ঢাকার ভবিষ্যৎটা কি?
মাজহার মান্নান
“চলো যাই ঢাকা
দু’হতে আসবে টাকা
ঘুরবে ভাগ্যের চাকা।”
ঢাকা সম্পর্কে মানুষের এ ধরনের একটি ধারণা বহু আগে থেকেই আছে এবং এখনো সেটা চলমান। ঢাকাকে নিয়ে দারুণ জনপ্রিয় বাংলা গানও রচিত হয়েছে। “লাল নীল বাতি দেইখা নয়ন জুড়াইছে, ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে।” কিন্তু এখন আর ঢাকাকে দেখে কারও নয়ন জুড়ায় না, বরঞ্চ ইট পাথরের এই শহরে মানুষ আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। জনদুর্ভোগ আজ চরমে উঠেছে। ঢাকা শহরের সমস্যা নিয়ে মহাকাব্য রচনা করলেও এর সমস্যা বলে শেষ করা যাবে না। এই শহরটি নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ ভাবনা কি? পরিকল্পনা তো আর কম হল না। কিন্তু ফলাফলটা কি? সংকট তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। সবাই ঢাকা থাকতে চায়। কিন্তু সবাইকে ঢাকা থাকতে হবে কেন? ঢাকার বিকল্প কেন তৈরি করা যাচ্ছে না? যাদের ঢাকায় কোন কাজ নেই তারাও একটি ফ্লাট কিনে ঢাকায় স্থায়ী হতে চায়। ঢাকার খাল, জলাশয় ভরাট করে চলছে রমরমা আবাসন ব্যবসা। আমরা কি ঢাকাকে বাঁচাতে চাই নাকি রমরমা ব্যবসা করে পকেট ভারী করতে চাই?
যতদূর চোখ যায় শুধু ভবন আর ভবন। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। দশ বছর আগে যে জায়গা দেখেছি উন্মুক্ত প্রান্তর সে জায়গায় আজ শত শত সুউচ্চ ভবন। বড় বড় অট্টালিকা তৈরির যে নীতিমালা সেটাও মেনে চলা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটির কাছাকাছি। ২০৩৫ সালে এই জনসংখ্যা দ্বিগুন হয়ে ৩ কোটি ৫০ লাখ হবে। ১৯৭৪ সালে আদমশুমারি হয়েছিলো তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ লাখ। সেটা এখন ২ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার জনসংখ্যা যত বাড়ছে জনদুর্ভোগ তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি জরিপ দেখাচ্ছে যে, প্রতিবছর ৬ লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হচ্ছে ঢাকা শহরে। প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ জন। বর্তমানে ডিএসসিসিতে ৭৫ টি ওয়ার্ড রয়েছে এবং এর ১০৯ দশমিক ২৫১ বর্গ কিলোমিটারের বাস করে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। অন্যদিকে ডিএনসিসিতে ৫৪ টি ওয়ার্ডে ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৮০ লাখ মানুষের বসবাস। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব সমগ্র বিশ্বে ঢাকা শহরে বেশি। ঢাকা শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩৫০০ মানুষ। এত ঘনবসতির শহর আর কোথাও নেই।
গত ৫০ বছরে ৮৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। শুধু নির্মাণ আর নির্মাণ। কিন্তু এসব নির্মাণের ভবিষ্যৎ কী তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা নেই। একজন বুদ্ধিজীবী একবার রসিকতা করে বলেছিলেন যে, ঢাকা শহরের জমি কেনাবেচা ১০ বছর স্থগিত রাখা উচিত এবং একই সাথে অপ্রয়োজনীয় নির্মাণ কাজও। কথাটি তিনি রসিকতা করে বললেও বাস্তবতাতো এখন সেদিকেই মোড় নিচ্ছে। বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় এখনও ঢাকার অবস্থান তলানিতে। বসবাসযোগ্য ১৪০ তম শহরের তালিকায় ঢাকের