আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ দেশবাসীর হৃদয় ও মননে
মোঃ রাশেদুল ইসলাম রাশেদ : ইসলামী আন্দোলন, সংগ্রাম ও ইতিহাসের মূর্তপ্রতীক। স্বৈরাচার, আধিপত্যবাদ বিরোধী চেতনার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। নাস্তিকতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের রক্তচক্ষু মোকাবিলা করে তৃণমূল থেকে গড়ে উঠে আসা একজন সংগ্রামী প্রাণপুরুষ। প্রেরণার বাতিঘর। একজন আদর্শ শিক্ষক থেকে দুর্নীতিমুক্ত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কান্ডারী ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের প্রিয় নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুল আলী’র সংসার আলোকিত করে দুনিয়ার মুখ দেখেন। পিতার হাতেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ। পরবর্তীতে, ফরিদপুর ময়জুদ্দিন স্কুলে ভর্তি হন এবং তারও পরে তিনি ফরিদপুর জেলা স্কুলে অধ্যয়ন করেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনা সুসম্পন্ন করার পর তিনি ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রী শেষ করার পর তিনি ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় পাড়ি জমান। জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাত্র দুই-আড়াই মাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ক্লাস করার পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি চট্টগ্রম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন।
জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন। তিনি ১৯৮১সাল পর্যন্ত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ আদর্শ স্কুলের একজন আদর্শ অধ্যক্ষ। এই আদর্শ স্কুল প্রতিষ্ঠায় ১৯৭৩-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। স্কুলের জন্য আর্থিক সংস্থান ও ছাত্র সংগ্রহে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তার ঐকান্তিক চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের কারণে আদর্শ স্কুল আজও নারায়ণগঞ্জ জেলায় সর্বশ্রেষ্ঠ স্কুল হিসেবে স্বীকৃত।
ব্যক্তি জীবনে অল্পে তুষ্ট, নির্লোভ, পরোপকারী, দৃঢ়চেতা, সংগ্রামী জননেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ খুব অল্প সময়ে সারাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। নিজের কর্মতৎপরতায় তিনি ছিলেন সদাতৎপর। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। শুরুতে রাজেন্দ্র কলেজে কিছুদিন এনএসএফ এ কাজ করার পর তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে যুক্ত হন। তিনি ছিলেন ফরিদপুর জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতি। ঢাকায় এসে ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলার সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের জুলাইতে ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সেক্রেটারি (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মনোনীত হন এবং এর মাত্র দুই মাস পর অক্টোবরে তিনি ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্রজীবন শেষ করার পরপরই জনাব মুজাহিদ জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৮২-১৯৮৯ পর্যন্ত অবিভক্ত ঢাকা মহানগরী জামায়াতের আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
জাতীয় রাজনীতিতে বরাবরই দেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ছাত্র আন্দোলনে, ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে, ১৯৯৪-১৯৯৬ কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, ২০০০ সালে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলনে এবং ২০০৭ সালে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর শপথ গ্রহণ করেন এবং মন্ত্রী হিসেবে সফলতার সাথে ৫ বছরের মেয়াদ সম্পন্ন করেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালীন তিনি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জাতীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালীন সময়ে তিনি মাদারীপুর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানাধীন অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত তাতিহাটী আইডিয়াল স্কুল মাঠে প্রধান অতিথি হিসেবে এক জনসমাবেশে এসেছিলেন। সেদিন সকাল ৯টার জনসমাবেশে তিনি সময়মতো উপস্থিত হন। সমাবেশে উপস্থিত জনতা তার আগমনে উচ্ছ্বসিত হন। যেখানে ৯টার প্রোগ্রাম ১১টায়ও শুরু হয় না। সেখানে জনাব মুজাহিদের সময়ানুবর্তিতা মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। স্থানীয় এমপি (শেরপুর-৩:শ্রীবরদী-ঝিনাইগাতী) জনাব মাহমুদুল হক রুবেলও মন্ত্রীর সফর উপলক্ষে সেদিন সময়ের ব্যত্যয় ঘটাননি। কেননা জনাব মুজাহিদ সবসময় সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। সময়ের কাজ সময়ে সম্পন্ন করেছেন। সেদিন দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকট থেকে শুনেছি জামায়াত নেতৃবৃন্দ ঠিক সময়েই সবকিছু করেন। সেদিনকার জনসমাবেশে আমিও তার বক্তব্য শুনেছিলাম। জনসমাবেশে তার গঠনমূলক বক্তব্যে সেদিন অনুপ্রাণিত হয়েছি। এরপরও বহু সমাবেশে তার বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়েছে।
