতে থাকে যেন সাহিত্য শিল্পের চাকা ধ্বংসের গর্তে না পড়ে।
ইউরোপে একদল শিল্পী আর্টকে মনে করেন জীবন্ত ধর্মের প্রতীক। তাই তারা আর্টে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে ধর্মকে Dogma অর্থাৎ মতবাদ মাত্র মনে করে সাহিত্যে এর প্রবেশাধিকারকে সাহিত্য শিল্পের সৌন্দর্য ও রসের অন্তরায় মনে করেন। এ ভাবনা এককালে প্রাচীন ভারতের সাহিত্য অঙ্গনেও ছড়িয়ে ছিল। তারা কাব্যতত্ত্বের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে এবং স্বরূপ নির্ধারণে কোথাও নৈতিকতার উপকরণকে প্রয়োজনীয় মনে করেননি। সাহিত্যের স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে আচার্য কুন্তক লিখেছেন, “- কবি - কর্মকৌশলের পরাকাষ্ঠা প্রাপ্তি-হেতু রমণীয় এই যে সাহিত্য তার আসল অর্থ কি, তা আজ পর্যন্ত কোনো সুধী সামান্য মাত্রও বিচার করে দেখাননি। সরস্বতীর হৃদয়-পদ্মের মকর বিন্দুসমূহের সৌন্দর্য নিয়ে প্রকাশিত হয় সৎ কবিদের বাক্যমালা। তাঁদের সত্তার পরিমলের মনোহারিত্বে প্রস্ফুটিত হয় সাহিত্য। আজ তা সহৃদয় ভ্রমরগণের গোচরীভূত করা হচ্ছে।”(২)
ভারতীয় পণ্ডিতেরা কাব্যের কাব্যত্ব ও সৌন্দর্যের রহস্য খুঁজতে গিয়ে শব্দ- অলঙ্কার-রসের বেশ গুণ গেয়েছেন, কিন্তু নৈতিকতা যা সব সৌন্দর্যের মূলাধার তার কথা মোটেই আলোচনায় আনেননি। যেমন সপ্তম শতাব্দির খ্যাতিমান কাব্যতাত্ত্বিক ভামহ মনে করতেন, অলঙ্কারের সার্থক-সুন্দর প্রয়োগেই কাব্যের কাব্যত্ব নির্ভরশীল। আচার্য বামনের মতে, “সৌন্দর্যই অলঙ্কার এবং এ সৌন্দর্য সৃষ্টি করার জন্যে সার্থক কবিকে কাব্যনির্মাণ লগ্নে চলতে হয়, দোষ পরিহার, গুণ- গ্রহণু এবং অলঙ্কার (অনুপ্রাস- উপামাদি) গ্রহণ এ ত্রয়ীর পথ ধরে।” (৩)
কবিরাজ রাজশেখরের কল্পিত বর্ণনায়, -“কাব্যপুরুষ’ সরস্বতী পুত্র এবং ‘সাহিত্যবিদ্যা’ সে কাব্য-পুরুষের দয়িতা। শব্দার্থ তার (কাব্যপুরুষের) শরীর, সমতা প্রসাদাদি- গুণ, সংস্কৃত-মুখ, প্রাকৃত- বাহু, অনুপ্রাস- উপমাদি-অলঙ্কার এবং রস হচ্ছে তার আত্মা।”(৪)
সাহিত্যের আত্মার অুসন্ধানে ধ্বনিবাদিরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, কাব্যের আত্মা শব্দ, অর্থ, অলঙ্কার বা রীতি নয় বরং এর অতিরিক্ত অন্য কিছু যা তাদের পরিভাষায় ‘ধ্বনি’ হিসেবে আখ্যায়িত। অবশ্য ধ্বনিবাদিরা অন্তিমে স্বীকার করেছেন কাব্যের আত্মা হচ্ছে ‘রস’ তবে তাদের বিবেচনায় ধ্বনিই রস, রসেই ধ্বনির সিদ্ধি, রসেই ধ্বনির পরম বিশ্রাম।
আবার কেউ কেউ কাব্যের অস্তিত্বে শব্দকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে বললেন ‘শব্দ নামক জ্যোতি সকল সংসার আলোকিত না করলে ত্রিভূবন অন্ধকারে ডুবে যেত। “কাব্যের অস্তিত্বের মূল সূত্র হিসেবে তারা মত প্রকাশ করেন যে, “কাব্যের আত্মা অনুসন্ধানে যতোটা সময় শ্রম ও মেধা ব্যয় করেছেন, কাব্যশরীর ততোটা যত্ন উৎসাহ দেখাননি অনেকেই। কিন্তু এ কথা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য যে, রস বা আত্মা সেতো কাব্যদেহ নিরপেক্ষ কোনো বিষয় নয়, শব্দ বাক্যকে আশ্রয় বা অবলম্বন করেই তাকে বিকশিত হতে হয়। ফলে শব্দার্থময় পদ কিংবা বাক্যাবলিকে নির্বাসিত করলে তো কাব্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে।”
তথ্য সূত্রঃ
১ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম- নন্দনতত্ত্ব
২) নরেন বিশ্বাস -ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব
৩) ঐ
৪) ঐ
(চলবে)