ড্রোন শুধু রক্ত ঝরায় না
ড্রোন-এর অনেক গল্প আছে। বর্তমান সভ্যতায় প্রযুক্তির গল্প হবে, মারণাস্ত্রের গল্প হবে, ড্রোন-এর গল্প হবে- এটাই তো স্বাভাবিক। তবে ড্রোন-এর সব গল্প একরকম নয়। আফগানিস্তানে ড্রোনের গল্পÑ পরাশক্তির আগ্রাসনের গল্প, মানুষ হত্যার গল্প। আর ইউক্রেনে ড্রোনের গল্প হলো, আগ্রাসন ঠেকানোর গল্প। ড্রোনের অন্য গল্পও আছেÑ সেটা হলো মানবিক আচরণের গল্প। বর্তমান অমানবিক ও নিষ্ঠুর সভ্যতায় এমন গল্পই মানুষের কাম্য। তবে কাংখিত এই গল্পের বয়ান একটু পরে শোনাবো।
আমাদের প্রিয় স্বদেশেও ড্রোন নিয়ে কথা হচ্ছে। কথা হওয়াটাই স্বাভাবিক। বর্তমান বিশ^ব্যবস্থায় কোনো বিষয়েই পিছিয়ে থাকার যুক্তি নেই। সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে। পিছিয়ে থাকলে কপালে জুটবে অবজ্ঞা আর আগ্রাসন। একটি ছোট দেশও যদি চোখ-কান খোলা রাখে, সম্পদ আহরণ ও সদ্বব্যবহারে সচেতন থাকে, জনগণকে জনশক্তিতে পরিণত করতে পারে, দেশের ভিতরে এবং বাইরে ন্যায় ও নীতিকে সমুন্নত রেখে মেরুদ- সোজা রাখতে পারে; তবে সে দেশের প্রগতি কেউ রুখতে পারবে না। এমন বিবেচনায় ড্রোন চর্চা কিং ড্রোন সমৃদ্ধ হওয়ার বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক।
মূল প্রশ্ন হলো, একটি দেশ ড্রোন দিয়ে কী করবে? মনুষ্যবিহীন এই আকাশযানটি দিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করা যায়, অশুভ শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কাজ করা যায়, আবার এই ড্রোন দিয়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্রকে উত্ত্যক্তও করা যায়। অর্থাৎ বর্তমান সময়ে এই আকাশযান দিয়ে ভালো ও মন্দ কাজ করা যায়। বিষয়টি নির্ভর করবে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র প্রধানদের আদর্শ ও নীতির ওপর। মন্দ মানুষের কর্তৃত্বে থাকলে ড্রোন মন্দ কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।
এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। তুরস্কের তৈরি বাইরাকটার টিবি ২ ড্রোন বাংলাদেশ ক্রয় করছে বলে জানা গেছে। এই ড্রোন কেনার ব্যাপারে বাংলাদেশ সম্প্রতি চুক্তি করেছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান। তিনি বলেন, ড্রোন বাইরাকটার টিবি ২-এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাইকার টেকনোলজির সঙ্গে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সম্প্রতি চুক্তি সই করেছে। এছাড়া কূটনৈতিক সূত্রে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আওতায় তুরস্ক নির্মিত মাইন থেকে সুরক্ষাকারী যান, সাঁজোয়া যান এবং বহুমাত্রিক রকেট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশের কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত কামানের গোলা বিক্রির বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি সই হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের কাছে সামরিক হেলিকপ্টার ও ট্যাংক বিক্রিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তুরস্ক।
ড্রোন কিংবা যে কোনো সমরাস্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারে এর মান এবং সাফল্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন থাকতে পারে। তুরস্কের বাইরাকটার টিবি ২ ড্রোন-এর আগে লিবিয়া, সিরিয়া এবং আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধে সফল ব্যবহারের কারণে আলোচনায় এসেছিল। সর্বশেষ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ে এ ড্রোনের ভূমিকা সমর বিশ্লেষকদের নজর কেড়েছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সাল থেকে তুরস্ক নির্মিত ড্রোন কিনে আসছে ইউক্রেন, যার সংখ্যা কমপক্ষে ৩৬টি। আর এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ আগ্রাসন শুরুর পর তুরস্কের কাছ থেকে অন্তত ৫০টি ড্রোন সংগ্রহ করেছে ইউক্রেন।
এদিকে নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, চিরাচরিত যুদ্ধে ড্রোন কীভাবে নিয়ামক ভূমিকা রাখে নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধে, আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার লড়াইয়ে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। আর এবার রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে তুরস্কের ড্রোনের ভূমিকা আরেকবার জোরালোভাবে প্রমাণিত হলো। যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দেয়ার ক্ষেত্রে ড্রোনের এই ভূমিকার কারণে বিশে^র সব দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের পাশাপাশি সামর্থ্য বাড়ানোর পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ড্রোনের প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য ভালো উৎস হতে পারে তুরস্ক।
ড্রোনের সামরিক ব্যবহারের কথা আমরা জানলাম। ড্রোনের অন্য গল্পও আছে, লেখার শুরুতে যার কথা উল্লেখ করেছিলাম, আর সেটা হলো ড্রোনের মানবিক ব্যবহার। স্পেন থেকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স আমাদের সেই গল্প শুনিয়েছে। ২৬ জুলাই তা মুদ্রিত হয়েছে গণমাধ্যমে। উত্তাল সাগরে ডুবে যাচ্ছিলো ১৪ বছরের এক কিশোর। এমন সময় সেখানে হাজির হয় একটি ড্রোন। ড্রোন থেকে সাগরে ফেলা হয় একটি লাইফ জ্যাকেট। সেই জ্যাকেটেই ভেসে থেকে প্রাণে বেঁচে যায় কিশোরটি। ঘটনাটি ঘটেছে এই জুলাই মাসেই, স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায়। আর এ ঘটনার মূল নায়ক মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল পেদরেরো নামের এক ব্যক্তি। তিনিই চালাচ্ছিলেন ড্রোনটি। পেদরেরো বলেন, ‘আমরা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম, তখন দেখলাম ওই কিশোর খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে। তার শরীরে ভেসে থাকার মতো শক্তি নেই বললেই চলে। তাই আমি একটি লাইফ জ্যাকেট পাঠালাম।’ তবে এই পাঠানোর কাজটি তেমন সহজ ছিল না। পেদরেরো বলেন, ড্রোনটিকে কিশোরের কাছে পৌঁছাতে তাঁকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আমরা জানি যে, ড্রোন হলো মনুষ্যবিহীন একটি আকাশযান। বড় বড় ঢেউয়ের কারণে ড্রোনটি চালানো কঠিন ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা তাঁর কাছে লাইফ জ্যাকেট পৌঁছে দিতে সক্ষম হই। পরে জেট স্কি দিয়ে উদ্ধারকারীরা তার কাছে পৌঁছায়। এর আগ পর্যন্ত সে ওই লাইফজ্যাকেট ব্যবহার করে ভেসে ছিল।
সে দিনের ঘটনায় ব্যবহার করা ড্রোনটি ভ্যালেন্সিয়ার জেনারেল ড্রোনস কোম্পানির। এই প্রতিষ্ঠান উত্তর ভ্যালেন্সিয়ার সাগুন্তো শহরে সমুদ্র সৈকতের উদ্ধারকারীদের ড্রোন প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা শুরু করে ২০১৭ সালে। বর্তমানে স্পেনের ২২টি সমুদ্র সৈকতে উদ্ধারকারীদের সহায়তা করছেন জেনারেল ড্রোনসের ৩০ জন ড্রোন চালক। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উদ্ধারের পর কিশোরটিকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। এর আগে তাকে কিছুক্ষণ অক্সিজেন দিতে হয়েছিল। হাসপাতালে কয়েক ঘণ্টা চিকিৎসার পর সুস্থ হলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনায় উপলব্ধি করা যায়, ড্রোন শুধু যুদ্ধ কিংবা মানুষ হত্যায় কাজ করে না, মানুষের প্রাণ বাঁচাতেও কাজ করে। এখন সিদ্ধান্ত মানুষের হাতে। বিশ^নেতারা আফগানিস্তান কিংবা ইউক্রেন যুদ্ধের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে ড্রোন মানুষ হত্যা করবে, নয়তো ড্রোন কাজ করবে মানব কল্যাণে এবং মানব রক্ষায়।