বুধবার ২৯ মার্চ ২০২৩
Online Edition

মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যায় মুসলিম অবদান 

ড. ইকবাল কবীর মোহন:

মানচিত্র তৈরির কলাকৌশল ও বিজ্ঞানকে বলা হয় মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যা। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এর শুরু। তখন মানুষ চামড়া, হাড়, পাথর ইত্যাদির ওপর সহজ সরল চিত্র ও রেখা আঁকত। তখন তো আধুনিক কালের মতো কাগজ এবং অন্যন্য উপাদান ছিল না। মানচিত্রাঙ্কন বিজ্ঞানের ইতিহাসের চরম বিকাশ সাধিত হয় অষ্টম থেকে সতেরোশ শতকের মধ্যে। আর এ সময় সারা দুনিয়ায় শত শত মুসলিম মানচিত্রাঙ্কনবিদ জন্মগ্রহণ করেন এবং তাদের হাত ধরে মূলত আধুনিক মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যার পথচলা শুরু হয়। এসব মুসলিম মানচিত্রাঙ্কনবিদরা মানচিত্র তৈরির কৌশল ও দক্ষতায় বিপ্লব সাধন করেন। এই সময়ের মধ্যে মুসলিম মানচিত্রাঙ্কনবিদরা পৃথিবীসম্পর্কিত এবং (সাগরবিষয়ক) নাবিকদের জন্য আধুনিক মানচিত্র তৈরি করতে সক্ষম হন এবং মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার ইতিহাসের উৎকর্ষ সাধন করেন।  মুসলিম প-িতদের এই সুবিশাল অর্জন ও অবদান মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিজ্ঞানের পথকে সহজই করেনি, বরং পরবর্তী শতকে ইউরোপের মানচিত্র বিজ্ঞানের দিগন্ত উম্মোচন করেছে। 

মুসলিম মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার ইতিহাস

প্রাক ইসলামিক যুগে মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যা আরবে কল্পনা বা দর্শনগত অবস্থায় বিরাজমান ছিল। তবে সাত শতকের দিকে ইসলামের আগমন এবং পরবর্তী সময়ে আরব উপদ্বীপে এর বিকাশের সাথে সাথে মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যারও অগ্রগতি শুরু হয়। আট শতকে কাগজ আবিষ্কারের ফলে মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার ক্ষেত্রেও আসে বিরাট পরিবর্তন। এ সময় মুসলিম মানচিত্রাঙ্কনবিদরা গ্রিক, ব্যবিলনীয় এবং ভারতীয় সংস্কৃতির ভিত্তিতে কল্পিত এবং পাঠসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা, মানচিত্রের ধারণার চিত্র, অঙ্কন ইত্যাদি কাগজের পাতায় পাতায় স্থানান্তর করেন। এরপর থেকে শুরু হয় মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার সফল যাত্রা। নবম শতকের মধ্যে মুসলিম ব্যবসায়ী, নাবিক এবং উদ্ভাবকেরা ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয় এবং পূর্ব জাভা থেকে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের মাদাগাসকারের পশ্চিম  হয়ে চীন, জাপান ও কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়েন। ফলে এই এলাকা সম্পর্কে তাদের সরাসরি অভিজ্ঞতা এবং বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে আফ্রিকা উপকূল, ভারত মহাসাগর এবং দূর প্রাচ্য নিয়ে মুসলিম মানচিত্রাঙ্কনবিদরা তাদের মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার আরও বিকাশ এবং উন্নয়ন ঘটান। দশম শতকে এসে মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যা একটি নতুন আঙ্গিক লাভ করে। তখন থেকে সামনের দিনগুলোতে মুসলিম মানচিত্রাঙ্কনবিদরা তাদের তৈরি মানচিত্র বিভিন্ন ভ্রমণ গাইড, নৌ মানচিত্র এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনায় সন্নিবেশ করেন। ফলে ইসলামিক দুনিয়ার সর্বত্র বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং ভারতে এই মানচিত্র ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়। 

তের শতকের পর থেকে মুসলিম মানচিত্রাঙ্কনবিদদের এসব মানচিত্র কপি হয়ে মুসলিম বিশে^র বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। আর এই জনপ্রিয় মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যা একটি ‘ইসলামিক মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার আ্যাটলাস তৈরিতে সাহায্য করে, যেখানে বিভিন্ন মানচিত্রাঙ্কনবিদদের বেশ কয়েকটি মানচিত্র স্থান পায়। ইসলামী বিশে^র বিভিন্ন লাইব্রেরিতে এসব মানচিত্র স্থান পায় এবং ওইসব লাইব্রেরির মাধ্যমে অষ্টম থেকে চৌদ্দ শতকের মধ্যে এই মানচিত্রগুলো সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। 

মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার পরবর্তী উন্নয়ন সাধিত হয় তুর্কীদের আমলে অর্থাৎ ওসমানীয় খলিফাদের শাসনামলে। তখন থেকে মুসলিম মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার প্রতি ইউরোপের ঝোঁকপ্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ফলে চৌদ্দ থেকে ষোলো শতকের মধ্যে মুসলমানদের এই অর্জন তারা করায়ত্ত করে। মুসলমানদের অত্যন্ত সঠিক ও নির্ভুল মানচিত্রগুলো কাজে লাগিয়ে তারা  পরবর্তীকালে বাকি বিশে^র জন্য তৈরি করে মানচিত্র। এভাবে মুসলিম মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার উন্নয়ন ও বিকাশ সাধিত হয়

ইসলামিক মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার অর্জন

প্রাথমিকভাবে মুসলিম মানচিত্রাঙ্কনবিদরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে সফলতা অর্জন করেন, তার মধ্যে রয়েছে- ভৌগলিক গবেষণামূলক আলোচনাগ্রন্থ রচনা, পৃথিবীসম্পর্কিত মানচিত্র, সাগরবিষয়ক মানচিত্র এবং পোরটোলান মানচিত্র।   

গবেষণামূলক আলোচনাগ্রন্থ

ইসলামের প্রাথমিক সময়ে ডায়েরি, ভ্রমণ নির্দেশিকা প্রচুর পরিমাণে লেখা হয়, যার সাথে ইসলামী দুনিয়া এবং বিশে^র অন্যান্য সমাজের সাধারণ ভৌগোলিক বর্ণনা সন্নিবেশিত হয়েছিল। তখন মুসলিম মানচিত্রবিদরা অনেক গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেন। এর কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলো।

১. কিতাব সুরাত আল-আরত (পৃথিবীর চিত্রের বই) : পারস্যের খ্যাতনামা প-িত আল-খাওয়ারাজমি নবম শতকে তা রচনা করেন। এই পুস্তকে ৫৪৫ শহরের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের তালিকা প্রকাশিত হয়। এতে সাগর, নদী, পর্বতমালা, দ্বীপ এবং বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের বর্ণনা সন্নিবেশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে আরব মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার আলোকে চারটি আঞ্চলিক মানচিত্রও যুক্ত হয়। 

২. কিতাব আল মাসালিক-ওয়াল-মামালিক (সড়ক ও রাজত্বের বই) : মুসলিম বিশে^র প্রশাসনিক এবং ক্রমবর্ধমান পোস্টাল সার্ভিসকে সামনে রেখে এই পুস্তকটি লেখা হয়। পরে এটিতে ভৌগোলিক বিষয়গুলো যুক্ত করে মুসলিম বিশে^র অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আলোচনাসহ অমুসলিম বিশ^ তথা ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিবরণ প্রকাশ করা হয়। দশম শতকে বিখ্যাত ভূগোলবিদ এবং বাগদাদের সরকারি পোস্টাল সার্ভিসের পরিচালক ইবনে খুরাদাদবিহ এই গ্রন্থ রচনা করেন। এতে তিনি আরব বিশ^, চীন, কোরিয়া ও জাপানের বাণিজ্য পথ নির্দেশ করেন। পরবর্তীকালে অন্যান্য মুসলিম প-িতরা তাদের ভৌগোলিক কর্মে একই নাম ব্যবহার করেন এবং আল-বাকরি ও আল-ইসতাখারী নাম দুটি যুক্ত করেন। 

৩. দশম শতকের জনপ্রিয় ভৌগোলিক আলোচনাগ্রন্থ ছিল আল-মুকাদ্দিসীর ‘আহসান আল-তাকাসিম ফি মারিফাত আল-আকালিম (আঞ্চলিক জ্ঞানের সেরা বিভাগ), যার মাধ্যমে মুসলিম ভূগোলবিদ্যার পদ্ধতিগত ভিত্তিমূল রচিত হয়। এই বইয়ে  আল-মুকাদ্দিসী  ভৌগোলিক পরিভাষা, পৃথিবীর বিভিন্ন বিভাগপদ্ধতি এবং প্রায়োগিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।  

৪. এগারো শতকে রচিত হয় ‘কিতাব গারেইবাল ফানুনওয়া-মুলাহ-আল-ইউউন (চোখের বিজ্ঞান ও মার্বেলবিষয়ক দুর্লভ বই) গ্রন্থ। বইটিতে ইসলামি ভৌগোলিক ধারণা এবং মহাজাগতিক বিষয়সহ মানচিত্র তৈরির সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরা হয়। 

৫. বারো শতকে আল-ইদরিসি ‘কিতাবনুজহাত আল-মুশতাকফিকাতিরাক আল-আফাক’ নামীয় গ্রন্থটি রচনা করেন। মুসলিম ভৌগোলিক এবং মানচিত্রাঙ্করবিদদের ওপর একটি অনবদ্য আলোচনাগ্রন্থ। এই গ্রন্থ রচনায় সিসিলির রাজা নরম্যানের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। এই বইটি মূলত একটি আ্যাটলাস (ভূচিত্রাবলি) যাতে পৃথিবীকে একটি ভূগোলক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে গোলার্ধ, জলবায়ু এবং সাগরের বর্ণনাও রয়েছে। বইটিতে একটি গোলাকার বিশ^ মানচিত্র এবং সত্তরটি আংশিক মানচিত্র সংযুক্ত রয়েছে। 

ইসলামি মানচিত্র

মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার ক্রমবিকাশে ইসলামি মানচিত্রকলা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। প্রাথমিক ইসলামি মানচিত্রগুলো আঁকা হয়েছিল ওপরের দিকে দক্ষিণমুখী এবং নিচের দিকে উত্তরমুখী করে। এসব মানচিত্রের মাধ্যমে মুসলিম মানচিত্রাঙ্কনবিদ এবং তাদের সাহায্যদাতারা বিশ^ সম্পর্কে গভীর ও মূল্যবান অর্ন্তদৃষ্টি ও ধারণা দিতে সক্ষম হন। আর এই ধারণা বিশ^চরাচরে ছড়িয়ে দিতে সফল হন। এই মানচিত্রগুলোর প্রাথমিক দৃষ্টিকোণ ছিল বিশে^র অন্যান্য অংশের সাথে মক্কার অবস্থান প্রকাশ করা। এর সাথে সাথে এই মানচিত্রে উপকূলীয় রেখা, বাণিজ্য পথ এবং অন্যান্য ভৌগোলিক বিস্ময় চিত্রিত করা হয়। নিচে এরূপ কয়েকটি বিখ্যাত মানচিত্র নিয়ে আলোচনা করা হলো।

