সায়ীদ আবুবকর একজন স্বতঃস্ফূর্ত কবি

ড. সদরুদ্দিন আহমেদ
কবি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। কবিদের প্রকাশভঙ্গি, উচ্চারণ ও তাদের দেখার কৌশল সম্পূর্ণ আলাদা। এই ধারা তাদের মৃত্যু পর্যন্ত বহাল থাকে বলে ধরে নেওয়া যায়। গ্রিক ভাষার প্রসিদ্ধ কবি সফোক্লিস। ইডিপাস রেক্স, ইডিপাস এ্যাট কলোনাস, এন্টিগনি প্রভৃতি তার বিখ্যাত কাব্যনাটক। সফোক্লিসের বয়স তখন নব্বই বছর। তার বিরুদ্ধে তার পুত্র আদালতে কেস করে বসে। তার অভিযোগ হলো, তার পিতা বৃদ্ধ; -অচল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাকে জায়গাজমি বুঝে দিচ্ছেন না, যেটা পুত্র হিসেবে এখন তারই দেখভাল করার কথা। কারণ ইতোমধ্যে তারও চুল পাকতে শুরু করেছে। ফলে আদালত সফোক্লিসের নামে এক ফরমান জারি করে। বৃদ্ধ সফোক্লিস আদালতে এসে বিচারকের সামনে দণ্ডায়মান হন। বিচারক যখন তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কেন অচল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার সম্পত্তি তার পুত্রকে বুঝে দিচ্ছেন না। তার প্রশ্ন শুনে সফোক্লিস দীপ্ত কণ্ঠে তার নাটক থেকে কয়েক পঙক্তি পাঠ করে শোনান। তার উচ্চকণ্ঠের কাব্যপাঠ শুনে বিচারক বলে ওঠেন, ‘যে-ব্যক্তি এমন বলিষ্ঠ কণ্ঠে এখনও কবিতা পাঠ করতে পারেন তিনি যে অচল হয়ে গেছেন এটা আমি বিশ্বাস করি না। এটা নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে এক ধরনের ষড়যন্ত্র।’ এই বলে তিনি সফোক্লিসকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্ত করে দিলেন এবং তার পুত্রকে পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে দিলেন এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
কবিরা এমনই যৌবনদীপ্ত হয়ে থাকেন।
কবি সায়ীদ আবুবকরের কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ পাঠ করে তার কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে আমার মধ্যে উচ্চতর ধারণা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে তার ‘বঙ্গেতে বসতি’ (২০০৮) কাব্যগ্রন্থটি আদ্যেপান্ত পাঠ করে আমার মনে হয়েছে তিনি একজন খাঁটি কবি। সায়ীদ আবুবকর অবশ্য আমার সরাসরি ছাত্র। অনার্স-মাস্টার্স করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে। এমনিতেই জানতাম, তিনি কবিতা লেখেন। কিন্তু এত বড় কবি, তা জানতাম না। বঙ্গেতে বসতি পাঠ করে তার সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে গেল। কেন, সেকথা একটু দৃষ্টান্ত দিয়ে বলি।
আগেই বলেছি, কবিদের চিন্তাভাবনা ও প্রকাশভঙ্গি অন্যদের থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। তারা যেভাবে চিন্তা করেন, আমরা সেভাবে চিন্তা করি না, কল্পনাও করি না তাদের মতো করে। বঙ্গেতে বসতির একটি চমৎকার কবিতা ‘শয়তানের মুখ’। কবি বলছেন, এক অন্ধকার রাতে শয়তানের সাথে তার দেখা হয়েছিল। সে নিজের চেহারা আড়াল করে তার সাথে কথা বলেছিল। কবি শয়তানকে তার মুখ দেখানোর জন্য অনুরোধ করলে শয়তান জানালো যে, সে কাউকে তার চেহারা প্রদর্শন করে না। কবির ভাষায় তাদের কথোপকথনটা আমরা শুনি না কেন?
পিচঢালা অন্ধকারের ভেতর এক রাতে
শয়তানের সাথে
হয়েছিল কথোপকথন।
সে মহান বিজ্ঞের মতন
শুনিয়ে যাচ্ছিল তার
জ্ঞানগরিমার
কথা।
কিভাবে কূটকৌশলে তার, পৃথিবীর হাজার সভ্যতা
ঘূণে খাওয়া বাঁশের খুঁটির মতো পড়েছিল হুমড়ি খেয়ে কলের গহ্বরেÑ
দর্পভরে
দিয়ে যাচ্ছিল সে তার বিবরণ।
শুনে শিউরে শিউরে উঠছিল দেহান্তকরণ।
হঠাৎ কী ভেবে বললাম তাকে,
“আমি কি একটিবার স্বচক্ষে দেখতে পারি আপনাকে?”
স্মিত হেসে সে বললো ধীরে ধীরে,
“আমি তো কাউকে দি না দেখা, সশরীরে।”
আমি বললাম, “হায়,
আপনাকে দেখার তাহলে নেই বুঝি কোনোই উপায়?”
