বুধবার ২৯ মার্চ ২০২৩
Online Edition

রাসূলুল্লাহ (স) এর প্রচার ও যোগাযোগ মাধ্যম

মাওলানা মুহাম্মাদ যাইনুল আবেদীন

বিশ^ মানবতার কাছে আল্লাহ তাআলার সর্বজনীন বিধানের দাওয়াত পৌঁছাতে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরিত হয়েছেন। মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ রাসূল। নাযিলকৃত সকল বিষয় ‘তাবলীগ’ তথা পূর্ণভাবে প্রচারের ব্যাপারে তিনি আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছেন এবং তিনি তা হক আদায় করেই করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে সাহাবায়ে কিরামকে সাক্ষী বানিয়েছেন এ ব্যাপারে। জিজ্ঞাসা করেছেন: ‘আলা হাল বাল্লাগতু’ আমি কি যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছি? উপস্থিত জনতা তাঁর প্রশ্নে ইতিবাচক রব তুলেছেন। কোনো বিষয়ে কিছু না বলার অভিযোগ কেউ করেনি। রিসালাতের কথাগুলো ব্যক্তি ও সমষ্টির কাছে প্রচারে তিনি কোনোরূপ কার্পণ্য করেন নি। বরং তিনি পেরেশান ছিলেন। অকল্যাণের সব রাস্তা বন্ধ করে মানবতার দুয়ারে সকল কল্যাণ পৌঁছে দিতে তিনি আকুল-ব্যাকুল প্রাণ ছিলেন। তাই তিনি কুরআনের ভাষায় ‘হারীস’ ‘রাউফ’ ও ‘রাহীম’। সেই পেরেশানীর কারণে দ্বীনের আহবান প্রচারে তিনি সম্ভাব্য বৈধ সকল মাধ্যম ব্যবহার করেছেন। বর্তমান সময়ের আধুনিক কোনো উপকরণই তখন ছিলো না। কিন্তু নবীজীর অবলম্বিত সে মাধ্যমগুলো ছিলো দারুণ প্রভাবক ও সর্বব্যাপী। ব্যক্তি ও সমষ্টির কাছে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছাতে এবং সে লক্ষ্যে আম জনতার সাথে যোগাযোগ স্থাপনে আল্লাহর রাসূল যে সকল উপায় অবলম্বন করেছেন তার উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হবে।

মাক্কী জিন্দেগী:

মক্কায় নবুওয়াতের তেরো বছরে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত কঠিন সময় পার করেছেন। কাফির মুশরিকদের অব্যাহত বিরোধিতা, দমন-পীড়ন, মুসলিমদের সংখ্যায় স্বল্পতা, প্রতিরোধে অক্ষমতা, সর্বোপরি একটি পূর্ণ বিপ্লবের ধারাবাহিক সফলতাকে সামনে রেখে রাসূল যে কর্মধারা অনুশীলন করেছেন তার উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরছি। 

ক. ব্যক্তি পর্যায়ে যোগাযোগ: নবুওয়াত পেয়েই আল্লাহর রাসূল ব্যক্তিগতভাবে লোকেদের নিকট সরাসরি ছুটে গিয়েছেন। ব্যক্তিগত আস্থা ও বিশ^াসকে পুঁজি করে কথা বলেছেন। আবু বকর, আলী, যায়েদ সে প্রক্রিয়ায় রাসূলের আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। নতুনরাও একই ধারা অনুরসরণ করে ইসলামের বক্তব্য অন্যদের নিকট প্রচার করেছেন। ধীরে ধীরে সত্যের মিছিল হয়েছে বড়।

খ.দরদী নবীর দাওয়াতী সমাবেশ: মানব দরদী নবী সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষায় আরবদের ‘উলঙ্গ সতর্ককারী’র ন্যায় পেরেশান হয়ে কথা বলেছেন মানুষের সমাবেশে। ইবনে আব্বাস থেকে বুখারীর বর্ণনায় জানা যায়, ‘ওয়াআনযির আশীরাতাকাল আক্বরাবীন’ এ আদেশ পেয়ে নবীজী সাফা পাহাড়ে উঠে সমবেত লোকদের উদ্দেশে দারুণ দরদের সাথে কথা বলেছেন। বেআড়া মানুষগুলোকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছেন।

গ. ভোজসভা: মক্কার বনু হাশিমের লোকদের নিকট হৃদয়গ্রাহী করে প্রাণবন্ত পরিবেশ তৈরি করতে আল্লাহর রাসূল তাদেরকে নিয়ে ভোজসভার আয়োজন করেছেন। সে সভায় তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছেন।

ঘ. জানবাজ প্রচারক প্রতিনিধি দল: আল্লাহর রাসূলের নিকট অবতীর্ন কুরআনের বাণী সঙ্গোপনে নতুনদের কাছে পৌঁছানের জন্য একদল কর্মীবাহিনী তিনি পেয়ে গেলেন। তারা অবতীর্ন একেকটি আয়াত অন্যদেরকে শিখানোর জন্য নতুন মুসলিমদের কাছে ছুটে বেড়াতেন। 

ঙ. জনসমাবেশে প্রকাশ্য কুরআন তিলাওয়াত: তাফসীরে রাজীর বর্ণনায় জানা যায়, সূরা আর রহমান নাযিল হলে আল্লাহর রাসূল উপস্থিত সাহাবীদের বললেন, কে গিয়ে কাফির নেতাদের এ সূরা শুনিয়ে আসতে পারবে? ইবনু মাসউদ ছাড়া কেউ রাজি হলো না। তৃতীয়বারও তিনিই দাঁড়ালে আল্লাহর রাসূল তাঁকে অনুমতি ছিলেন। কাবার চতুর্পাশে সমবেত কাফিরদের তিনি সূরাটি পড়ে শুনালেন। আবু জাহল এগিয়ে এসে তাঁকে থাপ্পড় দিলো। তার কান ফেটে রক্ত বের হলো। নবীজী খুবই ব্যথিত হলেন। 

চ. নিরাপদ প্রচার কেন্দ্র বাইতুল আরকাম: প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজ তখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লো। আল্লাহর রাসূল দ্বীনের প্রচারের জন্য তরুণ সাহাবী আরকাম ইবনু আবিল আরকামের বাড়িকে তাবলীগ, তালীম ও তারবিয়াতের নতুন ঠিকানা বানালেন। গোপনে সাহাবায়ে কিরাম সে বাড়িতে রাসূলের সাথে মিলিত হতেন। ঐতিহাসিক সে বাড়িতেই উমার রা. ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। 

ছ. আবেগাকুল তায়েফ সফর: মক্কার মানুষের আচরণে আল্লাহর রাসূল ব্যথিত হলেন। তাই বলে তিনি দ্বীনের প্রচার কাজে দমে যান নি। সশরীরে ছুটে গেলেন পরম আকাক্সক্ষা নিয়ে তায়েফ নগরীতে। কঙ্করাকীর্ণ মরু পথ পাড়ি দিয়ে আল্লাহর রাসূল রক্তে রঞ্জিত হয়ে ফিরে এলেন। প্রচার কাজে মহানুভবতার অবিস্মরণীয় নজীর স্থাপন করে আসলেন।

জ. গোপন সমাবেশ: রাসূলুল্লাহর প্রচার কাজ নিছক প্রচার ছিলো না। এ ছিলো মহাবিপ্লবের প্রস্তুতি। সে কারণেই আল্লাহর রাসূল তাঁর নজর ছুটালেন মক্কার বাহিরে অন্য গোত্রগুলোর দিকে। হজের মওসুমকে কাজে লাগালেন। আকাবা নামক এলাকায় মদীনার আওস ও খাজরায এর প্রতিনিধিদের সমাবেশে মিলিত হলেন। দাওয়াত দিলেন। শপথও করালেন। নতুন বিপ্লবের দ্বার উন্মোচিত হলো। 

ঝ. দা‘য়ী ও প্রশিক্ষক দূত প্রেরণ: আকাবার শপথের পরেই আল্লাহর রাসূল মদীনাবাসীর প্রথম শিক্ষক হিসাবে নওজোয়ান সাহাবী মুসআব ইবনু উমায়ের রা.কে পাঠান। হিজরাতের এক বছর আগে থেকে দ্বীন প্রচারে এবং আগামীর সোনালী সমাজ গঠনে জনমত তৈরিতে তিনি রাসূলল্লাহর যোগ্য প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন। 

মাদানী অধ্যায়: 

মদীনায় আল্লাহর রাসূলের হিজরতে মধ্য দিয়ে নতুন বিপ্লব সূচিত হলো। দৃশ্যপট বদলে গেলো। গোপন দাওয়াত, লুকানো দাওয়াতী কেন্দ্র, মধ্যরাতের জরুরি সমাবেশ- দাওয়াত সম্প্রসারণের এ সব কর্মসূচিতে পরিবর্তন আসলো। দ্বীনের প্রচার কাজে নতুন মাত্রা যোগ হলো। আমরা এবার  সোনালী সে অধ্যায়ে আল্লাহর রাসূলের মিশন প্রসারের ও জনগণের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে কিছু উল্লেখযোগ্য মাধ্যম নিয়ে কথা বলবো।

