শুক্রবার ২৪ মার্চ ২০২৩
Online Edition

মূলে রয়েছে আস্থার সংকট

দেশ পরিচালনায় অনেক বিষয়কে বিবেচনায় রাখতে হয়। তবে রাজনীতি যে কোন দেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা বলেই নেতারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন এবং সেই সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করে জনজীবনকে। আমরা জানি, সব সিদ্ধান্তই সঠিক হয় না। সঠিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় তথ্য, জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা। এই বিষয়গুলোর সাথে যখন যুক্ত হয় নীতি এবং নৈতিকতা; তখন মানুষের সমাজ এগিয়ে যেতে পারে কাক্সিক্ষত পথে। বর্তমান সময়েও রাজনীতি আছে, নেতারাও আছেন। তারা নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। তবে তাদের অনেক সিদ্ধান্তই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আজকাল তো নীতি-নৈতিকতা ও প্রজ্ঞার বদলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে চাতুর্য ও দাম্ভিকতার প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়। এর ফলাফল কখনও ভাল হয় না। তবে রাজনীতিবিদরা এ বিষয়টিকে যেন উপেক্ষা করেই চলতে চান।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে উপেক্ষার পরিণতি শুভ হয় না। ভারতের বিতর্কিত কৃষি আইনের ক্ষেত্রেও তা লক্ষ্য করা গেল। দেড় বছর ধরে যে সিদ্ধান্তকে কৃষি সংস্কারে সাহসী পদক্ষেপ বলে অভিহিত করা হচ্ছিল, কৃষককুলের দাবিকে অগ্রাহ্য করা হচ্ছিল; হঠাৎ এমন কি ঘটলো যে সরকার সেই বিতর্কিত কৃষি আইন নাটকীয়ভাবে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তিন বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের পেছনে রয়েছে দলীয় রাজনৈতিক বার্তা, যার মূলে আছে উত্তর প্রদেশসহ গোটা উত্তর ভারতে ঘটিবাটি হারানোর তীব্র আশংকা। তাই জাতির প্রতি ভাষণে জোড়হাত করে ক্ষমা চেয়ে নিজের ও সরকারের ‘সততার’ প্রতি বিশ্বস্ত থেকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তপস্যায় নিশ্চয় কিঞ্চিত ঘাটতি ছিল, তাই সব কৃষককে সন্তুষ্ট করতে পারিনি। স্বচ্ছ হৃদয়ে ক্ষমা চেয়ে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।’ উল্লেখ্য যে, করোনার কারণে দুর্দশার ভার কাঁধে নিয়ে প্রথমবার ক্ষমা চেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। গত শুক্রবার সাতসকালে দ্বিতীয়বার। তবে সেই ক্ষমা প্রার্থনাও প্রধানমন্ত্রীকে সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা করতে পারছে না। চারদিকে প্রশ্ন উঠেছে, এতো বিলম্বে কেন বোধোদয়? কেন সাড়ে সাতশ’ কৃষকের বলিদানের জন্য অপেক্ষা করলো সরকার?
কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্দেশে গত বছর জুন মাসে কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে তিনটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল মোদি সরকার। সেপ্টেম্বর মাসে সংসদের অধিবেশনে বিনা আলোচনায় তিনটি বিল আইনে রূপান্তরিত হয়। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও বিলগুলো পাঠাতে অস্বীকার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। উপেক্ষা করেছিলেন দেশব্যাপী অব্যাহত কৃষক আন্দোলনকেও। সংসদে সংখ্যাধিক্যের জোরে যা তিনি বলবৎ করতে চেয়েছিলেন, দেশের কৃষক মহল তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। কৃষকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করেন দিল্লী অবরোধ। ৪০টির বেশি সংগঠন এক হয়ে গড়ে তুলেছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। কিন্তু মোদি ছিলেন অনড়, অটল। কৃষি আইন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও না নড়ার সংকল্পে অটল ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, কৃষকদের মনোবল ও ঐক্য ভাংতে সব চেষ্টাই করেছে শাসকদল বিজেপি। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা অবরোধে সামিল হওয়ায় তাদের ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘খালিস্তানি’ বলতেও দ্বিধা করেনি শাসক দল। একদিকে প্রশাসনিক দমন-পীড়ন, অকথ্য পুলিশী অত্যাচার; অন্যদিকে বিভিন্ন ধারায় মামলা দায়ের করে কৃষক ঐক্যে ভাঙনের চেষ্টা চালানো হয়েছে। দেড় বছর ধরে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সরকারের নীতি। অন্যদিকে কৃষকরাও ছিল আন্দোলনে অনড়। অবশেষে দেড় বছর পর কৃষকরা অর্জন করেছেন মধুর জয়। কিন্তু জয় সত্ত্বেও কৃষকরা সন্দেহমুক্ত নন। প্রধানমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণার পরেই সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা বিবৃতি দিয়ে জানায়, শুধু মুখের কথায় তারা ভুলছেন না। সংসদে আইন রদ না হওয়া পর্যন্ত তারা অবরোধ ও আন্দোলন তুলবেন না। এতদিন অপেক্ষায় থেকেছেন, আরও কিছুদিন অপেক্ষায় থাকবেন। ভারতীয় রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা ও অবিশ্বাসের এমন ঘাটতি আগে কখনও দেখা যায়নি। এমন অবস্থায় বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে মোদির প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠা বেশ কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সম্ভাব্য এমন বিপর্যয়ের প্রধান কারণ যে কৃষক আন্দোলন তা উপলব্ধি করছেন বিজেপি নেতারাও। তাই বলা চলে, অহংকার আর উপেক্ষার রাজনীতি পরাজয়ই ডেকে আনে।
