টিআইবির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ
গঠিত হওয়ার পর থেকেই জোর তৎপরতা চালাতে শুরু করেছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করে চলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। সঙ্গে অংশ নিচ্ছেন অন্য কমিশনারসহ কমিশনের কর্মকর্তারা। এরকম প্রতিটি বৈঠকের পরই প্রকাশিত হচ্ছে আমন্ত্রিতদের মন্তব্য ও অভিমত। প্রকাশিত হচ্ছে কমিশনের পক্ষে সংশ্লিষ্টজনদের বক্তব্যও। যেমন সোমবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশÑ টিআইবির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বৈঠকের পর সিইসি জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন হিসেবে সকল নির্বাচনেই তারা সরকারের সহায়তা চাইবেন। নিজেদের আশার কথা জানাতে গিয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, পৃথিবীর অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে বলেই তারা আশা করেন। তাছাড়া আইন অনুযায়ী সরকার কমিশনকে সহায়তা করতে বাধ্যও। সাংবাদিকদের সিইসি আরো বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকার যখন হবে তখন সরকারের ধরনও পাল্টে যাবে। ওই সরকার পলিসি নিয়ে কোনো কাজ করবে না। নির্বাচনের কাজে কমিশনকে সহযোগিতা করতে হবে। পৃথিবীর সব দেশে এটাই নিয়ম। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না বলেই সিইসি আশা করেন।
অন্যদিকে টিআইবির পক্ষ থেকে দেয়া পরামর্শে বলা হয়েছে, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে কমিশন যেন প্রয়োজনে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আইনি সংস্কারের প্রস্তাব দেয়। এ প্রসঙ্গে সিইসি বলেছেন, তারা যে সহায়তা ও সহযোগিতার কথা বলছেন তার সবই মূলত পুলিশ প্রশাসন ও জনপ্রশাসনকেন্দ্রিক। সেই সাথে রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। অন্য কোনো মন্ত্রণালয় নিয়ে কমিশনের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। কারণ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ন্ত্রণ করে জনপ্রশাসন আর পুলিশ প্রশাসনকে হ্যান্ডেল বা নিয়ন্ত্রণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সিইসি আরো বলেছেন, সন্ত্রাসী বাহিনীকে যদি জড়িত করা হয় তাহলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দরকার পড়বে। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনে মূল বিরোধীদলকে নিয়ে আসার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, নির্বাচন স্বচ্ছ বা অস্বচ্ছ যা-ই হোক না কেন, মূল বিরোধীদল যদি অংশ না নেয় তাহলে নির্বাচনের গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা অনেক কমে যাবে। গণতন্ত্রের মূলকথাই যেহেতু পজিশন এবং অপোজিশন সেহেতু মূল বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে হবে। এ উদ্দেশে এমন অবস্থা তৈরি করতে হবে যাতে প্রধান দলগুলোর নেতারা কেবল মাঠে-ময়দানের বক্তৃতায় আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখার পরিবর্তে আলোচনার টেবিলেও মুখোমুখি বসেন এবং আলোচনার মাধ্যমে সব বিবাদের মীমাংসা করেন।
আমরা নতুন সিইসিসহ অন্য কমিশনারদের আলোচনার উদ্যোগ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টার প্রশংসা করি। তাদের সাফল্যও কামনা করি। বিষয়টি অবশ্য ততটা সহজ নয়, যতটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বাইরে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ প্রতিটি প্রধান ও জনসমর্থিত দলই যেখানে নির্বাচনকালীন সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক তথা কেয়াটেকার সরকার করার দাবি জানিয়ে সে দাবিতেই এখনও অনড় রয়েছে, নতুন সিইসি সেখানে বলেছেন, কে কোন সরকারের কথা বলছেন সেটা নাকি তাদের দেখার বিষয় নয়। তারা কাজ করবেন সংবিধানের নির্দেশনা অনুসারে।
আমাদের ধারণা, এ পর্যন্ত এসেই সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সদিচ্ছা প্রশ্নের মুখে পড়বে এবং তার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হবে। কারণ, তার পূর্ববর্তী অন্য সিইসিরাও একইভাবে ভাষার মারপ্যাঁচ খাটিয়ে যা কিছু বলেছেন সে সবের মধ্যে সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে। নতুন সিইসিও পূর্বসুরীদের পথেই হাঁটতে চাচ্ছেন কি না সে প্রশ্ন উঠবে সঙ্গত কারণে। বলাবাহুল্য, নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে সিইসির এই মনোভাব ও বক্তব্য সমস্যাকে আরো জটিল করবে বলেই আমাদের আশংকা।
একই কারণে আমরা মনে করি, সিইসির উচিত তার বক্তব্য প্রত্যাহার করা এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ জনসমর্থিত প্রধান দলগুলোর দাবি মেনে তার আলোকে পদক্ষেপ নেয়া। উল্লেখ্য, কমিশনের সঙ্গে ১২ জুন অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় অতীতের সকল নির্বাচন কমিশনারও ঘোষণা করেছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। শুধু তা-ই নয়, তারা একদিকে সব দলকে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালানোর তাগিদ দিয়েছেন, অন্যদিকে নিজেদের চাকরিকালীন অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে এত বেশি ধরনের লোকজন হস্তক্ষেপ করে যে, বর্তমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই সম্ভব নয়। সে কারণেও কেয়াটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা দরকার বলে আমরা মনে করি।