১. ইসলামি বিশে^র অতীতের পুরোনো মানচিত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় পারস্যের খ্যাতনাম প-িত আল-খাওয়ারাজমির ‘কিতাব সুরাত আল-আরত’ পা-ুলিপি থেকে। এই কিতাবে ৫৪৫ শহরের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের তালিকা প্রকাশিত হয়। এতে সাগর, নদী, পর্বতমালা, দ্বীপ এবং ভৌগলিক অঞ্চলের বর্ণনা সন্নিবেশ করা হয়। এতে যে চারটি আঞ্চলিক মানচিত্রের একটি ভৌগোলিক আলোচনা স্থান পায়। এই পা-ুলিপিতে নীল পদের মানচিত্রও প্রকাশিত হয়। আর এই পা-ুলিপি শতকের পর শতক ধরে একটি আদর্শ উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।

২. খলিফা আল-মামুনের সময় যে মানচিত্র রচিত হয় তাতে ইউরোশিয়া এবং আফ্রিকার বিশাল উপকূলীয় রেখা এবং অধিকাংশ সাগরের চিত্র দেখানো হয়। এতে ভারত মহাসাগর এবং আটলাণ্টিক মহাসাগরের চিত্র প্রদর্শিত হয়। 

৩. ‘বালকি স্কুল’-এর পৃথিবীসংক্রান্ত মানচিত্রে এতে দশম শতকের চারজন মুসলিম ভৌগোলবিদের মানচিত্র তৈরির ঐতিহ্য প্রকাশিত হয়। এই মানচিত্রবিদের নাম  আবু জায়েদ আহমাদ ইবনে সাহল আল বালকি। তার সাথে তাঁর অনুসারীদের নামও যুক্ত হয়। তারা হলেন-আল-ইসতাখারী, ইবনে হাওকাল এবং আল-মুকাদ্দিসী। এসব প-িতগণ মিলে বিশ^ ভূচিত্র (আ্যাটলাস) তৈরি করেন। প্রত্যেকে একটি বিশ^ ভূচিত্র তৈরি করেন এবং তাতে একুশটি আঞ্চলিক মানচিত্র ছিল। আল-বালকির একটি পুস্তক ‘সোয়ার আর-আকালিম’ (সচিত্র জলবায়ু)। এতে আরব, ভারত মহাসাগর, মিসর, সিরিয়া, ম্যাডেটারিয়ান সাগর এবং ইসলামি বিশে^র অন্যান্য স্থানের মানচিত্র প্রকাশিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত এই গ্রন্থটি কালের চক্রে হারিয়ে গেছে। তবে এর কপি করা মালমসলার সামান্য তার অনুসারীগণ সংরক্ষণ করতে পেরেছেন। 

বিখ্যাত ভৌগোল ও জ্যোর্তিবিদ আল বেরুনির একটি কিতাব হলো ‘কিতাব আল-তাফহিমলি আউয়াইলসিনাত আল-আনজিম (জোতিষকলার নীতিমালা বিষয়ক বই)। এটিতে বিশে^র একটি গোলাকার মানচিত্র প্রকাশিত হয়। এতে আফ্রিকার পূর্বদিকের অবস্থান কমিয়ে ভারত মহাসাগরের পুরোটা দেখানো হয়।    

৪. এগারো শতকে তুর্কী প-িত মাহমুদ আল-কাসগারলি ‘দিওয়ানলুগাত আল-তুর্কী’ নামীয় একটি আরব-তুর্কী ডিকশনারী প্রকাশ করেন। এতে তুর্কী অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতীর চিত্র প্রদর্শন করা হয়। 