কৃষি আইন নিয়ে বিজেপি সরকার বড় সমস্যার মধ্যে আছে। কৃষি আইন প্রণয়নের আগে ঐকমত্যের কোনো চেষ্টা করেনি মোদি সরকার। কিন্তু এ আইন বাতিল ঘোষণার পর সেই চেষ্টা শুরুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আগামী রোববার যে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হয়েছে, সেখানে কৃষকদের দাবি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় আলোচনার একটি প্রস্তাব শাসক দল বিজেপিতে বিবেচিত হচ্ছে। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যোগ দিতে পারেন। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় সংসদের প্রতিটি অধিবেশনের  আগে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার একটি রেওয়াজ রয়েছে। সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হচ্ছে ২৯ নবেম্বর। এর আগে সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি এই সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছেন। সেখানে সব দলের সংসদীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন। বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের পর আন্দোলনকারী কৃষক নেতারা যেসব প্রস্তাব রেখেছেন, তা নিয়ে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী নেতাদের অভিমত জানতে চাইতে পারেন। এরমধ্যে আইন করে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নির্ধারণের যে দাবিতে কৃষক নেতারা অনড়, সে সম্পর্কে সর্বদলীয় অভিমত জানতে চাওয়া হতে পারে বিশেষভাবে। এক বছর ধরে এই বিষয়ে আইন তৈরিতে সরকার রাজি হয়নি। তবে নিয়মিত এমএসপি বাড়ানো হয়েছে।
বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহার করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কৃষকদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষক নেতারা তাদের সাড়া দেননি। বরং প্রধানমন্ত্রীকে তারা খোলা চিঠি দিয়ে তাদের পুরনো ও নতুন দাবিগুলো জানিয়ে দিয়েছেন। তারা বলেছেন, শুধু আইন প্রত্যাহারই তাদের দাবি ছিল না। তারা এমএসপির আইনি রক্ষা কবচের দাবিও শুরু থেকে করে আসছেন। সেই সঙ্গে কৃষকনেতারা বলেছেন, নতুন বিদ্যুৎ আইন বাতিল করতে হবে। ক্ষেতে ফসলের গোড়া জ্বালানোর জন্য কৃষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আনা চলবে না। আন্দোলনের জন্য যাদের ধরা হয়েছে তাদের মুক্তি দিতে হবে এবং যাবতীয় মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। আন্দোলন করতে গিয়ে নিহত কৃষকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং লক্ষ্মীপুর খেরির গাড়ি চাপা দেয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করতে হবে। এই দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এমএসপি আইন। সরকার এই দাবিটি নিয়েই বিরোধীদের মতামত জানতে বেশি আগ্রহী।
কৃষকদের দাবি বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়ে কৃষক নেতাদের বলেছিলেন, তাদের সাথে আলোচনায় বসুন। এর জবাবে কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেছেন, কোনো কমিটিরই প্রয়োজন নেই, এতে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই হবে না। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে টিকায়েত আরো বলেছেন, এমএসপির  আইনি বৈধতা দাবি করে ২০১১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে যে রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন, সেই রিপোর্ট বলবৎ করলেই সমস্যা মিটে যায়। টিকায়েতের ভাষায়, প্রধানমন্ত্রীর অফিসেই সেই রিপোর্ট রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদিকে এখন বলবৎ করতে হবে মুখ্যমন্ত্রী মোদির সুপারিশ। উল্লেখ্য যে, ২০১১ সালে যে কমিটি এমএসপি সংক্রান্ত ওই রিপোর্ট তৈরি করেছিল, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ওই কমিটির প্রধান। এখন বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়ে গেছে। আলাদাভাবে তিনটি আইন খারিজের জন্য তিনটি পৃথক বিল না এনে একটি বিলেই তা করার চেষ্টা চলছে। এনডিটিভি আরো বলেছে, এমএসপি নিয়ে কি করা যেতে পারে সেই ভাবনাই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়ে। ভারতের বিতর্কিত কৃষি আইন, কৃষকদের আন্দোলন এবং একরোখা মোদি সরকারের নতিস্বীকারও বর্তমান সমাধান-প্রচেষ্টায় উপলব্ধি করার মতো অনেক বিষয় আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনো সরকার যখন দাম্ভিক হয়ে যায়, তখন সেই সরকার জনগণ কিংবা বিরোধী দলের যৌক্তিক বক্তব্যকেও গুরুত্ব দিতে চায় না। ফলে দেখা দেয় আন্দোলন এবং সংঘাতের পরিবেশ। এতে দেশের ক্ষতি হয় এবং প্রাণ যায় বহু মানুষের। জনগণ ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হলে অবশেষে ক্ষমতাবান দাম্ভিক সরকাকেও পরাজয় মেনে নিতে হয়। এখানে বলার মতো বিষয় হলো, সরকার তো মানুষ দিয়েই গঠিত হয়। নেতৃস্থানীয় মানুষরা যদি দেশ ও জনগণকে ভালোবাসেন, নীতি ও নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেন- তাহলে অযথা সংঘাত থেকে রক্ষা করতে পারেন দেশকে। বর্তমান সভ্যতায় দেশের সাথে দেশে, সরকারের সাথে জনগণের সংঘাতের যে চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে আস্থার সংকট। নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ এবং মানবিক মূল্যবোধ ছাড়া আস্থার সংকট দূর করা যাবে কী?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