বৃহস্পতিবার ৩০ নবেম্বর ২০২৩
Online Edition

দুর্নীতির নীতিপত্র

ড. আবদুল লতিফ মাসুম:

বাংলাদেশ সমাজ ও রাষ্ট্রে এই সময়ে দুর্নীতি সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিষয়ে সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদদের মত এক ও অভিন্ন। প্রায় এক যুগ ধরে বিশ^সভায় দুর্নীতির মাত্রায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অবস্থান জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। একটি উন্নয়নশীল সমাজ হিসেবে হাজারো সমস্যায় আকীর্ণ এই দেশ। কিন্তু সকল সমস্যাকে প্লাবিত করে ভয়াবহ দুর্নীতি আমাদের জীবনকে বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করছে। সন্দেহ নেই, গোটা পৃথিবীব্যাপী দুর্নীতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কিন্তু আমাদের মতো সর্বপ্লাবি অবস্থা পৃথিবীর অন্যত্র খুব কমই দৃশ্যমান। 

অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব গভর্নেন্স দুর্নীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছে, “Corruption is neither a property of a social system or an institution nor a trait of an individual’s character but rather an illegal exchange” (Federico Varese: 2008:123) দুর্নীতি কোন বিত্ত কিংবা সামাজিক ব্যবস্থা অথবা কোন প্রতিষ্ঠান নয়। এটি কোন ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও নয়। বরং এটি হলো অবৈধ লেনদেন। উইকিপিডিয়া দুর্নীতির নীতিপত্র রচনা করেছে এভাবে: “Corruption is a form of dishonesty or criminal offense undertaken by a person or organization entrusted with a position of authority to acquire illicit benefit or abuse power for once private game. Corruption may include many activities including bribery embezzlement, though it may also involve practices that are legal in many countries.1 

গতানুগতিকভাবে দুর্নীতির শ্রেনীবিভাগ আছে। প্রকারভেদ আছে। অর্থকরী দ্বারা অন্যায়ভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী লাভবান হলেই কেবল দুর্নীতির সবটুকু বর্ণিত হলো না। যেসব পথ-পদ্ধতি, বিধি-ব্যবস্থা বা সিদ্ধান্তের ফলে ন্যায়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যতিক্রম সূচিত হয় সেটিও দুর্নীতি। পরীক্ষায় নকল করতে তাৎক্ষণিকভাবে কেউ অর্থকরী পায় না কিন্তু শিক্ষার সর্বনাশ সাধিত হয়। সেটাও একধরনের দুর্নীতি। স্বজনকে অন্যায়ভাবে কোন সুবিধা দিলে সুনীতির অভাব ঘটে। সুতরাং সেটি স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতি। অপরদিকে যার যা প্রাপ্য তা না দিলে তাও দুর্নীতি। দেশ ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যদি ন্যায়ের অনুপস্থিতি ঘটে সেটি সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। তার কারণ সে সিদ্ধান্তের ফলে দেশ ও জাতির সর্বনাশ সাধিত হতে পারে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক রাজনীতিবিদরা। তারা যে নীতি বিচ্যুতির জন্ম দেয় তার নাম রাজনৈতিক দুর্নীতি। দুর্নীতির অর্থনেতিক বিবেচনার আগে- রাজনৈতিক দুর্নীতি বিবেচিত হওয়া উচিত। রাজনীতিই হচ্ছে সমাজের ভাঙা-গড়ার কারিগড়। রাজনীতিই হচ্ছে দেশের ভাগ্য বিধাতা। দেশ পরিচালনার চাবিকাঠি। যাদের হাতে সেই চাবিকাঠি তাদের মেজাজ-মর্জি, ধরন-ধারন ও বিষয়-বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে নীতি অথবা দুর্নীতি। অবশ্য পরিচালনার জন্য সব দেশেই একখানা কেতাব আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এস. ই. ফাইনারের ভাষায় তা হচ্ছে- ‘অটোবায়োগ্রাফি অব পাওয়ার রিলেশনশীপ’। ক্ষমতা সম্পর্কের আত্মবিবৃতি। কার কী ক্ষমতা-রাজার কী প্রাপ্য-প্রজার কী দায়- সব সেখানে লেখা আছে। বড় বড় দেশে ঐ কেতাবের বাইরে যাওয়া দায়। আর আমাদের রাজনীতিবিদরা ঐ কেতাবকে থোড়াই কেয়ার করেন। মনে করে ¯্রফে ‘বাত কা বাত’। নইলে কি এই দেশে গড়ে তিন বছরে একবার সংশোধনী হয়? অবশ্য আমাদের সংবিধানে অনেক ভালো ভালো কথা লেখা আছে। তবে কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। গোয়ালে থাকলে আমাদের এই দশা? যেমন সংবিধানের প্রথমেই বলা আছে, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’! আসলে তো ক্ষমতাই সকল রাজনীতির উৎস। মাঝে মধ্যে রাজনীতিবিদরা আপ্তবাক্য আওড়ান, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’। আসলে বাস্তবে উল্টো। ‘দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়’। দেশ বা জনগণ গোল্লায় যাক তাতে কিছু যায় আসে না। সবারই মন্ত্র ‘আমার সোনার হরিণ চাই’। আর নীতি নয়, দুর্নীতিই সেই সোনার হরিণের বাহন। এ দেশের খুচরা এবং পাইকারী নেতা-আধা নেতা, পাতি নেতা, রাঘব বোয়াল আর পুঁটি নেতা সকলেরই একমাত্র আরাধ্য অর্থ-বিত্ত, চিত্ত নয়। লোকেরা মিছা কথা কয়। অর্থই অনর্থের মূল। টমাস ফুলার বলেন, ‘অর্থ ও ক্ষমতার লোভে মানুষ যে কোন পর্যায়ে নেমে যেতে পারে’। আজকের বাংলাদেশ এর বাস্তব প্রমাণ। 