৫. আল-ইদরিসির ‘তাবুলা রোজারিয়ানা’ বিশে^র একটি মানচিত্রই ছিল না, এটি ছিল গবেষণালব্ধ একটি সচিত্র ভৌগোলিক মহৎ শিল্পকর্ম। এই মানচিত্রে বিশ^কে একটি গোলক হিসেবে দেখানো হয় এবং একে ৭০টি বিভিন্ন  আয়তক্ষেত্রকার অঞ্চলে ভাগ করা হয়। আল ইদরিসির এই মানচিত্রকে প্রকৃত অনুকরণীয় বিশ^ মানচিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে পূর্বের ইসলামি বিশে^র তুলনায় পশ্চিম ইসলামি বিশ^কে ভালোভাবে প্রদর্শন করা হয়। 

আরব সমুদ্র মানচিত্র এবং পোরটোলান মানচিত্র

আরব মানচিত্রাঙ্কন বিদ্যার শুরু হয় নৌ মানচিত্রের মাধ্যমে। ইসলামি বিশ^ আরবীয় উপকূল হয়ে ম্যাডেটারিয়ান সাগর থেকে আটলাণ্টিক সাগর, রেড সী, অ্যারাবিয়ান সাগর ও পারসিয়ান উপসাগর থেকে ভারত মহাসাগর এবং প্যাসিফিক মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এসব অঞ্চলের জন্য সাগরের মানচিত্র প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এর জন্য এই অঞ্চলের উপকূলের গঠনপ্রকৃতি এবং এই এলাকার বাতাস ও আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য জানা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মানচিত্র তৈরির প্রয়াস শুরু হয়। দশম শতকে মানচিত্রাঙ্কনবিদ আল-মুকাদ্দিসি সাগর মানচিত্র তৈরি করেন। অন্যদিকে তেরো শতকের দিকে ইতালিয়ান উদ্ভাবক মারকো পলোও মানচিত্র তৈরি করেন। তেরো শতকের শেষ থেকে যেসব সাগর মানচিত্র নাবিকরা  ম্যাডেটারিয়ান সাগর এবং ব্লাক সীতে ব্যবহার করতেন সেগুলো ‘পোরটোলান মানচিত্র’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যদিও এসব মানচিত্র  শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরব নাবিকরা ব্যবহার করে আসছিল। ষোলো শতকের দিকে এসে বিশে^র সামগ্রিক মানচিত্র রচনায় কয়েকজন ওসমানীয় মানচিত্রাঙ্কনবিদ এগিয়ে আসেন। তাদের কয়েকটি মানচিত্র নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো। 

১. ওসমানীয় নেভাল অ্যাডমিরাল পিরি রেইস (১৪৭০-১৫৫৪) ১৫১৩ সালে একটি পোরটোলান মানচিত্র তৈরি করেন। এতে তিনি মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকাসহ আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল, তদসংলগ্ন স্পেন ও পুর্তগাল উপকূলসহ আটলাণ্টিক মহাসাগর এবং বিভিন্ন দ্বীপের চিত্র প্রদর্শন করেন। 

২. ১৫৬০ সালে ডেনিজ অ্যাটলাস ধারাবাহিকভাবে পোরটোলান মানচিত্র তৈরি করেন, যাতে তিনি  ম্যাডেটারিয়ান সাগর এবং ব্লাক সী ও ভারত মহাসাগরের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরেন। 

৩. ১৫৬৭ সালে আলি মাকার রেইস ছয়টি পারটোলান মানচিত্র এবং একটি বিশ^ মানচিত্র তৈরি করেন। 

তবে মুসলিম ভূগোলবিদ এবং মানচিত্রাঙ্কনবিদরা মানচিত্র রচনা এবং এর বিকাশ সাধনে যে অবদান রেখে গেছেন তা বিশ^ এখনও গর্বভরে স্মরণ করে। বলা যায় মুসলিম ভূগোলবিদ এবং মানচিত্রাঙ্কনবিদদের হাত ধরেই আধুনিক মানচিত্রের ক্ষেত্র রচিত হয়েছে।   

লেখক : ড. ইকবাল কবীর মোহন, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ও সাবেক ডিএমডি, ইসলামি ব্যাংক।বর্তমানে কো-অর্ডিনেটর, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