বর্তমান কর্মস্থলে যোগাদানের পর জনাব মুজাহিদ স্যারের সাথে একাধিকবার সাক্ষাত ও কথা বলার সুযোগ হয়েছে। অফিসের এক ঈদ পরবর্তী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বর্তমান ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ জামায়াতের সেক্রেটারী ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদসহ অফিস স্টাফ ৫-৬ জনকে নিয়ে বৈঠকে তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন তুমি কি পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করো না চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা? আমি জবাবে বলেছিলাম স্যার আমি চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা করি। সেদিন তিনি আমার জবাব শুনে বলেছিলেন দু’টোই ভালভাবে করবে। কোনটাই ফাঁকি দিবে না। তার সাথে যেদিন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলাম সেদিন অনার্সের ছাত্র ছিলাম। তার দরাজ কন্ঠের সেদিনের উপদেশগুলো আজও আমাকে স্বপ্ন দেখায়। অনার্স, মাস্টার্স, এলএলবি শেষ করেও মনে হয় যদি আরও কোন বিষয়ে পড়াশোনা করা যায়। স্যার আজকের দিনে থাকলে হয়তো বলতে পারতাম স্যার আজও চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি।
২০০১ সালে যখন দায়িত্ব নেন, তখন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি দুর্বল বা লো প্রোফাইল মিনিস্ট্রি হিসেবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু তার দক্ষ নেতৃত্বে ৫ বছর মেয়াদ শেষে এটি হাই প্রোফাইল তথা আলোচিত মন্ত্রণালয়ে পরিণত হয়। তার একনিষ্ঠ ও সফলতার কারণে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাজেট মাত্র ৫ বছরে ৫ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। তিনি তার মন্ত্রিত্বের ৫ বছরে ছোটখাট নানা অনুষ্ঠান ছাড়াও ৪০টিরও বেশি আলোচিত প্রোগ্রাম করেন যেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যোগ দেন। তার নেতৃত্বে ২০০৪ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম প্রতিবন্ধী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি ‘মুক্তা’ নামক একটি মিনারেল ওয়াটারেরও প্রবর্তন করেন। যা প্রতিবন্ধীদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত এবং বাজারজাতকৃত। তার এই উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশের নাম তখন বিশ্ব দরবারে ভিন্নভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। তার সময় প্রতিবন্ধী অলিম্পিকেও বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করে। এছাড়া তার সময়ে সুদমুক্ত ঋণ ও এসিডদগ্ধদের মধ্যে ব্যপকভাবে ভাতা প্রদান করা হয়। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে ঘুরে নিজে এই ভাতা বিতরণ করতেন। তাই তার সময়ে গ্রামের অভাবী মানুষ সুদখোর মহাজন এবং বেসরকারি সংস্থার হাত থেকে মুক্ত হয়ে সরকারের কাছ থেকে বিশেষত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হাত থেকে ঋণ নিতে শুরু করে। তিনি মন্ত্রণালয় ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতি কমানোর চেষ্টা করেছেন এবং তাতে অনেকটা সফলও হয়েছেন। তার মন্ত্রণালয়ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে আকস্মিক সফরে যেতেন। মন্ত্রীত্বকালীন মেয়াদে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় ছেলে ও মেয়েদের জন্য তিনি পৃথক শিশু সদন (সরকারি এতিমখানা) নির্মাণ করেন। যা সমাজের ভাগ্যহত ও অনগ্রসর কিশোর কিশোরীদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে ব্যপক ভূমিকা রাখে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে ২০১০সালের ২৯ জুনে ঢাকা মুখ্য মহানগর আদালতে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করা হয় এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে কয়েক ঘন্টার মধ্যে সাভার স্মৃতিসৌধের সামনে থেকে জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুলাই একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন কর্মকর্তারা। এরপর ২ আগস্ট তাকে ট্রাইব্যুনালে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৭টি অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। ২৬ আগস্ট শাহরিয়ার কবিরের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এরপর এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকসহ মোট ১৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। অপরদিকে জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পক্ষে প্রথম এবং একমাত্র সাফাই সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দেন তার ছোট ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলে আসামীপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৫ মে দিন ধার্য করে দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