দুর্নীতির রাজনৈতিক অংশই আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয়। দেশ চালায় রাজনীতিবিদরা। রাজনৈতিক দল ব্যবস্থাই আজকের সরকার ব্যবস্থার নিয়ামক। স্কহাটসেইনডার বলেন, রাজনৈতিক দল ব্যতীত আধুনিক গণতন্ত্রের কার্যকারিতা অকল্পনীয় (১৯৪২:১)। সেটি রাষ্ট্রপতি শাসিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হোক কিংবা প্রধানমন্ত্রী শাসিত বৃটেন। আমরা যেহেতু বৃটেনের কলোনী ছিলাম, দুশো বছর ধরে কালে কালে তারা আমাদের অভ্যস্ত করে তুলেছে। সুতরাং উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদীয় শাসনব্যবস্থাই আমাদের উত্তম মনে হয়েছে। রাজনৈতিক দলই সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রাণ। স্বাধীনতার প্রাথমিক বছরগুলোতে সংসদীয় গণতন্ত্রে দুর্নীতির যে বীভৎসতা জনগণ দেখেছে তাতে তাদের মোহমুক্তি ঘটার কথা। বাংলাদেশের আশাবাদী মানুষ। ১৯৯০ এ স্বৈরাচারের পতনের পর একইভাবে আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু তাদের কপাল ফেরেনি। দিন যতই অতিক্রান্ত হয় দুর্ভোগ ততই বাড়ে। অতীতের চেয়ে ভবিষ্যত ভালো হয়নি। বিগত এক যুগ ধরে বাকশালের চেয়েও নিকৃষ্ট শাসন ব্যবস্থায় অতিক্রান্ত হচ্ছে দেশ। আগেরটি ছিল আইনী কাঠামোর মোড়কে, এখনকারটি বেআইনী বেপরোয়া সড়কে। সবচেয়ে সর্বনাশ করছে- রাজনৈতিক দুর্নীতি। এই দুর্নীতির দু’টি দিক- কাঠামোগত ও প্রক্রিয়াগত। সংসদীয় গণতন্ত্রের মোড়কে যদি অবশেষে আইনী ও বেআইনী বাকশাল কায়েম হয় সেটি কাঠামোগত দুর্নীতি। আরও রাষ্ট্রীয় কাঠামো বা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি গণতন্ত্রের পরিপূরক না হয় তাহলে সেটিও কাঠামোগত দুর্নীতির লক্ষণ। অপরদিকে এই কাঠামোগত পরিবর্তনের অনুষঙ্গ হচ্ছে- আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এই গুলোর গঠন প্রক্রিয়া, কাঠামো এবং উদ্দেশ্য যদি গণতন্ত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ও পরিপূরক না হয় তাহলে তা প্রক্রিয়াগত দুর্নীতির প্রমাণ বহন করে। 

জাতিসংঘের কনভেনশনে দুর্নীতির মূল উৎস তথা বিস্তৃতির জন্য রাজনৈতিক কর্তৃত্বকেই দায়ী করা হয়েছে। যেহেতু তারাই রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক। নীতিই যদি দুর্নীতি হয় কোন দল বা সরকার ব্যবস্থায় তা হয়ে ওঠে দূরারোগ্য। কনভেনশনে দুটো পর্যায়ে রাজনীতিকে দুর্নীতির জন্য দায়ী করা হয়েছে। প্রথমত, তাদের ভাষায় ‘পজিশন অব অথরিটি’ বা কর্তৃত্বের অবস্থান এবং দ্বিতীয়ত, ‘এবিউজ অব পাওয়ার’ বা ক্ষমতার অপব্যবহার। ব্যক্তিগত বা বেসরকারি দুর্নীতির জন্য পরোক্ষভাবে দেশের সরকার দায়ী হলেও জাতিসংঘ এইসব দুর্নীতিকে রাজনৈতিক দুর্নীতি বলতে চায় না। তাদের ভাষায়, ‘সরকারি পদাধিকারী ব্যক্তি যখন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিলের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করেন তখনই রাজনৈতিক দুর্নীতি ঘটে’। লক্ষনীয় যে, রাজনৈতিক দল দ্বারা পরিচালিত সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তখন রাষ্ট্রের যাবতীয় নীতিগত অবস্থান তারা নির্ধারণ করে। সম্পদের কর্তৃত্বপূর্ণ বণ্টনের মালিক-মোখতার তারাই থাকে। সুতরাং, দুর্নীতির জন্য তারা যেমন নীতিগতভাবে দায়ী তেমনি প্রক্রিয়াগতভাবেও দায়ভার তাদের।

একটি গবেষণা নিবন্ধে দুর্নীতিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি ছোট, অপরটি বড়। তারা নাম দিয়েছেন, স্মল এবং গ্রান্ড কারাপশন। যেমন একটি পিওনের চাকরির জন্য মন্ত্রীর সুপারিশ-এটা ছোট। আবার বড় ব্রিজের কনসট্রাকশনের কাজ পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ইশারা- উভয়ই রাজনৈতিক দুর্নীতি বলে গণ্য হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট দুর্নীতি প্রকারান্তরে সমাজকে কলুষিত করে। সামাজিক হতাশা, ক্ষোভ, অপরাধপ্রবণতা ও অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অপরদিকে গ্রান্ড কারাপশন বা খুব বড় ধরনের দুর্নীতি জাতীয় বিপর্যয় বা বড় ক্ষতির সৃষ্টি করতে পারে। এটির একটি বৈশি^ক প্রভাবও অনুভূত হয়। যখন বিশ^ ব্যাংকের মতো সংস্থা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন হতাশ হতে হয় বৈকি। দুর্নীতি হোক কি না হোক জাতি হিসেবে দুর্নীতির যে নেতিবাচক বদ্ধমূল ধারনার সৃষ্টি হয়, আন্তর্জাতিক মহলে তা রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মতো দেশ দুর্নীতিতে বিশ^ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বারবার। দীর্ঘকাল ধরে শিরোপার পরিবর্তন হলেও অবস্থানের উন্নতি হয়নি। বিশ^ সমাজে বাংলাদেশের রাজনীতি বা রাজনৈতিক এলিটদের ইমেজের জন্য দুর্নীতির অবস্থানই যথেষ্ট। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক স্টিফেন ডি. মরিস মন্তব্য করেন, ‘পলিটিক্যাল কারাপশন ইজ দ্য ইললেজিটিমেট ইউজ অব পাবলিক পাওয়ার টু বেনিফিট এ প্রাইভেট ইন্টারেস্ট’। এখানে পাওয়ার বা ক্ষমতা কেন্দ্রীকতাকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, আইন-কানুন, রীতি-রেওয়াজ, পার্চেজ পলিসি বা টেন্ডারের বিধি-বিধান ঠিক রেখেই রাজনৈতিক দুর্নীতি হতে পারে। ডি. মরিস সেটিকেও বেআইনী বলেন, যদিও আইনের মোড়কে তা করা হয়। এমনকি কখনো কখনো নতুন নতুন আইন করে দুর্নীতিকে জায়েজ করে রাজনৈতিক সরকার। যে সমস্ত কারণগুলো রাজনৈতিক দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে এগুলো হচ্ছে- ক. স্বার্থের দ্বন্দ্ব খ. বিশেষ ক্ষমতা গ. একক ক্ষমতা ঘ. স্বচ্ছতার অভাব এবং ঙ. বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এভাবে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে দুর্নীতি একটি স্থায়ী পদ্ধতি হিসেবে বিকশিত হয়। জনগণ দেখতে দেখতে দুর্নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে অথবা নিষ্পৃহ জীবনদৃষ্টি পোষণ করে। 

রাজনৈতিক দুর্নীতির বিষয় হিসেবে নতুন করে আলোচনার অবতারণা হচ্ছে। কিন্তু অর্থনৈতিক দুর্নীতির বিষয়টি অনেক পুরনো। অর্থনীতিবিদ আয়ান সিনিয়র অর্থনৈতিক দুর্নীতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। প্রথমত: বিষয়টি গোপনীয়তার সাথে সম্পন্ন হয়। দ্বিতীয়ত: এটি সামগ্রী বা সার্ভিস উভয়ভাবেই নিষ্পন্ন হতে পারে। তৃতীয়ত: এসব ক্ষেত্রে সাধারনত দুর্নীতিকারকরা কর্তৃত্বধারী হয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ডেনিয়েল কউফম্যান এসব বৈশিষ্ট্যের সাথে ‘আইনানুগ দুর্নীতি’ শব্দটি সংযোজন করেছেন। তার কারণ আইনানুগ কাঠামো বা আইনের মারপ্যাঁচে এসব দুর্নীতি সংঘটিত হয়। এসব কর্তৃত্বশালীরা তাদের দুর্নীতিকে জায়েজ করার জন্য এবং আইনের রক্ষাকবচ পাওয়ার জন্য নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখে। ফলে কোন ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো, সময় বৃদ্ধি এমনকি পুরো প্রকল্পের কাগজী সমাপ্তি ঘটিয়ে পুরো অর্থই ভাগ-বাটোয়ারা করে নেবার সুযোগ ঘটে। বাংলাদেশে পুকুর চুরির প্রবাদটির শুরু এভাবেই। কাজ না হলে বা নিম্নমানের হলে বা জনস্বার্থ ব্যাহত হলে দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহি করতে হয় না। এভাবে ছোট আত্মসাৎ থেকে পুকুর চুরি বা সাগর চুরি ঘটতে পারে। সাধারণত এগুলো স্বল্প সংখ্যক সুবিধাবাদীর মধ্যে আবর্তিত বিবর্তিত হয়। এসব দুর্নীতি ঘটতে ঘটতে দেখতে দেখতে সমাজে স্থিতি হয়ে যায়। দুর্নীতিই নীতিতে পরিণত হয়।

এই অর্থনৈতিক দুর্নীতিকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ছোট ও বড়। থানায়, ইনকাম ট্যাক্স অফিসে, এয়ারপোর্টে, রেজিস্ট্রি অফিসে বা রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশকে যে ঘুষ দেয়া হয় তাকে বলা হয় ছোট দুর্নীতি। আর রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যে কোটি কোটি অংকের দুর্নীতি ঘটে তাকে বলা যায় মেগা বা বড় দুর্নীতি। এসব দুর্নীতি প্রকাশিত হলে দেশ এমনকি দুনিয়া কেঁপে যায়। রাজা-রাজ্য-রাজধানী তছনছ হয়ে যায়। একজন নেওয়াজ শরীফ প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান। নাগিব রাজ্জাকরা জেল খাটেন। সামরিক বেসামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। লকহিড স্ক্যান্ডেল, বোফর্স কেলেঙ্কারী ইত্যাদি ঘটনা ইতিহাস হয়ে যায়। এসব বড় বড় কেলেঙ্কারী তখনই সম্ভব হয় যখন রাজনীতি, অর্থনীতি ও আইন থাকে দুর্নীতিবাজদের হাতের মুঠোয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, ঐসব দেশে কর্তৃত্ববাদ, একনায়কত্ববাদ বা বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিবাদ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি অপরিহার্য অঙ্গ-আইনসভা, বিচার সভা ও নির্বাহী কর্তৃত্ব যদি একাকার হয়ে যায় তাহলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করে। আর যেসব দেশ ও রাষ্ট্রে এই তিনটি বিভাগ পৃথক পৃথকভাবে বিভাজিত অর্থাৎ ‘ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরন’ ক্রিয়াশীল সেখানে দুর্নীতি নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কঠিন। 