ক. মাসজিদে নববী: বিশ^ব্যাপী ইসলামের বাণী প্রচার ও প্রসারে আল্লাহর রাসূলের হাতে নির্মিত মসজিদে নববীর ভূমিকা অনন্য ও অদি¦তীয়। হিজরাতের পর থেকে খিলাফতে রাশেদার অধিকাংশ সময় পর্যন্ত এ মসজিদই ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসাবে বিবেচিত ছিলো। এ মসজিদ থেকেই আল্লাহর রাসূল তাঁর সকল নবুওয়াতি সিদ্ধান্ত পেশ করতেন।

খ. জুমুআর খুতবা: নতুন ইসলামী দুনিয়া বিশেষত সমগ্র মদীনার সাধারণ মুসলমানদের সাপ্তাহিক মিলনমেলা ছিলো জুমুআর দিন। মসজিদে নববীতেই আল্লাহর রাসূল জুমাআর খুতবা দিতেন। এ খুতবার মাধ্যমেই ইসলামের সুমহান বাণী সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তো। 

গ. আজান: ইসলামী ইবাদাতের প্রধান আনুষ্ঠানিকতা হলো সালাত। সে সালাতের আহবান জনগণের কানে পৌঁছাতে আল্লাহর রাসূল আজানের পদ্ধতি চালু করেন। বিভিন্ন উপলক্ষে মসজিদে নববীতে একত্রিত হওয়ার জন্য মসজিদে নববী থেকে আওয়াজ উঠতো।

ঘ. ইসলামী মিম্বার: আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর খুতবার পরিবেশকে আরো প্রভাবক করে তোলার জন্য মিম্বার তৈরি অনুমোদন করলেন। সেই থেকে ইসলামী দুনিয়ায় জনগণের সামনে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য মিম্বার এক ঐতিহাসিক মাধ্যম।

ঙ. রাষ্ট্রকাঠামো: মদীনায় হিজরাত করে মদীনার সনদ তৈরির মাধ্যমে আল্লাহর রাসূল একটি আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর গোড়াপত্তন করেন। সে রাষ্ট্রকাঠামোর সকল আয়োজন দা‘য়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। ইসলামের সুমহান বাণী প্রচারে ও প্রসারে রাষ্ট্র হলো সহায়ক। 

চ. রাজা-বাদশাহদের নিকট চিঠিপত্র প্রেরণ: ইসলামের সুমহান আদর্শকে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে দিতে আল্লাহর রাসূল সরাসরি দূত পাঠিয়ে দুনিয়ার বড় বড় রাজাদের ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিয়েছেন। 

ছ. বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরণ: আল্লাহর  রাসূল বিভিন্ন বার্তা পৌঁছাতে আনাস রা. এর মতো সাহাবাদের পাঠাতেন। তাছাড়া উপযোগি এলাকায় রাসূল আধুনিক যুগের গভর্ণরের মর্যাদায় প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। মুআজ রা.কে ইয়ামানের একাংশের শাসক হিসাবে প্রেরণ করেন। 

মানবতার মহান শিক্ষক আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মহান শিক্ষক। আমাদের জন্য পরিপূর্ণ আদর্শ। বিজয়ের আগে পরে কীভাবে একটি আদর্শকে দুনিয়াময় ছড়িয়ে দিতে হয় তার কার্যকর ও পূর্ণাঙ্গ নমুনা তিনি আমাদের জন্য পেশ করেছেন। বর্তমান দুনিয়ার মতো অনেক আধুনিক উপায় উপকরণ আল্লাহর রাসূলের নিকট ছিলো না। কিন্তু নবুওয়াতী মিশনের পূর্ণতায় একদল মিশনারী জানবাজ সাহাবীকে নিয়ে তাঁর কর্মধারা ছিলো নিখুঁত ও নিখাদ। যার কারণে বিশ^ পেলো এক কালজয়ী চিরন্তণ আদর্শ। সে আদর্শ বুকে লালন করে যারা কাজ করেন, তারাও যদি সে রকম নিখাদ পদক্ষেপ নিয়ে এগুতে পারেন, আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতে পারেন, তবে উপায়-উপকরণের কিছু ঘাটতি থাকলেও তাদের হাত ধরে সত্যের বিজয় অবশ্যম্ভাবী ইনশাআল্লাহ। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