অবস্থান ১৩৭ তম। ঢাকা শহরে গড়ে উঠেছে পাঁচ হাজার বস্তি এবং এই বস্তিতে বাস করে ৪০ লাখ মানুষ। প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনে বাড়ছে ঢাকায় মানুষ। এর ফলে বাড়ছে প্রয়োজনীয়তা। আর এই প্রয়োজনীয়তাকে মিটানোর জন্য তৈরি হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। যানজট, বায়ু দূষণ, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য অব্যবস্থাপনা, শব্দ দূষণসহ নানা জনদুর্ভোগে জালে আটকা পড়ে আছে ঢাকাবাসী। ঢাকা মহানগরীতে গাড়ির জ্যাম নতুন কোন বিষয় নয় তবে সম্প্রতি এর তীব্রতা অতিমাত্রায় বেড়েছে। রাস্তার মাঝেই নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্ম ঘণ্টা, অপচয় হচ্ছে অর্থ এবং তীব্রভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
ঢাকামুখী জনস্রোতে ঢাকা আজ সত্যি কাহিল হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে ট্রাফিক জ্যামের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। জ্যাম দেশের জিডিপির একটি বড় অংশ খেয়ে ফেলে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে যে, ট্রাফিক জ্যামের কারণে প্রতিদিন গড় ক্ষতি ৩০০ - ৩৫০ কোটি টাকা। গত এক যুগে বছরে ঢাকার গড় ট্রাফিক স্পীড ২১ কিমি / ঘণ্টা থেকে নেমে ৫ কিমি / ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে এবং এই গতি আরো নেমে যাওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। হাঁটার গতিও এর থেকে বেশি হয়ে থাকে প্রতি ঘণ্টায়। অতি জনবহুল এ শহরে সেভাবে প্রশস্ত রাস্তা তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের পুরো জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বসবাস ঢাকা ও এর আশে পাশে। সকল অফিস-আদালতের হেড কোয়ার্টার ঢাকায়। প্রশাসনিক দপ্তর ছাড়ারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন কোম্পানী, পোশাক কারখানাসহ নানা কিছু ঢাকায় অবস্থিত। ট্রাফিক পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে রাস্তা আছে ২২০০ কিলোমিটার যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক। কিন্তু প্রধান সড়ক প্রয়োজন প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার।
অপ্রতুল এসব সড়কের অর্ধেকের বেশি দখল করে রাখে ফুটপাতসহ নানা নির্মাণ সামগ্রী, ভ্যান, রিকশা, লেগুনা, হিউম্যান হলার, ট্রাক সবজি ও মাছ বিক্রতার বিভিন্ন পরিবহন ইত্যাদি। ঢাকা শহরের সড়কগুলিতে সারা বছর চলে খুঁড়াখুঁড়ি যার ফলে জ্যাম লেগেই থাকে। রাজধানীকে বিকেন্দ্রীকরণের সময় এসেছে। এছাড়াও রাজধানী সুবিধামত জায়গায় সরিয়ে নেয়া যায় কিনা সেই ভাবনাটাও এখন সময়ে দাবি। ঢাকা শহর এখন যে অবস্থায় আছে এটাকে আর বাড়তে দেয়া মোটেও সমীচীন হবে না। ঢাকার আর অধিকতর উন্নয়নের কি প্রয়োজন আছে? যার হাতে ৫০ লাখ টাকা আছে সেই ঢাকা শহরে ফ্লাট কিনতে চায়। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রেরিত সিংহভাগ অর্থই ব্যয় হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। বিদেশ থেকে শ্রমিকেরা যে অর্থ উপার্জন করে তা দিয়ে বড় বড় শহরে বিশেষ করে ঢাকায় ফ্লাট কিনে। এর ফলে ঢাকা শহর আরো ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে, সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। আবাদি জমি নষ্ট করে ফ্লাট নির্মাণের যে হিড়িক তৈরি হয়েছে তা কাক্সিক্ষত নয়। ব্যাংকগুলিও ফ্লাট বা আবাসন ঋণ দিতে খুব আগ্রহী। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ চলে যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে।
