বুধবার ২৯ মার্চ ২০২৩
Online Edition

“খলিফা” মানুষের শ্রেষ্ঠ মর্যাদার প্রতীক

জাফর আহমাদ:

মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। মানুষ সৃষ্টির ঊষালগ্নে আল্ল¬াহ তা’আলা এ নামেই মানুষকে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন,“নিশ্চয় আমি জমিনে খলীফা সৃষ্টি করবো। (বাকারা-৩০) আমি ‘মানুষ’ সৃষ্টি করতে চাই এ কথা বলা হয় নাই বরং ফেরেশতাদের সামনে মহামহিম আল্ল¬াহ তা’আলা তাঁর পরিকল্পনার কথা মানুষের শ্রেষ্ঠ মর্যাদার প্রতীক ও দায়িত্বশীলতার মহান গুণ ‘খলিফা’ নামে পেশ করেছিলেন। অর্থাৎ এ বিশাল ভুবনে মানুষ আল্ল¬াহর খলিফা। 

‘খলিফা’ মানে প্রতিনিধি ইংরেজীতে যাকে রিপ্রেজেন্টেটিভ বলা হয়। আমাদের দেশে যারা বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানিগুলোতে রিপ্রেজেন্টেটিভ এর চাকরি করেন, তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে ভালভাবে জানা থাকলে খলীফা শব্দটির আক্ষরিক ও ভাবার্থ দু’টিই বুঝতে সহজ হবে। রিপ্রেজেন্টেটিভ এর দায়িত্ব হলো’ মালিক যেহেতু তার প্রোডাক্টগুলোর গুণাগুণ ও ফলাফল বাজারে বাজারে ও দোকানে দোকানে গিয়ে মানুষকে বুঝানোর জন্য প্রতিনিধি বা রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগ দেন। তাদেরকে বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব দেয়া হয় যে, তার ঔষধগুলোর গুণাগুণ সম্পর্কে সংশ্লি¬ষ্ট এলাকার ডাক্তার ও ডিসপেনসারিগুলোকে অবহিত করবেন এবং এগুলো ক্রয় করার জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন। তদ্রƒপ মানুষও আল্লাহর প্রতিনিধি। তাদের দায়িত্ব হলো আল¬াহর হুকুম-আহকাম জমিনের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিবেন। আল্ল¬াহর হিদায়াতের বাণী তথা কুরআন অনুযায়ী মানুষের ব্যক্তি চরিত্র থেকে শুরু করে তাদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় চরিত্র গঠন করবেন।  

মানুষের জন্মগত এ দায়িত্ব থেকে কেউ রেহাই পেতে পারে না। বাধ্যতামূলক এ দায়িত্ব প্রত্যেক মানুষকেই পালন করতে হবে। কেউ যদি শুধুমাত্র ব্যক্তি জীবনে আল্ল¬াহর হুকুম পালন করে সন্তুষ্ট থাকেন তবে দায়িত্ব অবহেলার কারণে অবশ্যই তিনি খিয়ানতকারী বা বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন। মনে করুন যদি কোন রিপ্রেজেন্টেটিভ  কোম্পানির ২/১টি প্রোডাক্ট ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকে, অন্যের কাছে পৌঁছানোর মালিকের বাধ্যতামূলক ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটায় তবে এ ধরণের বিশ্বাসঘাতককে কোম্পানি  কি আদৌ চাকরিতে রাখবে? বরং যত দ্রুত সম্ভব তাকে চাকরি থেকে বিতাড়িত করাই হবে কোম্পানির মঙ্গল। ব্যাপারটি আরো মারাত্মক হবে যদি এ রকমটি  হয় যে, আল্লাহর হিদায়াতকে বাদ দিয়ে মানুষের মস্তিষ্ক তৈরী মতাদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজের শ্রম, মেধা ও সম্পদ ব্যয় করে। এটি হবে আরো বড় বিশ্বাসঘাতকতা এবং আল্ল¬াহর সাথে দৃষ্টতা প্রর্দনের শামিল। আশরাফুল মাকলুকাত মানুষ আল্লাহর সকল সুযোগ-সুবিধা তথা আলো, বাতাস, অ´িজেন, আবাসন, সহায়-সম্পদ ও জীবন ভোগ করে অন্যের আইন ও কানুন নিজে মানে আবার অন্যকে মানার দাওয়াত দেয়, কতবড় বিশ্বাসঘাতক তা কি কল্পনা করা যায়? আবারো সেই রিপ্রেজেন্টেটিভ  এর কথা সামনে এসে যায়। মনে করুন কোন রিপ্রেজেন্টেটিভ সংশ্লি¬ষ্ট কোম্পানির ঔষধ বিক্রি না করে  নিজের বা অন্যের তৈরীকৃত ঔষধ বিপনন করে বেড়ায়, অথচ সেই কোম্পানীর সুযোগ-সুবিধা সে নিয়মিত গ্রহণ করে চলেছে, বলুন, এ ধরণের রিপ্রেজেন্টেটিভ এর বিশ্বাসঘাতকতার জন্য শুধুমাত্র তার চাকরি   থেকে বহিষ্কার করাই যতেষ্ট হবে, না কি তাকে শাস্তি আওতায় আনা  ফরয হয়ে যায়। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।   

বিশাল আকাশের মালিক, বিস্তৃৃর্ণ জমিনের মালিক, চন্দ্র-সুর্য গ্রহ-নক্ষত্র ও বিশাল গেলাক্সির মালিক, আমাদের জীবন-জীবিকা ও হায়াত-মওতের মালিক, করূণা করে যেই মালিক আমাদের সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করে মর্যাদাপূর্ণ খলিফার দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করলেন, তাঁকে ভুলে কি করে মানুষ তার নিজের মর্যাদাকে ধূলায় লুটিয়ে দেয়? খলীফা কতবড় মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব তা কি কল্পনা করা যায়? কতবড় আমানতদার হলে এ ধরণের মর্যাদা দিয়ে আমাদের সৃষ্টি করেছেন। এ আমানতকে আল্লাহ তা’আলা অনেককে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দায়িত্ব নিতে অপরাগতা পেশ করলো, কিন্তু মানুষ এ বিশাল দায়িত্বকে নিজেদের স্কন্ধে তুলে নিলো। এ আমানতকে গ্রহণ করার পর কেউ যদি এটির খেয়ানত করে তবে তাকে নিরেট একজন খেয়ানতকারী বলা হবে। 

মানুষ সৃষ্টির সূচনালগ্নে আল্লাহ ও ফিরিশতাদের মধ্যে যে আলোচনা সংগঠিত হয়েছিল, এর মধ্যে আল্লাহ আরও একটি কথা ফেরেশতাদের বলেছিলেন সেটি হলো  “যখন তোমার রব ফিরিশতাদের বলেছিলেন, আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা বা প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাই। তারা বললো, আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চান যে সেখানকার ব্যবস্থাপনাকে বিপর্যস্থ করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে ? আপনার প্রশংসা ও স্তুতিসহকারে তাসবীহ পাঠ এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা তো আমরা করে যাচ্ছি। আল্লাহ বললেন, আমি জানি যা তোমরা জানো না।”(সুরা বাকারাঃ৩০) অর্থাৎ  শুধুমাত্র প্রশংসা ও স্তুতিসহকারে তাসবীহ পবিত্রতা বর্ণনা করাই যতেষ্ট নয়। বরং এর চাইতে আরো বেশী কিছু চাই যা আমি আল্ল¬াহ জানি, তোমরা যারা ফিরিশতা জানো না। সেটি হলো পৃথিবীতে আল্ল¬াহর প্রতিনিধি হিসাবে আল্ল¬াহরই ক্ষমতা-ইখতিয়ার প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি জাতি সৃষ্টি করার সংকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। 

আল্ল¬াহর রাসুল সাঃ কে প্রেরণ করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে  আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:“তিনিই তো তাঁর রাসুলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন, যেন এটিকে অন্যান্য সর্বপ্রকার বাতিল দ্বীনের উপর বিজয়ী করে দেন, তা মুশরিকদের যতই অসহ্য বা অপছন্দ হোক না কেন।” (সুরা আছ-ছফ-৯) পক্ষান্তরে ব্যক্তিগত ও সামাজিক শিক্ষা, সংশোধন বা পরিশুদ্ধির জন্য ইবরাহিম আঃ একজন রাসুল প্রেরণের দু’আ আল-কুরআনে এ ভাবে বিবৃত হয়েছে “হে আমাদের রব! এদের মধ্যে স্বয়ং এদের জাতিরই এমন একজন রাসুল পাঠাও যিনি এদেরকে তোমার আয়াত পাঠ করে শুনাবেন, এদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং জীবন পরিশুদ্ধ করবেন। অবশ্যি তুমি পরাক্রমশারী ও মহ্জ্ঞাানী।”( সুরা বাকারাঃ১২৯) 

পৃথিবীর প্রথম মহামানব থেকে শুরু করে পৃথিবীর শেষ অবদি যত মানুষ দুনিয়াতে আসবে তাদের প্রত্যকেই খলীফা বা দায়িত্বশীল। ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-যুবতী,  আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই আল্ল¬াহর প্রতিনিধি। প্রত্যেকেই যার যার প্ল¬াটফর্ম থেকে একটি মিশনকে সফল করার দায়িত্ব পালন করতে হবে। রাসুল স: বলেছেন ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, তোমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে কিয়ামতে জিজ্ঞাসিত হবে।” আল্ল¬াহর একজন দায়িত্বশীল হিসাবে তাঁর কাছ থেকে যেই হিদায়াত আমাদের কাছে আছে, তা আল্ল¬াহর এ জমিনে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেই দায়িত্ব হলো ‘পৃথিবীর অসংখ্য খোদার নাগপাশ থেকে সমাজ ও সভ্যতাকে মুক্ত করে এক আল্ল¬¬াহর গোলামে পরিণত করা। এটিই ছিল সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামের মিশন। তাঁদের মৌলিক কাজ কি ছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উপরে উল্লে¬খিত সুরা ছফের ৯ নং বলেছেন। আল্ল¬াহ আরো বলেন:-“ আল্ল¬¬াহ তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা দ্বারা পরকালের ঘর বানিয়ে নাও, দুনিয়ার হিসেবকেও ভুলোনা এবং আল্ল¬-াহ তোমাদের প্রতি যেরূপ  অনুগ্রহ করেন তোমরাও অনুরূপ অনুগ্রহ প্রদর্শন করবে।”(সুরা কাসাস ঃ ৭৭)    

আল্ল¬¬াহ তা’আলা বলেন:- “আল্ল¬¬াহ তোমাদের জন্য সেই দীনই নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা নুহকেও নির্দেশ করা হয়েছিল আর তোমার কাছেও যার অহী করেছি এবং যার নির্দেশ করা হয়েছিল ইবরাহিম, মুসা এবং ঈসাকেও। বলা হয়েছিল: দীনকে কায়েম করো এবং এ বিষয়ে মতবিরোধ করো না।”(সুরা শুরা ঃ ১৩) দীন কায়েম করাকে আল-কুরআনে মৌলিক কাজ হিসাবে বর্ননা করা হয়েছে। যেমন আল্ল¬¬াহ তা’আলা বলেন “হে নবী বলো: হে আহলে কিতাব! তোমরা কিছুতেই কোন মৌলিক জিনিসের উপর নেই, যতোক্ষণ না তোমরা কায়েম করবে তাওরাত, ইনজীল এবং তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ অন্যান্য কিতাবাদি।”(আল কুরআন ঃ ৬৮) এটিই দুনিয়ার অতীব উত্তম কাজ, এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে মহাসাফল্য এবং প্রকৃত কল্যাণ। আল্ল¬¬াহ রাব্বুল আলামীন বলেন,“হে ঈমানদার লোকেরা! আমি কি তোমাদের এমন একটি ব্যবসার কথা বলবো, যা তোমাদেরকে পীড়াদায়ক আযাব থেকে রক্ষা করবে ? (তা হলো) তোমরা ঈমান আনবে আল্ল¬¬াহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি। আর আন্দোলন করো আল্ল¬¬াহর পথে নিজেদের ধন সম্পদ ও জীবন প্রান দিয়ে। এটাই তোমদের জন্য অতীব উত্তম, যদি তোমাদের জ্ঞান থাকে।  (এর ফলে) আল্ল¬াহ তোমাদের গুণাহ সমুহ মাফ করে দিবেন এবং এমন সব জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে ঝর্ণাধারা সদা প্রবাহমান। চিরকালের এ জান্নাতে অতি উত্তম ঘর দান করবেন। এটাই মহা সাফল্য। আর অন্য যা তোমরা ভালবাস, তাও তোমাদের দিবেন, (তা হলো) ‘আল্ল¬¬াহর সাহায্য’ আর ‘নিকটবর্তী বিজয়’। হে নবী মুমিনদেরকে এর সুসংবাদ দাও।” (সুরা আস সফ ঃ ১০-১৩} 

প্রতিটি মুসলিমকে আল্ল¬াহর খলীফা হিসাবে দীন কায়েমের কাজকে জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যে পরিণত করতে হবে। এ সম্পর্কে  আল্ল¬¬াহর বাণী:-“অতএব সঠিক দীনের প্রতি তোমার লক্ষ্য কায়েম কর, আল্ল¬াহর পক্ষ থেকে সে দিন আসার আগে, যার প্রতিরোধ ক্ষমতা কারো নেই। সেদিন লোকেরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।”(সুরা রূম ঃ ৪৩)

খলিফার দায়িত্ব থেকে যেদিন বিশ্বমুসলিম জোর করে নিজেদেরকে অব্যাহতি দিয়েছে, সেদিন থেকেই বিশ্বব্যাপী তাদের মর্যাদা ভুলুন্ঠিত হতে শুরু করেছে। নেতৃত্বের আসন থেকে তারা এমনভাবে ছিটকে পড়েছে, যেমনি তীর থেকে ধনুক ছুটে চলে কোন অজানা গন্তব্যে। ফলে তারা আজ পৃথিবীর পশ্চাৎপদ জাতিতে পরিণত হয়েছে। এই সুযোগে পৃথিবীর তাবৎ তাগুতি শক্তি তাদের ওপর চারদিক থেকে ঝাপিয়ে পড়ে। লাঞ্ছনা-গঞ্ছনা আজ মুসলিমদের স্থায়ী বিষয় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। পরাজিত মানসিকতার কারণে তারা আজ প্রতিবাদের সকল ভাষাও ভুলে গেছে। নিজেদেরকে চিনতে পারিনি বলে, অধপতিত এই পরিস্থিতি থেকে বেরুবার সকল পথও তারা হারিয়ে ফেলেছে। অথচ তারা কখনো চিন্তা করে দেখেনি যে, তারা কোন মহাশক্তিধর পরাক্রমশালী  মহান সত্তার খলিফা বা প্রতিনিধি। কতবড় মর্যাদা দিয়ে তাদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। এই করুণ পরিণতি থেকে পূণত্থিত হওয়ার জন্য প্রথমত নিজেদের মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে ভালভাবে ওয়াকিবহাল হতে হবে। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