আমার আক্ষেপ শুনে বললো সে, “হে বৎস,
অজ¯্র আমার রূপ, কখনো হৃদয়গ্রাহী, কখনো বীভৎস;
মানুষের মধ্যে আমি ওৎপেতে থাকি মানুষের বেশে
দেশে দেশে।”
ফিসফিস করে, অতঃপর, বললো সে কানে কানে,
যার মানে:
যখন দেখতে তাকে আমি এতই উৎসুক,
টিভির পর্দায় তবে দেখে যেন নেই জারজ বুশের মুখ।
[শয়তানের মুখ, বঙ্গেতে বসতি]
সায়ীদ আবুবকের প্রকাশভঙ্গি কী অদ্ভুত, পাঠক আশা করি তা বুঝতে পেরেছেন। এমন কল্পনাশক্তি যে কবির মধ্যে থাকে, তাকে বড় কবি না বলে পারা যায় না।
এই কাব্যগ্রন্থের আরেকটি চমকপ্রদ কবিতা ‘এলিজি রিটেন অন দ্য ডেথ অব এ মাদার’। এখানে কবি তার মাতৃবিয়োগের ব্যথা প্রকাশ করেছেন তার নিজস্ব স্টাইলে। কবি শুরুতেই একটা দীর্ঘ উপমা প্রয়োগ করেছেন, যে চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে তিনি স্পষ্ট করে তুলেছেন মৃত্যুর স্বভাবিকতা ও ভয়াবহতার কথা। কবির কথায়Ñ
কপোতাক্ষ পাড়ে বসে আমি দেখেছি কৈশোরে, ক্ষুধার্ত গাঙের
হাঁ-এর ভেতর বাড়িঘর নিয়ে, জলপাইগাছ আর নারকেলগাছ নিয়ে,
শিকড়বাকড়সহ গোটা পাকুড়গাছকে নিয়ে কিভাবে ঝপাং করে
ধসে পড়ে সাজানো দুপাড়; দেখেছি বৈশাখে
কিভাবে মাতাল ঝড় ফলভারে নুয়ে পড়া আমের বাগান দিয়ে যায় মুহূর্তেই
নিঃস্ব করে, ভেঙে দিয়ে বৃক্ষদের সবগুলো বুকের পাঁজর।
সেইভাবে হতভম্ব হয়ে আমি দেখলাম কী-বীভৎস ভাঙতে লাগলো,
হুড়মুড় করে পড়তে লাগলো ধসে তামাটে তোমার মুখের আঙিনা;
এবং তোমার সমস্ত শরীর মুহূর্তেই কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেল
যেভাবে নিস্তব্ধ হয়ে যায় কারফিউ ডাকা কোনো ভূতুড়ে শহর।
মৃত্যুর এমন প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক বর্ণনা কদাচিৎ চোখে পড়ে। এটা কবির শক্তিমত্তাকে নির্দেশ করে। এই কবিতার এক জায়গায় কবি বলছেনÑ
আজ তো বিপন্ন সেই পাখির ছানার মতো আমি, যার মাকে
অব্যর্থ নিরিখে শরবিদ্ধ করে ফিরে গেছে স্বগৃহে নিষাদ;
এবং আঁতকে ওঠা মুরগির সেই বাচ্চার মতো আজ আমি, যার মাকে
ছোঁ-মেরে গেছে নিয়ে অনন্তের গাঙপাড় হতে উড়ে আসা সাদা ডানার চিল।
কবি এখানে ব্যবহার করেছেন ‘সাদা ডানার চিল’। এটা একটা মেটাফোর। কবি সাদা ডানার চিল বলতে বুঝিয়েছেন আজরাইলকে। সেদিক থেকে এটি একটি সিম্বোলও। কিন্তু চিল তো সাদা ডানার হয় না। তাহলে কবির এই ব্যবহার কি ভুল? এখানেই তো অন্যদের থেকে কবির দেখার পার্থক্য। আসলে আজরাইলের ক্ষেত্রে সাদা ডানার চিল ব্যবহার করার কারণ হলো আজরাইল তো একজন ফেরেস্তা। আর সাদা হলো নিষ্কলুষতার প্রতীক।
এইভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সায়ীদ আবুবকর একজন স্বতঃস্ফূর্ত কবি, যিনি জোর করে কবিতা লেখেন না, কবিতা তার উপর ভর করে। সায়ীদ আবুবকর আমার ছাত্র। এ কারণে আমি খুবই গর্বিত বোধ করছি। সে যে বাংলা ভাষার একজন অন্যতম কবি হয়ে উঠেছে, এটা আমার জন্যে খুবই আনন্দের বিষয়।
# প্রাবন্ধিক এবং প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ ও ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এটি উৎসঙ্গ সৃজন চিন্তন কর্তৃক আয়োজিত কবির চল্লিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতা।