রবিবার ০২ এপ্রিল ২০২৩
Online Edition

চট্টগ্রামের সর্বশেষ উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র রক্ষার দাবি সুশীল সমাজের

চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের সাড়ে ৬ কিলোমিটারের মধ্যে দেড় কিলোমিটার বেসরকারি খাতে দিতে চায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সেখানে পর্যটন  জোন-১ এবং পর্যটন জোন-২ হিসেবে ভাগ করে টেন্ডারের মাধ্যমে ২৫ বছরের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ইজারা দিতে যাচ্ছে সিডিএ। সেখানকার আয় দিয়ে সিডিএ পুরো সৈকতের ব্যয় নির্বাহ করবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে দরপত্রও জমা নেয়া হয়েছে। 

সিডিএ বলছে, এটি ইজারা নয়, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া। সৈকতের পরিবেশ ঠিক রাখতে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে তারা। পতেঙ্গাকে একটি পর্যটন জোন হিসাবে ঘোষণা করতে চায় সিডিএ। সেটি অন্তর্ভুক্ত করা হবে মাস্টারপ্ল্যানে। সৈকত এলাকার আশপাশের সবকিছু পর্যটন কেন্দ্রিক হতে হবে। পর্যটন কেন্দ্রিক ছাড়া সেখানে অন্য কোন কিছুর অনুমোদন দেয়া হবে না। 

তবে, সেসরকারি খাতে দেয়া হলে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার খর্ব হবে বলে মনে করছেন অনেকে। তাদের মতে, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত চট্টগ্রামের সর্বশেষ উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র। শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত যতস্থান ছিল, উন্নয়নের নামে প্রায় সবগুলো একে একে ধ্বংস করা হয়েছে। সর্বশেষ স্থান হিসাবে পতেঙ্গা সৈকতকে বেসরকারি খাতে দেয়া থেকে রক্ষা করতে হবে। সৈকতের অংশ ইজারা দেয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সুশীল সমাজ। সৈকতের অংশ বেসরকারি খাতে দেয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছেন তারা। 

তারা বলছে, উন্নতমানের নগরীতে সর্বশ্রেণির মানুষের অবকাশ ও বিনোদনের জন্য খেলার মাঠ, পার্ক ও উন্মুক্ত পরিসরের নেটওয়ার্ক থাকে। চট্টগ্রাম নগরীতে তার সিকিভাগও নাই। নানান উপায়ে তাতে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার সীমিত বা বন্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে উন্নত বিশ্বের পরিশীলিত নগরগুলোতে উন্মুক্ত পরিসর বৃদ্ধির জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে। ব্যক্তিগত খাতে ইজারা দিয়ে বিস্তৃত সৈকত বা নদীতীরে প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে কোথাও প্রবেশের অধিকার হরণ করা হয়েছে এমন তথ্য আমাদের জানা নাই।  তারা জানান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নগরের উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা এবং বিস্তৃত অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) পতেঙ্গা সৈকতকে পাবলিক ওপেন স্পেস বা সর্বজনের উন্মুক্ত পরিসর হিসেবে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। ঢাকায় তুরাগ নদীর দখল ও দূষণ নিয়ে করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের ১৮৩, ২১, ৩১ ও ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে "পরিবেশ, প্রাকৃতি সম্পদ উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, সমুদ্র সৈকত, নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওর, বিল, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন এবং বাতাস ইত্যাদি কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানিকে বাণিজ্যিকভাবে ইজারা নেয়া চলবে না মর্মে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে। এর আলোকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কোনো স্থান আইনগতভাবে ইজারা দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে না। 

নগরবাসীরা বলছে, বিপুল ব্যয়ে আউটার রিং রোড নির্মাণের পর পর্যটনের যে ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা যথাযথ রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে ক্ষতিগ্রত হচ্ছে। এই ক্ষতি এড়ানোর লক্ষ্যে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিকভাবে ব্যক্তি পর্যায়ে লিজ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। 

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি ও ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. সেকান্দার খান বলেন, এ বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট ব্যক্তব্য হলো, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের মত একটি সর্বজনীন উন্মুক্ত পরিসরে ভ্রমণ পিপাসুদের আগমন উন্মুক্ত রেখেও বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। সৈকতে আগতদের বিনোদন ও অবসরের প্রেক্ষিতে জলযান ভ্রমণ, ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট, হরেক রকমের দোকান, খেলার ব্যবস্থা ইত্যাদি নির্মাণ করে চউকের নিয়ন্ত্রণাধীনে রেখে এসব পরিচালনার সুযোগ লাভ ও ব্যক্তিগত খাতে ইজারা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় যাতে বিনিয়োগকারী কর্তৃক নিরাপত্তাসহ ভ্রমণকারীদের সকল সুবিধা নিশ্চিত করে সহজেই মুনাফা উঠিয়ে আনা যায়। চউককে সেই পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, কোনো স্থাপনা বা এলাকার সংরক্ষণ ব্যয় সংস্থানের জন্য কেবলমাত্র সেই স্থপনা বা এলাকাকে বেসরকারি পর্যায়ে লিজ দেয়াই একমাত্র সমাধান নয়- এই কথাটি নীতি-নির্ধারকদের বিবেচনায় আসতে হবে। যে কোনো শর্তেই লিজ দেয়া হোক না কেন চূড়ান্ত বিচারে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির সহায়তা নিয়ে জনকল্যাণমুখী বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছে তিনি। 

সিডিএ সূত্র জানায়, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত সাড়ে ছয় কিলোমিটারের। পর্যটনকেন্দ্রের দেড় কিলোমিটার অংশ বেসরকারি খাতে দেওয়ার জন্য দুই মাস আগে দরপত্র আহ্বান করে সিডিএ। দেড় কিলোমিটার অংশ বিশেষ জোন হিসেবে পরিচালনা করার জন্য একজন অপারেটরকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। দেড় কিলোমিটারের মধ্যে উত্তর প্রান্তে সাড়ে ৮০০ মিটার ও দক্ষিণ প্রান্তে সাড়ে ৬০০ মিটার জায়গায় এ বিশেষ জোন হবে। সেখানে রাইডসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। এর থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বাকি পাঁচ কিলোমিটার অংশ রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। পাঁচ কিলোমিটার অংশ একেবারে উন্মুক্ত থাকবে।

জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, পুরো পতেঙ্গা সৈকতের উন্নয়ন করা হয়েছে। বড়েছে সৈকতের পরিধি। সৈকতের ভূমির মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। সেখানে আবেদন করা হয়েছে। কথা হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথেও। সাড়ে ৬ কিলোমিটার সৈকতের মধ্যে আমরা দেড় কিলোমিটার এলাকা বেসরকারি খাতের পরিচালনায় দিচ্ছি। পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম’র সাংবাদিক সম্মেলন : গতকাল শনিবার সিডিএ কর্তৃক পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ইজারা প্রদানের নাগরিক স্বার্থ ক্ষুন্নকারী পরিকল্পনার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম। এতে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সভাপতি ও ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. সেকান্দার খান। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া। ফোরামের সহ-সভাপতি আহমেদ জিন্নুর চৌধুরী, প্রকৌশলী এবিএম এ বাসেত, সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাসলিমা মুনা ও শাহরিয়ার খান প্রমুখ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