টুনটুনির গানে বন্ধুদের ঈদ

মোঃ আব্দুর রহমা
ম্যাডাম পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা এবার ঈদে কে কি কিনবে?’ এই প্রশ্নের উত্তরে রাজুর মুখটায় কাল বোশেখির মেঘ জমা হলো। ক্লাসের সব প্রশ্নের উত্তরে খই ফুটলেও এবার মুখে তালা পড়লো দরিদ্র কাজের বুয়ার ছেলে রাজুর। মৃদু সুরে বললেন, “আমার আগের বছরেরটা নতুন আছে ম্যাম।” ক্লাসে বয়ে গেলো এক পশলা হাসির বৃষ্টি ! অবশ্য ম্যাডামের চোখ রাঙানিতে সবাই থেমে গেলো। পরিবেশ সামাল দেয়ার জন্য ম্যাডাম বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে তুমি পরের ঈদে নেবে কেমন..”। একজন হাসির ছলে বললো, “ম্যাম ওতো গতবারও একই কথা বলেছিল।” এবার ম্যাডাম বললেন, “এমন করে বলতে হয় না ও তোমাদের বন্ধু। বন্ধুরা মনে কষ্ট পায় এমন কোন কথা বলতে নেই বাবা...।”
স্কুল ছুটির পর বোশেখ মাসের কাঠফাটা রোদে রাস্তার এক পাশ দিয়ে নীরবে একাকী হেঁটে চলেছে রাজু। আজ ওর প্রিয়বন্ধু আদর ডাকলো কিন্তু তবুও দাঁড়াতে চাইছে না। আদর বুঝলো ক্লাসের এমন ঘটনায় বেশ কষ্ট পেয়েছে বেচারা! আর পাবার কথাইতো! অবশেষে সানবাঁধানো স্কুলের পুকুর পাড়ে রোজকার মতো বসলো দু’জনে। তবে একদম বরফ পরিবেশ। একটা টুনটুনি ওদের মাথার উপরে টুইট টুইট মিষ্টি মধুর গান গাইছে। এই পরিবেশে বন্ধুকে চুপ থাকতে দেখে একটুও ভালো লাগছে না আদরের। লাগার কথাও নয়। কারণ এমনটা ওরা অভ্যস্তও নয়। হই হুল্লোড় আর চেঁচাচেচি ওদের নিত্যসঙ্গী। তাই কাছে এসে বন্ধুর হাত ধরার চেষ্টা করতেই, আদরকে জড়িয়ে ধরে অমনি কেঁদে ফেললো রাজু। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো, “তুমিতো জানো আমার বাবা অসুস্থ। আমার মা কাজের বুয়ার কাজ করে সংসার চালায়। আমাকেও খুব কষ্ট করে স্কুলে পড়ায়। সেখানে আমাকে কিভাবে নতুন কাপড় কিনে দিবে বল!” আদর সান্ত¡না দিয়ে বললো, “তুমি মন খারাপ করোনা রাজু, ওরা বুঝতে পারেনি, দেখবে ওরা ওদের ভুল বুঝতে পারবে। চলো আজ বাসায় যাই।”
দিন-রাতের হামাগুড়িতে ঈদের দিন আরো কাছে চলে আসলো। আজকেই স্কুল ঈদের বন্ধ দিবে। সবাই ক্লাসে আসলো। ক্লাসে একটা ঈদ ঈদ গন্ধ। কিন্তু, রাজু আসলো সবার পরে। কারো সঙ্গে কোন কথা নেই। কথা বলে পড়ার সুরে, তার চোখ আছে কলম এবং খাতায়। সবকিছু যেন সেদিনের পর রাজুর অচেনা হয়ে গেলো। রাজু হয়তো ধরেই নিয়েছে সে শুধু একজন বুয়ার ছেলে। ওর সাথে বাকীদের হিসাব চলে না। সব বন্ধুরা একে অপরকে দাওয়াত দিচ্ছে। কার কয়টা জামা হলো সেটা হিসেব করছে। তবে রাজুর কোন জামা নেই হিসাবও নেই!
রোজের মতো স্কুল ছুটি হলো, সাথে ঈদের বন্ধও পড়লো। রাজু সেই পুকুর পাড়ে একা একা বসে টুনটুনির টুইট টুইট গান শুনছে। আর ভাবছে আজ হয়তো প্রিয় বন্ধু আদর আসবে না। বাসায় যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। পিছনে ফিরে দেখে আদর এবং ওর ক্লাশের সব বন্ধুরা! আদর বললো, “ওদেরকে ক্ষমা করে দাও রাজু। ওরা ওদের ভুল বুঝতে পেরেছে।” উপর থেকে টুনটুনিগুলিও কিচিরমিচির করে উঠলো।
রাজু বললো, “না ঠিক আছে তোমরা আমার বন্ধু রাগ করবো কেন!” এবার আর একজন বললো, “ঠিক আছে তাহলে আমাদের সকলের পক্ষ থেকে এই পায়জামা-পাঞ্জাবিটা তোমার জন্য রইলো। এটা তোমাকে নিতেই হবে বন্ধু।” খুশিতে রাজু কেঁদে ফেললো এবং বন্ধুদের জড়িয়ে ধরলো। আর টুনটুনি গাইতে থাকলো টুইট টুইট গান।