ব্যাংক খাত প্রসঙ্গে উচ্চ আদালত
দু’জন মাননীয় বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ দেশের ব্যাংক খাত প্রসঙ্গে অত্যন্ত ভীতিকর এবং কঠোর মন্তব্য করেছেন। গত মঙ্গলবার ঋণ জালিয়াতিবিষয়ক এক মামলার শুনানিকালে মাননীয় বিচারপতিদ্বয় বলেছেন, দেশের ব্যাংক খাতে সবচেয়ে সাংঘাতিক অপরাধ হচ্ছে এবং এসব অপরাধ দেশকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। উদ্বিগ্ন বিচারপতিরা প্রশ্ন করেছেন, এভাবে চললে দেশ এগোবে কিভাবে?
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, দন্ডবিধির বিভিন্ন ধারা-উপধারায় জালিয়াতির অপরাধ করার অভিযোগে চলতি বছরের মার্চ মাসে ইসলামী ব্যাংকের চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ শাখার কয়েকজন অফিসার ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুদক একটি মামলা দায়ের করেছিল। অভিযোগে বলা হয়েছিল, এসব অফিসার ও কর্মচারী পারস্পরিক যোগসাজশে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সেই অর্থ নিজেদের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন। এসব অ্যাকাউন্টকে ভুয়া হিসেবে উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল।
অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজন আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করায় মামলার শুনানির জন্য হাইকোর্ট দু’জন বিচারপতির সমন্বয়ে একটি বেঞ্চ গঠন করে দিয়েছিল। মঙ্গলবার শুনানি চলাকালে সেই বেঞ্চের মাননীয় বিচারপতিরাই ব্যাংক খাত সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করেছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, যথেষ্ট কঠোর হলেও হাইকোর্ট বেঞ্চের মন্তব্যের মূলকথার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, উদাহরণ হিসেবে একটিমাত্র ঘটনার উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে সরকারের ভুল নীতি ও দলীয় বিবেচনায় নিযুক্তি দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে দেশের ব্যাংকিং খাত আসলেও মারাত্মক বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, অনেক বিভিন্ন উপলক্ষে সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদসহ তথ্যাভিজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে নীতিতে সংশোধন করার পাশাপাশি বাস্তবভিত্তিক ব্যবস্থা না নেয়া হলে ব্যাংকিং খাতই শুধু ধ্বংস হয়ে যাবে না, জাতীয় অর্থনীতিও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ইসলামী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি সম্পর্কিত শুনানিতে মাননীয় বিচারপতিরাও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।
স্মরণ করা দরকার, ইসলামী ধারার প্রধান দুটি ব্যাংককে বিপন্ন করার পাশাপাশি সরকারের অন্য কিছু সিদ্ধান্তের পরিণতিতেও দেশের ব্যাংকিং খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রাধান্যে এসেছে নতুন কয়েকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও সরকার একের পর এক নয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে রাজনৈতিক বিবেচনা। কিন্তু দেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারের পরিসর অত্যন্ত সীমিত হওয়ার কারণে এসব ব্যাংক মোটেও সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। কোনো কোনো ব্যাংক বরং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই লোকসান গোনার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে উঠেছে। ফারমার্স ব্যাংকসহ দু’একটিকে বন্ধও করতে হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠাকালে ঋণসহ কৃষকদের সহায়তা দেয়ার উদ্দেশ্যের ঘোষণা দিলেও ফারমার্স ব্যাংকের কাছ থেকে কৃষকরা কোনো সহায়তাই পায়নি। কৃষকদের দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি বরং আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ী নামধারীদের লুণ্ঠনের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ব্যাংকটির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। সবশেষে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসা নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগ করে বিদায় নিয়েছিলেন চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন খান আলমগীর। তার সঙ্গে অন্য কয়েকজনকেও বিদায় নিতে হয়েছিল। অর্থনীতিবিদসহ বিশিষ্টজনেরা তখন বলেছিলেন, ‘মখা যুগের’ অবসান ঘটলেও ফারমার্স ব্যাংকের মতো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যাংকের পক্ষে আর কখনো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া সম্ভব হবে না। কারণ, এসবের অন্তরালে যারা রয়েছেন তাদের অর্থ লুণ্ঠন সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারের ভুল ও ক্ষতিকর নীতি ও সিদ্ধান্তের কারণেই দেশের ব্যাংকিং খাত বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। সে কথাটাই সতর্কবাণী উচ্চারণের সুরে বলেছেন হাই কোর্ট বেঞ্চের মাননীয় দু’জন বিচারপতি। আমরাও মনে করি, সরকারের উচিত বিদ্যমান ব্যাংকগুলোকে বিপর্যয়ের কবল থেকে উদ্ধার করার উদ্যোগ নেয়া এবং সে লক্ষ্যে দ্রুত তৎপর হয়ে ওঠা। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকসহ ইসলামী ধারার দুটি প্রধান ব্যাংকের ব্যাপারে নীতি ও কৌশলে পরিবর্তন ঘটানো দরকার। না হলে এবং ঋণ ও বাণিজ্যের নামে লুণ্ঠনের বাধাহীন কারবারকে চলতে দেয়া হলে একদিকে কোনো ব্যাংকের পক্ষেই বিপর্যয় কাটিয়ে লাভজনক হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না, অন্যদিকে দেশের ব্যাংকিং খাতই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আমরা তাই সরকারের প্রতি দ্রুত উদ্যোগী হয়ে ওঠার এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানাই।