মঙ্গলবার ২১ মার্চ ২০২৩
Online Edition

উপেক্ষিত পুরুষ-সতর্কতার তাগিদ

# নারীর চেয়ে পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশির নেপথ্যে...
তোফাজ্জল হোসাইন কামাল : বিশ্বব্যাপী নারীদের তুলনায় পুরুষরা দ্বিগুণ সংখ্যায় আত্মহত্যা করে। ব্যাপক মানসিক চাপে নানা ধরনের শারীরিক অসুখে বেশি ভোগেন পুরুষেরা- বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। 'কান পেতে রই’ বাংলাদেশে মানসিক সহায়তা বিষয়ক একটি হেল্পলাইন। বেসরকারি এই সংস্থাটি বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত তাদের হেল্পলাইনে ফোন করে কাউন্সেলিং চেয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। এই পুরুষদের মধ্যে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি কল করেছেন।
সংস্থাটির সমন্বয়ক অরুণ দাস বলছেন, বেশিরভাগই তাদের মানসিক কষ্টের উৎস হিসেবে উপার্জনের চাপের কথা উল্লেখ করেন। "তাদের একটা বড় অংশ সম্পর্ক নিয়ে সমস্যার কথা বলেন এবং মূলত মেয়েরাই এ বিষয় নিয়ে বেশি কথা বলেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে কাজ বিষয়ক ইস্যু বেশি পাওয়া যায়- কারো হয়ত চাকরি চলে গেছে, অর্থনৈতিক অসুবিধার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, যে কারণে মানসিক চাপ- এসব বিষয় নিয়ে পুরুষরা কল করেন বেশি। আর একটা বিষয়ে পুরুষদের কাছ থেকে আমরা কল পাই সেটা হচ্ছে অ্যাডিকশন।" এসব বেড়াজাল থেকে বের হতে না পারা, এসব বিষয় নিয়ে কথা না বলা, অথবা বলতে না পারার ফল হলো বিশ্বব্যাপী পুরুষরা বেশি আত্মহত্যা করেন।
বেঁচে থাকার সকল আশা যখন ফুরিয়ে যায়, সামনে কোন আশার আলো দেখতে পাননা, হতাশায় ছেয়ে যায় জীবন-বিষাদে ভরে যায় মন এমন অবস্থাতেই ঘটে “আত্মহত্যা”। আত্মহত্যা যে কত নির্মম, কত নিষ্ঠুর-তা কেবল প্রিয়জন হারা মানুষগুলো বুঝতে পারে। মৃত্যুর ওপারের জীবন কেমন তা তাদের জানার সুযোগ নেই। তাই হয়তো বেঁচে থাকার এপারের জীবনে মানুষ এমন কিছু ঘটনার সম্মুখীন হয় যে ঘটনায় তার জীবন হয়ে ওঠে অতি তুচ্ছ যা হননে একজন মানুষ জীবনের মহত্ত্ব একটি মুহূর্তের জন্য ভুলে যায়। এই নিষ্ঠুর ঘটনা হতে পারে একটি ঘটনা অথবা কয়েকটি ঘটনার সমন্বয় যা রূপ নেয় ভয়ংকর বিষণ্নতায় মোড়া এক অলীক পরিণতির।
কী কী কারণে মানুষ বহু সাধ ও সাধনার এই জীবনকে এক নিমেষে হত্যা করে আত্মহত্যাকে একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয়? গবেষণা বলছে, আর্থিক সংকট, বেকারত্ব, লেখাপড়ায় বাধা, পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, প্রেমে ব্যর্থতা, অনুভূতির টানাপোড়েন, পছন্দের বাইরে বিয়ে দেওয়া বা করা, সামাজিক সম্মানহানিসহ নানাবিধ সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ দায়ী আত্মহত্যার পেছনে।
পুরুষ হয়ে ওঠার সামাজিক শিক্ষা
একজন পুরুষ পরিবারের সবার জন্য অর্থোপার্জন করবে, সবার দায়িত্ব বহন করবে, জীবনে সফল হবে, সবার জন্য সিদ্ধান্ত নেবে- সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন পুরুষ হয়ে ওঠার এই সামাজিক শিক্ষা জন্ম থেকেই তার ঘাড়ে বিশাল এক বোঝা চাপিয়ে দেয়। তার কাছ থেকে আশা করা হয় এসব চাপে পুরুষ ভেঙে পড়বে না। পুরুষ দুর্বলতা প্রকাশ করবে না।
সমাজবিজ্ঞানী সামিনা লুৎফা বলছেন, কেন বংশ পরম্পরায় পুরুষ এই শিক্ষা বহন করে চলেছে। তিনি বলছেন, "এটাকে আমরা বলি জেন্ডার রোল। সমাজ নারী ও পুরুষের জন্য শ্রম বিভাজন করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে সমাজ তার কাছ থেকে এটা কেন চায়, তার উত্তর জানতে হলে আমাদের অনেক পেছনের দিকে যেতে হবে।" "মূলত আমরা দেখেছি যে এর সাথে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার একটা সম্পর্ক আছে। এই যে রোল অ্যসাইনমেন্ট, সেটা সমাজ করেছে নানান কারণে।
পুরুষ নিজেই কি পিতৃতন্ত্রের শিকার
বিশ্বব্যাপী পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ক্ষমতা, অর্থ, সম্পদের মালিকানা এবং সিদ্ধান্ত প্রণেতা হিসেবে পুরুষের অবস্থান নারীর উপরে। তাই মনে করা হয় পিতৃতন্ত্র পুরুষকে শুধু সুবিধাই দেয়। কিন্তু নৃবিজ্ঞানী জোবাইদা নাসরিন মনে করেন নিজের তৈরি পিতৃতন্ত্রের বেড়াজালে পুরুষ নিজেই বন্দী হয়ে রয়েছে।
তার ভাষায়, "পুরুষতান্ত্রিকতার ভিক্টিম কিন্তু পুরুষরাও। তাদের উপর একটা বাড়তি চাপ থাকে যে তাকে চাকরি পেতেই হবে, সংসারের হাল ধরতে হবে, সে যখন বিয়ে করবে তখন স্ত্রীর খরচ দিতে হবে - এটা একটা বিশাল মনস্তাত্ত্বিক চাপ। "কিন্তু চাপের মধ্যে থাকলেও কাউকে কিছু বলা যাবে না। বললে তাকে দুর্বল মনে করা হবে। ছোট বেলা থেকে তাকে যেভাবে তৈরি করা হয়, পুরুষের যে কাঠামো সেটা কিন্তু পুরুষতান্ত্রিকতারই ছকে তৈরি। পুরুষরা যে পুরুষতান্ত্রিকতার ভিকটিম, এই বেড়াজাল থেকে সে কিভাবে বের হবে সেই তরিকাটা খুঁজে বের করা জরুরি," বলেন তিনি।
ব্যর্থতার গ্লানি
যথেষ্ট উপার্জন করতে না পারা এবং পরিবারের জন্য দায়িত্ব পালন করতে না পারার জন্য অনেক পুরুষ ব্যর্থতার গ্লানিও বহন করেন, যা তার জন্য একটি বড় মানসিক চাপ।
মানবসম্পদ নিয়ে কাজ করেন মোহাম্মদ ওমর সিদ্দিক। তার ভেতরে কিভাবে ব্যর্থতার ভয় কাজ করে সেটি বর্ণনা করে তিনি বলছিলেন, "যেকোনো ভাবেই হোক আমাকে উপার্জন করতে হবে, এই চাপ আমার মধ্যে সবসময় ছিল।" "যাতে আমি আমার পরিবার, আমার উপর যারা পুরোপুরি এবং আংশিকভাবে নির্ভরশীল তাদেরকে যাতে আমি সোসাইটির স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সঠিক সাপোর্ট দিতে পারি। আমার কাছে ফিয়ার অফ ফেইলিউর হলো যথাযথ সাপোর্ট তাদেরকে না দিতে পারা।"
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলছেন, বেশিরভাগ সময় পুরুষদের প্রবণতা হচ্ছে ছোটখাটো মানসিক উদ্বেগকে গুরুত্ব না দেয়া। অনেক বড় ধরনের মানসিক সমস্যা নিয়ে সবকিছু ভেঙে পড়ার পরিস্থিতি হলে তখনই পুরুষরা তাদের শরণাপন্ন হন। তবে তিনি বলছেন, পুরুষ তার ভূমিকা পালন করার জন্য সমাজের যে স্বীকৃতি ও ক্ষমতা পান সে কারণে তিনি নিজেও এসব দায়িত্বকে চাপ মনে করেন না।
তার মতে, "সমাজ তাকে যে দায়িত্ব দেয় সেটাকে সে চাপ হিসেবে দেখে না। কারণ হলো ছোট বেলা থেকেই তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেয়া হয়েছে।" "এই যে এত কাজ করছে, টাকা আয় করছে- এটার জন্য সে এক ধরনের পাওয়ার হোল্ড করছে। খুব স্বাভাবিক যে সেই পাওয়ারের জায়গাটা তারা ছাড়তে চাইবেন না। তাই এত দায়িত্বকে সে আর নেগেটিভলি দেখতে পারে না। এটা যে তার প্রতি এক ধরনের অন্যায়ও সে সেটা সেভাবে চিহ্নিতও করতে পারে না," বলেন তিনি।
সতর্কতার তাগিদ
ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করা ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান মৃত্যুর আগে তার একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গ জীবনের কথা জানিয়েছেন। একসময়ে সফল ব্যবসায়ী ছিলেন জানিয়ে তিনি পরিবার-স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালনের প্রসঙ্গও তোলেন ফেসবুক লাইভে।
বাবা হিসেবে দায়িত্বের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত বাবারা না খেয়েও সন্তানদের খাওয়ানোর চেষ্টা করে, ফ্যামিলিকে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ফ্যামিলি অনেক সময় বুঝতে চায় না। নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারলাম না।’
মহসিন খানের নিঃসঙ্গ জীবনের পেছনে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সংকটকেও দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, প্রচলিত ধারণায় পুরুষকে শক্তিমান ও ক্ষমতাধর হিসেবে দেখা হলেও পুরুষকেও বহুমুখী চাপের শিকার হতে হয়। স্বাভাবিক সক্রিয় জীবনের পর শারীরিক ও মানসিকভাবে তীব্র একাকিত্বের মুখোমুখি হন অসংখ্য পুরুষ।
জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের ভরণ-পোষণের মূল চাপটি বহন করে পুরুষ। তবে এটি পুরুষের সহজাত কোনো প্রবৃত্তি নয়। আর অব্যাহত এই দায়িত্বের বোঝা কখনও কখনও পুরুষকে করে তোলে অসহায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘ব্যবসায় ধস নামা, পরিবার থেকে মেন্টাল সাপোর্ট না পাওয়ার কারণে সেল্ফ ইস্টিম লো হয়ে যায়। ব্যবসায়ী মহসিনের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়ে থাকতে পারে।’ জাপানে এমন ঘটনার নজির আছে জানিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, ‘কাছের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা যাতে না আসে, সেদিকে নজর দিতে হবে।’
সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন দেশের প্রায় অর্ধশতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার উপর এক সমীক্ষায় পেয়েছে গতবছর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৬২জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৬৫ জন পুরুষ এবং ৩৬ জন নারী শিক্ষার্থী।
পারিবারিক সমস্যার কারণে ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। পড়াশোনা সংক্রান্ত কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর্থিক সমস্যার কারণে ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ, মাদকাসক্ত হয়ে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করেছেন ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।
উন্নত বিশ্ব তথা যেসব দেশে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে কম তাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেসব দেশের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা কত বেশি মজবুত। ওইসব রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা দিতে বদ্ধপরিকর। পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শারীরিক অসুখের মতো মনেরও অসুখ হতে পারে। এই অসুখের নাম বিষণ্নতা। রাষ্ট্রকে নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ভূমিকা রাখা বিভিন্ন উপাদান যেমন, পার্ক, খেলার মাঠ, থিয়েটার, পাবলিক লাইব্রেরি ইত্যাদির সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