ব্যাংক বহির্ভূত নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলিও অনুৎপাদনশীল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। ঢাকা শহরে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ কমানোর কোন উদ্যোগ নেই। অথচ মূল উদ্যোগ হওয়া উচিত ছিল এটি। ঢাকার জনসংখ্যার লাগাম টানতে হতে ঢাকার বাইরে ব্যাপক কর্মসংস্থান গড়ে তুলতে হবে। কৃষি আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। অথচ উৎপাদনশীল এই খাতটিতে শ্রমিক পাওয়া দায় হয়ে গেছে। গ্রামের কৃষি শ্রমিকরা এখন শহরমুখী হয়ে অটোরিকসাসহ নানা ধরনের অনুৎপাদনশীল খাতে যুক্ত হচ্ছে। ঢাকার বিভিন্ন গলিতে অটোরিকসার রাজত্ব চলে। লক্ষ লক্ষ কৃষি শ্রমিক এখন ঢাকায় অটো চালায়। ঢাকায় কি আসলে এদের কোন প্রয়োজন আছে? ঢাকার বাইরের জেলাগুলিতে চাকরি করলেও বেশিরভাগ চাকরিজীবী পরিবার ঢাকায় রাখে। ঢাকায় তাদের থাকতেই হবে। ঢাকায় না পড়ালে সন্তান ভাল কিছু করতে পারবে না এমন ভ্রান্ত ধারণাও মধ্যবিত্ত একটি শ্রেণির মাঝে তৈরি হয়েছে। ঢাকায় টাকা উড়ে এমন গুজব সারাদেশব্যাপী ছড়িয়ে আছে।
নিম্ন আয়ের মানুষেরা এসব গুজবে কান দিয়ে নগদ টাকার স্বাদ নিতে চায়। এর ফলে ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এসব ভাসমান মানুষের জন্য কোন পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। তাই তাদের দ্বারা সড়কগুলি দূষিত হয়। ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত প্রধান সড়কে মূত্রের গন্ধে চলা দায়। ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব কমানোর জন্য ড্যাবে কিছু উদ্যোগের কথা বলা আছে। কিন্তু ঢাকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিতে হবে। ১. ঢাকাবাসীর জন্য সিটি কার্ড করা যেতে পারে ২. ঢাকায় আর কোন বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে না তোলা ৩. বিভিন্ন ধরনের অফিসগুলি বিভাগীয় শহরে সরিয়ে ফেলা ৪. ঢাকায় নয়, জেলাভিত্তিক বড় বড় হাসপাতাল গড়ে তোলা ৫. ঢাকায় জলাশয় ভরাট করে আবাসন নয়, এমন সিদ্ধান্তে অটল থাকা ৬. ঢাকায় কোন ভবন অনুমোদনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা ৭. ঢাকায় কোন কোচিং সেন্টার আর গড়ে উঠতে না দেয়া ৮. সরকারি চাকরিজীবীদের জেলা শহরে থাকতে বাধ্য করা। ৯. ঢাকার হারানো সব খাল ও জলাশয় উদ্ধার করা ১০. ঢাকায় আর যানবাহন যাতে বাড়তে না পারে সেদিকে কঠোর নজর দেয়া।
যাহোক রাজধানীকে বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইস্যুগুলি বড় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে ঢাকা বাঁচাও কর্মসূচী হাতে নিতে হবে। আর ঢাকাকে যদি আমরা বাঁচাতে ব্যর্থ হই তবে সেটার খেসারত আমাদের অবশ্যই দিতে হবে। তাই কাব্যিক স্লোগান হোক -
“আর নয় দুর্ভোগ চল ঢাকা ছাড়ি
মাঠে ঘাটে খেটে খাবো থাকবো বাড়ি।”