তিনি মৃত্যুদন্ড বহাল রাখার রায় শুনে আইনজীবীদের বলেছিলেন- ‘সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শাস্তির জন্য আমি মোটেই বিচলিত নই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ঐসব মিথ্যা অভিযোগে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্রপক্ষ আমার বিরুদ্ধে আনীত কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালে জেরার সময় স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের কোথাও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত কোনো অপরাধের সাথে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম না। এমনকি আমি আদৌ আল বদর, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল শামস বা এই ধরনের কোনো সহযোগী বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম এমন কোনো তথ্য তিনি তার তদন্তকালে পাননি। এরপরও আমার মৃত্যুদণ্ড বহাল। আমি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা ও বানোয়াট। ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে কোন ধরনের অপরাধের সাথে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম না। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে এত বছর পরে আমার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অভিযোগ সাজানো হয়েছে। প্রতিদিন বাংলাদেশে শত শত লোক স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। এসব মৃত্যুর সাথে ফাঁসির আদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। কখন, কার, কিভাবে মৃত্যু হবে সেটা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করেন। আল্লাহর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো সাধ্য কারো নেই। সুতরাং ফাঁসির আদেশে কিছু যায় আসে না। আমি মৃত্যুদন্ড বহাল রাখার ঘোষণায় উদ্বিগ্ন নই। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা গোটা মানবজাতিকে হত্যা করার শামিল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে যে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে তার জন্য আমি মোটেই বিচলিত নই। আমি আল্লাহর দ্বীনের উদ্দেশ্যে আমার জীবন কুরবান করার জন্য সবসময় প্রস্তুত আছি।’
২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর রাত ১২.৫৫মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের কফিনবাহী গাড়ির বহর ভোর ৬:৩০ মিনিটে ফরিদপুরে তার নিজ বাড়ি পশ্চিম খাবাসপুরে পৌঁছায়। প্রশাসনের কড়াকড়ির মধ্যেও সেদিন হাজারো মানুষ ছুটে এসেছিল ইসলামী আন্দোলনের প্রিয় নেতাকে এক নজর দেখার জন্য। র্যাব, পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চারিদিকে অতি বাড়াবাড়ির কারণে অনেকেই সেদিন জানাযায় শরিক হতে পারেননি। তারপরেও পূর্ব থেকে মাদরাসায় সমবেত হাজারো মানুষ জানাযায় শরিক হন। তাকে নিয়ে আসা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে জানাযা এবং দাফন সম্পন্ন করার জন্য সময় বেঁধে দেন। তড়িঘড়ি করে এর মধ্যেই তা সমাধা করতে হয়। জানাযায় ইমামতি করেন জনাব মুজাহিদের বড় ভাই আলী আফজাল মোহাম্মদ খালেছ। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী নিজের প্রতিষ্ঠিত মাওলানা আব্দুল আলী ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত আইডিয়াল ক্যাডেট মাদরাসা ও মসজিদের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। এই মাদরাসায় তিনি জীবিত থাকাকালীন ফরিদপুর আসলেই নামায পড়তেন এবং ছাত্র শিক্ষকদের খোঁজ খবর নিতেন। প্রতি রমযানে এই মসজিদেই তিনি ইতেকাফ করতেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমনটি বলেছিলেন মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই। জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের কবর সেই মসজিদের পাশেই দেয়া হয়েছে, সাথে আরো আছে মাদরাসা যেখানে প্রতিদিনে রাতে হচ্ছে পবিত্র কুরআনের চর্চা ও দ্বীনী শিক্ষা। এমন সৌভাগ্যই বা কয়জনের হয়।
এভাবেই একজন আদর্শ শিক্ষক থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী অতঃপর জুলুমের শিকার হয়ে ফাঁসির মঞ্চে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিদায়। তিনি ফাঁসির মঞ্চেও ছিলেন অবিচল; স্থাপন করেছেন দৃঢ়তার অনন্য নজির। জুলুমের স্বীকার হয়ে খোদার রাহে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন। কিন্তু আপোষ করেননি। নিঃস্বার্থ একজন সমাজ সেবক হিসেবে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ব্যাপক সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। দেশজুড়ে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ ও এতিমখানা বিনির্মাণে তার সক্রিয় ভূমিকা জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও পুরোধা ব্যক্তিত্ব দ্বীনের এ মর্দে মুজাহিদ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এ দেশের ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর হৃদয় ও মননে।