বিদ্বজনরা এক ধরনের দুর্নীতিকে বলতে চান পদ্ধতিগত। আমরা প্রবাদ বাক্যে যেমনটি বলে থাকি ‘সরিষায় ভূত’। অথবা বেড়ায় ক্ষেত খায়। একে স্থায়ী দুর্নীতির পন্থাও বলা যায়। এসব চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। সিস্টেম বা পদ্ধতি হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। এই প্রাতিষ্ঠানিকতা পাওয়ার পিছনে কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটি, প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য কাজ করে। এগুলো হচ্ছে: বিতর্কিত সুবিধাদি, বিশেষ দায়িত্ব, একচেটিয়া ক্ষমতা, স্বচ্ছতার অভাব, নিম্ন বেতন ভাতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এগুলো প্রকাশ ঘটে নানাভাবে- ঘুষ, চাঁদাবাজি, আত্মসাৎ ইত্যাদি আকারে। এসব ক্ষেত্রে ‘দুর্নীতিই নীতি, অন্য কিছু ব্যতিক্রমধর্মী’। (Corruption becomes the rule rather than the exception) গবেষকগণ এই পদ্ধতিগত বা সিস্টেমেটিক করাপশনকে কেন্দ্রীয় এবং বিকেন্দ্রীয়- এভাবেও দেখতে চেয়েছেন। অন্যভাবে বলা যায়, তৃণমূল থেকে ঊর্ধ্বমুখী। আবার উর্ধ্বগামী থেকে তৃণমূলগামী। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের বিষয়কে এরূপ অবরোহ এবং আরোহ- উভয়বিধ ধারায়ই ব্যাখ্যা করা হয়।  অভিযোগ করা হয় যে, পশ্চিমা দেশগুলো তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোর পদ্ধতিগত দুর্নীতিকে নিজেদের পুঁজির স্বার্থে দেখেও দেখে না। শুনেও শুনে না। তৃতীয় বিশে^ এধরনের দুর্নীতির হরেক রকম রূপ। কালোবাজারি, চোরাকারবারি, নেশা ব্যবসা, প্রতারণা, স্বজনপ্রীতি, বিশ^াসঘাতকতা, দালালী, অবৈধ ব্যবসা, সরকারি অর্থ বেহাত করা, কালো টাকা, ফরিয়াগিরি, মওজুতদারী এবং মানি লন্ডারিং। আইন ও সমাজের চোখ এড়ানোর জন্য দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ অর্থ বিদেশী ব্যাংকে জমা রাখা হয়। সাম্প্রতিককালে এটি এতই প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে যে, এসব লোকেরা প্রকাশ্যেই বিদেশে ‘সেকেন্ড হোম’ বানিয়েছে। বড় দুর্নীতিবাজরা সাধারনত ক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থান করে। একজন বিষয় বিশেষজ্ঞ পি.আর. কলিগার্ড বলেন, দুর্নীতি তখনই ঘটে যখন ধরা পড়া ও শাস্তি অবশেষে তা লাভজনক প্রমাণিত হয়।  

রাজনৈতিক দুর্নীতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে তাত্ত্বিকরা ধাঁধাঁয় আছেন। একজন তাত্ত্বিক উন্নয়ন ও দুর্নীতির দ্বৈত অবস্থান দ্বৈধতার কথা বলছেন। (এম.খান: ২০১৭) উদাহরণ হিসেবে দুর্নীতির অভিযোগ ও পরে দেশের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কথা বলা যায়। সম্ভবত গোটা বিশ^ বাজারে এতো অধিক অর্থ ব্যয়ে এ ধরনের উন্নয়ন সাধিত হয়নি। ‘দুর্নীতির বিনিময়ে উন্নয়ন’ ধারনাটি এখানে প্রয়োগিক হতে পারে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়তা, আরোপিত স্থিতিশীলতা এবং জনগনের সামগ্রীক পরিশ্রম এই দুর্নীতির দ্বৈধতাকে বাস্তব রূপ দিয়েছে। এই দ্বৈধতা এবং দুর্নীতির রাষ্ট্রিক রূপ পরিবর্তনের জন্য বিকল্প বিধির সন্ধান করতে বলেছেন তাত্ত্বিকরা। (এম.খান:২০১৭, ইফতেখারুজ্জামান:২০১৭, রশিদ ও জোহরা:২০১৮)। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ করেছে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন উচ্চাকাক্সিক্ষ পরিকল্পনা- ‘ভিশন-২০৪১’, সপ্তম পাঁচশালা পরিকল্পনা, বদ্বীপ পরিকল্পনা এবং জাতিসংঘের টেকসই পরিকল্পনার লক্ষ্যে পৌঁছার কথা শুনা যাচ্ছে। সেই সাথে দুর্নীতি দূরীকরণে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত হচ্ছে। বিভিন্ন সেক্টর ভিত্তিক হাজারো আইন রয়েছে। ভবিষ্যত প্রতিশ্রুতির আলোকে নতুন নতুন আইন আসবে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত বিধি-ব্যবস্থা তথা পদ্ধতিগত বিপ্লব সাধিত না হবে এবং জনচরিত্রের মৌলিক পরিবর্তন না ঘটবে ততদিন পর্যন্ত দুর্নীতির অবস্থানের পরিবর্তন বা অবসান সম্ভব হবে না। 

1 Retrieved from Internet on 06.09.2020

২ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

3 Kligaard, Robert (1998), Controlling Corruption, University of California Press, Berkeley, CA

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