সরকারের মন্ত্রীদের বেফাঁস বক্তব্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া-সমালোচনা
স্টাফ রিপোর্টার: বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় আমরা সুখে আছি, বেহেস্তে আছি- পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন উক্তিতে সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে। এই বক্তব্যকে ‘জনগণের সাথে তামাশা’ বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, দেশের মানুষ যখন প্রতিমুহূর্তে ভোগান্তি পোহাচ্ছে, কষ্ট করছে এবং হিমশিম খাচ্ছে, জীবন দুর্বিষহ হচ্ছে সেই সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেহেস্তে যাওয়ার কথা বললেন, যে বেহেস্তে আছে। অন্যদিকে নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই। গতকাল বলেছেন, অন্য দেশের সাথে তুলনা করতে গিয়ে তিনি একথা বলেছেন।
শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রীই নয়, সরকারের অন্য মন্ত্রীদের বেফাঁস বক্তব্যে সমালোচনার ঝড় বইছে। এর মধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন বক্তব্য দিলেন। কয়েকদিন আগে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান বলেছিলেন, ‘খাব না, গমের আটার রুটি খাব না। তাহলে আমার গম ইমপোর্ট করতে হবে না। আমার ফরেন কারেন্সি যেটা আছে, সেটাতে শর্ট পড়বে না। আমার ডলার শর্ট পড়বে না।’ এরপর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বললেন, ‘প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে।...আমি মনে করি না, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি।’ এরপর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আশ্বস্ত করলেন, ‘দুশ্চিন্তা করবেন না, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে না।...আর মাত্র এক মাস। আমরা আগের অবস্থানেই ফিরে যাব।.... এখনো কেউ জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মারা যায়নি। আশা করি মরবে না।’
প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকারের মন্ত্রীরা আবোল তাবোল বলছেন। বেফাঁস মন্তব্য করছেন। আমি দুঃখিত ব্যক্তিগত পর্যায়ে কথা বলছি। ইদানিংকালে উনার(পররাষ্ট্রমন্ত্রী) যে চেহারা, সেই চেহারার মধ্যে যেটা ফুটে উঠেছে যে, স্ফিত হয়েছেন এবং বেশির ভাগ মন্ত্রীদের যেটা হয়েছে যে, সকলেরই আমাদের দেশি ভাষায় বলি, সরি যে একটা হালকা কথা বলব, ‘চিটনাই বেড়ে গেছে’। তার কারণটা হচ্ছে প্রচুর লুটপাট হচ্ছে। সেই লুটপাটের কারণে তারা জনগণের সঙ্গে পরিহাস, তামাশা শুরু করেছে এই সমস্যা(বিদ্যুতের লোডশেডিং) নিয়ে। জনদুর্ভোগের সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন বক্তব্য প্রদানের অধিকার নেই বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। তিনি আরও বলেন, মন্ত্রী মহোদয় এর আগেও এমন এমন সব উক্তি করেছেন যে উক্তিগুলোতে দেশের মানুষ কিছুটা হাস্যকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে উনার এরকম পরিহাস করার কোনো অধিকার নেই।
এদিকে বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে’ ব্যাখ্যা দিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। সিলেটে জেলা পরিষদের আয়োজনে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠান শেষে নিজের মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন বলেন, বেহেশতের কথা আমি বলেছি, কম্পারেটিভ টু আদার কান্ট্রি। অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের মানুষ ভালো আছে বোঝাতে গিয়ে বেহেশতে আছে বলেছি। আর আপনারা সব জায়গায় ‘বেহেশত’ বলেছেন... মানে আমার বক্তব্য টুইস্ট করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি বলেছি, অন্য দেশের তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি। এবং তাদের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি, এই কথা বলেছিলাম। কিন্তু আপনারা (সাংবাদিকরা) এক্কেবারে উল্টা! এর আগে শুক্রবার সিলেটে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পে ‘ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ক’ মতবিনিময় সভা শেষে বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা সুখে আছি, বেহেশতে আছি।
দেশের মানুষ বেহেশতে আছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বিভিন্ন মহলে। সিনিয়র সাংবাদিক সারফুদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, কথায় কথা বাড়ে জেনেও ঠ্যাটা পাবলিক সমানে কথা বলে। আকথা-কুকথা যা মুখে ও মনে আসে তাই বলে। কারণ নীরবতা আমজনতার স্বভাবধর্ম না। কিন্তু মন্ত্রী-আমলারা তো ‘আম’ জনতা না; তারা ‘আঙুর’ ওরফে খাসজনতা। কার কোনটা বলা উচিত, কোনটা উচিত না, তার ধার তারা ধারছেন না। কোন কথার ক্রিয়ায় কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে কোন কথার অর্থ আছে, কোন কথা অর্থহীন, কোন কথা জনসমক্ষে উচ্চারণীয় নয়, কোন কথা জনান্তিকেও বলা চলে না, কোন কথা ভাবাও অনুচিত, এসব বিবেচনার দায় এবং সময় কোনোটাই তাদের নেই।
সমালোচকরা বরছেন, মন্ত্রীদের এই সব সমকালীন লাগামছাড়া কথাবার্তা এই চলমান দুর্দশাকে অতিমাত্রায় প্রকট করে তুলছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘অন্য দেশের’ সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করেছেন। সেই ‘অন্য দেশ’ আসলে কোন দেশ? সে দেশ কি যুক্তরাজ্য? যুক্তরাষ্ট্র? আফগানিস্তান? পাকিস্তান? নাকি শ্রীলঙ্কা? সেসব দেশে কি আমাদের মতো ‘সবার গায়ে জামাকাপড় আছে’? প্রশ্ন হলো, যে কথা সাধারণ মানুষকে ধাক্কা দেয় এবং তাদের অসহায় অবস্থার প্রতি কটাক্ষ করে, আচমকা একের পর এক সরকারের মন্ত্রীরা সেসব কথা কেন বলছেন? এটি কি ন্যাচারাল ফেনমেনা বা প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ? নাকি এটি তাদের নিজেদের মধ্যে আত্মপ্রচারের এক দুর্নিবার প্রতিযোগিতার ফল? মনে হচ্ছে, নিজের বক্তব্য জনসমক্ষে জাহির করার তাগিদ তাদের এমনভাবে মোহাবিষ্ট করে ফেলছে যে, কী বললে এবং কত জোরে বললে মানুষ তা শুনবে এবং তা নিয়ে আলোচনা করবে, সেটিই তাদের আসল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।