আলোর ঝলকানি পদ্মা সেতুতে

লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) সংবাদদাতা : আলোর ঝলকানিতে আলোকিত হয়ে উঠেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত পদ্মা সেতুর মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া প্রান্তের ২০৭ টি ল্যাম্প পোস্টে আলো ঝলমলে করে জ্বলতে থাকে। এর ফলে পদ্মা সেতু অপরূপ রূপ ধারণ করে। মাওয়া প্রান্তের সবকটি ল্যাম্প পোস্টে বাতি জ্বললো এই প্রথম। এরআগে গেলো ৫ জুন বিকেলে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জলানো হয়। ওই দিন সেতুর ১৪ নম্বর থেকে ১৯ নম্বর পিলারের মাঝামাঝিতে ২৪ টি ল্যাম্প পোস্টে বাতি জলানো হয়েছিলো। এরপর ১১ জুন পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ভাবে সেতুর সবকটি বাতি জলানো হয়। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুত সমিতির দেওয়া বৈদ্যুতিক সংযোগের মাধ্যমে এই প্রথম মাওয়া প্রান্তের ২০৭ টি ল্যাম্প পোস্টে বাতি জলানো হয়েছে। এরআগে পরীক্ষামূলক ভাবে সেতু জেনারেটরের মাধ্যমে আলো জলানো হয়েছিলো। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ্যের এ সেতুতে বিদ্যুতের বাতি রয়েছে ৪১৫ টি। আর দু’পাশের সংযোগ সড়কে রয়েছে আরও ২০০ টি বিদ্যুত বাতি। গেলো বছরের ২৫ নবেম্বর মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া প্রান্তে প্রথম ল্যাম্প পোস্ট বসানোর কাজ শুরু হয়েছিলো।
চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল এসব ল্যাম্পপোস্ট বসানো ও এরমধ্যে বাতি লাগানোর কাজ শেষ হয়। এরপর পুরো সেতুতে কেবল টানা হয়েছে। গেলো ২৪ মে প্রথমে শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুত সমিতি সেতুকে বিদ্যুত সংযোগ দেয়। ওই দিন রাত সাড়ে ৮ টার দিকে সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা প্রান্তে ৪২ নম্বর পিয়ারে এ বিদ্যুত সংযোগ প্রদানের কাজ শেষ হয়। এরপর মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুত সমিতিও সেতুতে বিদ্যুত সংযোগ প্রদান করে। সর্বসাকুল্যে ৩০ মে প্রতিটি ল্যাম্প পোস্টে বিদ্যুত সংযোগ দেওয়ার কাজ শেষ করে মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুত সমিতি।
উল্লেখ্য আগামী ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন। পরদিন থেকে সকাল থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিনবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন দ্বার উম্মোচন হতে চলেছে।
মুন্সীগঞ্জ সংবাদদাতা : পদ্মাসেতু থেকে মাসে টোল আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। বছরের হিসেবে তা হবে ১ হাজার ৬০৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এ টাকা দিয়ে সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও নির্মাণ খরচের ঋণ পরিশোধ করবে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। কোনো উন্নয়ন সহযোগী বা প্রতিষ্ঠানকে নয়, স্বয়ং বাংলাদেশ সরকারকে ৩৫ বছরে সুদসহ ৩৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মিত। এর পুরোটাই সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেছে। চুক্তির অনুচ্ছেদ ২ মোতাবেক ঋণের অর্থ প্রকল্প সমাপ্তির পর বার্ষিক ১ শতাংশ হারে সুদসহ ৩৫ বছরে ১৪০ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া নকশা প্রণয়নের সময় নেওয়া ২১১ কোটি টাকার বিপরীতে ৩৪০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে ।কাদের বলেন, সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। আগামী ৩৫ বছরে সরকারকে সুদে আসলে ৩৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।
ঋণ পরিশোধ, সেতুর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, নদীশাসন এবং আদায়কৃত টোলের ট্যাক্স ও ভ্যাট বাবদ অর্থ পরিশোধ করার জন্য টাকা প্রয়োজন। এসব টাকা সেতুতে চলাচলকারী যানবাহনের উপর টোল আরোপ করে উঠানো হবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমানে ফেরি পারাপারের বিদ্যমান টোল হারকে ভিত্তি ধরে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিসির মাধ্যমে মাওয়া-জাজিরা রুটে ফেরিতে বর্তমানে চলাচলকারী যানবাহনের (নভেম্বর ২০২০ এর তথ্য অনুযায়ী) আদায়কৃত টোল হার অনুযায়ী মাসে ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, বছরে ৬৭ কোটি ২০ লাখ টাকা আদায় হয়। এর দেড়গুণ হলে মাসে ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা হিসেবে বছরে ১০৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা টোল আদায় হওয়ার কথা।
অন্যদিকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১০ সালে দাখিলকৃত পদ্মা সেতুর ডিটেইলড ইকোনমিক অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস সম্বলিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ট্রাফিক ফোরকাস্ট হিসেবে ফেরির টোল হারের দেড়গুণ হিসেবে মাসে টোল আদায় হবে ১৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই সরকার আশা করছে বছরে ১ হাজার ৬০৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা টোল আদায় হবে।
সূত্র জানায়, অর্থ বিভাগ এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মধ্যে সম্পাদিত ঋণ চুক্তিতে উল্লিখিত ৩৫ বছর মেয়াদি লোন রিপেমেন্ট সিডিউল অনুযায়ী, সেতুতে যানবাহন চলাচলের প্রথম বছরেই ৫৯৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এটা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে কোনো কোনো বছর ১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হবে। তাছাড়া সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয়, নদীশাসন, ভ্যাট ও ট্যাক্স পরিশোধ সবই করতে হবে টোলের টাকা থেকে। টোল আদায়ের ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের টোল নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, মোটরসাইকেলের টোল ১০০ টাকা, বড় বাসের টোল ২ হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি ধরনের বাসের টোল ২ হাজার টাকা, কার ও জিপের ৭৫০ টাকা, চার এক্সেল টেইলারের ৬ হাজার টাকা, মাইক্রোবাস ১৩০০ টাকা এবং মিনিবাসের (৩১ সিট বা তার কম) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪০০ টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক (সচিব) মো. মনজুর হোসেন বলেন, আমরা সরকারের সঙ্গে ঋণচুক্তি করে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন করেছি। সুদসহ সরকারকে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে যা টোল আদায় থেকে আসবে। সরকারের কাছে আমাদের ঋণ, ফেরির ভাড়া ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতেই টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে।