সাহিত্য-প্রযুক্তি ও বাস্তবতা

ইনামুল করিম
মানবীয় মানচিত্রের নদীর প্রবাহে প্রযুক্তির ব্যবহার অনিবার্য বাস্তবতায় প্রস্ফুটিত। কার্যত প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানব সভ্যতায় প্রস্ফুটিত। কার্যত প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানব সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে। জীবনযাত্রার প্রতি পদক্ষেপে আমরা প্রযুক্তির দ্বারস্থ হয়ে থাকি। মানবীয় বৃক্ষের বিকাশ ধারায় সাহিত্য একটি অংশ। সে কারণে সাহিত্য চর্চায় প্রযুক্তির ব্যবহার একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এক্ষেত্রে সঠিক মাত্রায় ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ না থাকলে হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
আধুনিক জীবনযাত্রায় ইন্টারনেটের ব্যবহার একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ইন্টারনেটের কারণে আমরা এখন গ্লোবাল পরিবারের সদস্য। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেও ইন্টারনেট একটি নতুন বাস্তবতা নির্মাণ করেছে। লেখা প্রকাশ করা এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে।
আগে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য লেখককে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক, মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হতো। এখন সে যুগ বাসি হয়ে গেছে। লেখা প্রকাশের আদি বাস্তবতা এখন যাদুঘরে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমান ইন্টারনেট বাস্তবতায় লেখক এখন গুহা মানব হয়ে নিজের লেখা নিজেই প্রকাশ করতে পারেন। লেখক হওয়ার জন্য এখন দরকার ডেক্সটপ কম্পিউটার বা ল্যাপটপ এবং ইন্টারনেট সংযোগ। এটা হলো লেখক হওয়ার জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ। মূল বিনিয়োগও বলা যায়। এরপর নিজের ওয়েবসাইট বা ব্লগ তৈরি করে সেখানে নিজের লেখা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশ করে যাওয়া। অন্যদিকে ওয়েব ম্যাগাজিন রয়েছে সেখানে লেখা প্রকাশ করা যায়। ফেসবুকে অনেক অনেক লেখক গ্রুপ তৈরি করেছেন। এসব গ্রুপে যোগদান করে লেখা পোস্ট করা যায়। ইন্টারনেট সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে মুশকিল আছান করে দিয়েছে।
বর্তমানে ব্লগ, ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে সাহিত্য কর্ম প্রকাশের বিষয়টা যেমন আনন্দের কথা, তেমনি আশংকার কথাও। আশংকার কথা কেন? আগে লেখা প্রকাশের জন্য দৈনিকের সাহিত্য পাতায় বা মাসিক পত্রিকায় পাঠাতে হতো। সম্পাদক মহোদয়ের দৃষ্টিতে মান সম্পন্ন হলেই লেখাটি প্রকাশিত হতো। কিন্তু ফেসবুক বা ওয়েবসাইট বা ব্লগে লেখা প্রকাশের জন্য সেটার আর প্রয়োজন পড়ে না। নিজের লেখা নিজে কম্পোজ করে ব্লগ বা ওয়েবপেজে বা ফেসবুক পেজেপোস্ট করে দেওয়া পর্যন্তই লেখকের কাজ। এতে দেখা যাচ্ছে মান সম্পন্ন নয় এমন লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। অর্থাৎ এখানে মান নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা নেই।
এখানে বলা যায় পাঠক যদি লেখাটিকে মানসম্পন্ন মনে না করেন তাহলে তিনি সেটা পড়বেন না। একদম খাঁটি কথা, অকাট্য যুক্তি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সব পাঠক কিন্তু শিল্পীযোদ্ধা নন। সবার চেতনার জগত একই সমতলে অবস্থিত নয়। সাহিত্য জগতে এমন অনেক লেখক আছেন যাদের লেখা বহুল পঠিত নয়। তারা জনপ্রিয় ধারার লেখক নন। কিন্তু তাদের লেখার শিল্পমান হিমালয় চূড়ায় অবস্থিত। যেমন কমল কুমার মজুমদার। এ জাতের লেখকদের লেখা জনপ্রিয় লেখকদের লেখার চেয়েও বেশ উঁচু মানের। একজন জনপ্রিয় লেখক সম্পর্কে বলা হয়, তার লেখার কোন ক্রমবিকাশ নেই। তার প্রথম উপন্যাসে যে মাত্রার ছিল তার পরবর্তী উপন্যাসগুলো সেটা অতিক্রম করতে পারেননি। কিন্তু তিনি জনপ্রিয় লেখক। বাস্তবতা জনপ্রিয়তা দিয়ে সাহিত্যের মান বিচার করা যায় না। অথচ ওয়েবভিত্তিক সাহিত্য চর্চায় এটাই ঘটছে। ইন্টারনেট ভিত্তিক লেখকরা হিসাব করেন তাদের লেখায় কতজন লাইক দিয়েছেন, শেয়ার করেছেন, সাবস্ক্রাইব হয়েছেন। এসব হিসাব করে তারা নিজেদেরকে মহান সাহিত্যিক বা জনপ্রিয় সাহিত্যিক হিসেবে ভেবে থাকেন। এখানে পরস্পর পিঠ চুলকানির বিষয়ও রয়েছে। তুমি আমার লেখায় লাইক দিবে, কমেন্ট করবে; প্রতিদানে আমিও তোমার লেখায় লাইক দিব, শেয়ার দিব। এ ক্ষেত্রে লেখার শিল্প গুণটির প্রতি নজর দেয়া হয় না।
একটি ওয়েব ম্যাগাজিনে দেখা গেছে, একজন লেখকের দুই হাজারের উপর সাবক্রাইবার রয়েছে। তার অনেক লেখার পাঠক সংখ্যা তিন হাজারের উপর। এই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত গল্প উপন্যাসগুলো বহু পর্বভিত্তিক। একাধিক গল্প রয়েছে ত্রিশ পর্বের। টেলিভিশনে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটকের মতো লেখাগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতেই থাকে। অনুগল্পে দেখা গেছে দশ পর্বের। এখানে লেখকদের ধারাবাহিক গল্প-নভলেট-উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত। এতে লেখকরাও উপকৃত হচ্ছেন। প্রতি মাসে তারা মোটা অংকের অর্থ উপার্জন করছেন।
সাহিত্য বিষয়ক একটি ফেসবুক গ্রুপ একাউন্টে দেখা গেছে এতে এক হাজারের বেশি সদস্য রয়েছেন। তার মানে কি এই গ্রুপের সবাই লেখক? বিষয়টা পরিষ্কার নয়। যদি সব সদস্যই লেখক হয়ে থাকেন তাহলে বলতে হয় লেখকের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
কার্যত বিভিন্ন ওয়েবসাইট বা ব্লগে যত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে তার বেশিরভাগ লেখারই শিল্পমান প্রশ্ন সাপেক্ষ। এখানে লাইকে সাহিত্যের বাজার দর বলা যায়। এই বাজার দর সম্পর্কে আমার যতো সচেতন হবো এর শিল্পদর সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান তত বিম্মৃতির অন্তরালে চলে যাবে। সে কারণে লেখক প্রজাতিকে লোভ নামক ড্রাগন রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করা তাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই অপরিহার্য।
নানারূপ গদ্য পদ্য লেখার এবং ছাপার যতটা প্রবল ঝোঁক যত বেশি লোকের মধ্যে আজকাল এ দেশে দেখা যায়, তা পূর্বে কখনও দেখা যায়নি। কথাটা বলেছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বঙ্গ সাহিত্যের নবযুগ’ প্রবন্ধে। তার এ পর্যবেক্ষণের বাস্তবতা বর্তমান সময়েও প্রস্ফুটিত। ওয়েব ম্যাগাজিনের দিকে লক্ষ্য করলেই বিষয়টা প্রমাণিত। তৎকালীন সাহিত্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ ছিলÑ “ভবিষ্যতে কাব্য দর্শনাদি আর গাছের তো উঁচুর দিকে ঠেলে উঠবে না, ঘাসের মতো চারদিকে ছড়িয়ে যাবে। এক কথায় বহু শক্তিশালী স্বল্প সংখ্যক লেখকের দিন চলে গিয়ে স্বল্প শক্তিশালী বহুসংখ্যক লেখকের দিন আসছে।” বর্তমান বাস্তবতা কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে?
কার্যত ইন্টারনেট ভিত্তিক সাহিত্য চর্চায় একদিকে লেখক প্রজাতির সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলছে। অন্যদিকে লেখার সংখ্যাও সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লেখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও লেখার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
বর্তমানে লেখকদের প্রধান ঝোঁক জনপ্রিয়তার দিকে। এই ঝোঁকটি যদি না সামলানো যায় তাহলে সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় সৃষ্টি হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কারণ জনপ্রিয়তার ঝোঁক থেকে অহংবেধের সৃষ্টি হয়। আর এই অহংবোধ লেখক সত্তার জন্য তেজস্ক্রিয় ভাইরাস।
আমাদের লেখকদের মানুষ ভূগোলে অহংবোধের নার্সিসাল আর্সেনিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়। তাদের মনোভাবটা এরকম Ñ“আমি যা লিখি সেটাই সর্বোৎকৃষ্ট। আমার লেখাটা অপ্রকাশিত থাকলে সমাজে বিশেষ ক্ষতি হয়ে যাবে।” আর তাই লেখকরা লেখা প্রকাশ করতে থাকেন। ভাব প্রকাশের এই মনোভাবটাই সাহিত্যের জন্য যেমন তেমনি লেখকের জন্যও ক্ষতিকর। আপনার কাছে যে বক্তব্য হীরের অলংকারের মতো মনে হয় সেটা অপরের কাছে তেমন মূল্যবান নাও হতে পারে। একজন লেখকের প্রকাশ ক্ষমতার উপর নিভর্র করে পাঠকের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা। বোদ্ধা পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে লেখা মূল্যহীন বস্তুতে পর্যবসিত। অন্যটি লেখার যদি শিল্পগুণের অভাব থাকে তাহলে সেটা যেমন পাঠকের কাছে মূল্যহীন হয়ে যায়, তেমনি কালের ¯্রােতে তা তলিয়ে যায়।
প্রযুক্তির কল্যাণে তথা ইন্টারনেটের কারণে লেখা ও লেখকের প্রজনন বেড়ে যাওয়া সাহিত্যের জন্য কল্যাণকর নাকি অকল্যাণকর সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর বক্তব্য না পড়ে প-িত হওয়া সম্ভব হলেও না লিখে লেখক হওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে এবং সে জন্যই মাসিক পত্রের বংশ বৃদ্ধিটা সুখের কিংবা দুঃখের বিষয় সে বিষয়ে আমি মন স্থির করে উঠতে পারিনি।