শুক্রবার ২৪ মার্চ ২০২৩
Online Edition

ওষুধের গুণ-মান এবং চিকিৎসার ব্যয়

চিকিৎসার নামে দেশে আসলে যে চরম বিশৃংখলা ও স্বেচ্ছাচারিতা চলছে- সে ব্যাপারে ইদানীং প্রায় নিয়মিতভাবেই গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। এসব রিপোর্টের সামনে ডাক্তার বা চিকিৎসকদের রাখা হলেও অন্তরালে রয়েছে ওষুধের ব্যবসায়ীরা। রয়েছে নাম করা বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধ কোম্পানিও। ভীতি ও উদ্বেগের কারণ হলো, সব জেনেও সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় খাদ্যপণ্যের মতো সাধারণ ওষুধের পাশাপাশি ভেজাল দেয়া হচ্ছে এমনকি জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধেও। ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধে এরই মধ্যে ছেয়ে গেছে দেশের ওষুধের বাজার। এসব বিষয়ে জানা সম্ভব হচ্ছে না বলে জনগণও ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধই কিনছে এবং খাচ্ছে। পরিণতিতে তারা শুধু অসুস্থ ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছে না, নানা অসুখে ভুগে বহু মানুষ মারাও যাচ্ছে। এ ধরনের ওষুধের তালিকা বেশ দীর্ঘ। প্রস্তুতকারী কোম্পানির সংখ্যাও দিন দিন অনেক দীর্ঘ হচ্ছে।
ওষুধগুলোর মধ্যে এই সময়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় করোনার টিকা তো রয়েছেই, রয়েছে ক্যান্সারসহ মারাত্মক কিছু রোগের জন্য ব্যবহৃত দুষ্প্রাপ্য ও খুবই দামী বিভিন্ন ওষুধও। তাছাড়া পেনিসিলিন ও সেফালোস্পেরিনসহ অ্যান্টিবায়োটিক ধরনের কিছু বিশেষ ওষুধও রয়েছে, যেগুলো কঠিন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে জানানো হয়েছে, দেশের অন্তত ১০ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার পাশাপাশি জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু সব জানা সত্ত্বেও কোনো একটি ওষুধের ব্যাপারেই সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
ঘটনাপ্রবাহের অন্য দিকটিতে রয়েছে ওষুধের দাম ও মান। গতকাল বুধবার একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে দেশে চিকিৎসা ব্যয় শুধু বেড়েই চলেছে। ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ওষুধে এবং বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের বিভিন্ন গবেষণায় এবং সেগুলোর ভিত্তিতে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালের তুলনায় প্রাইভেট ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালের পরীক্ষায় ১৩ গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। চিকিৎসায়ও চলছে একই অবস্থা। উদাহরণ দিতে গিয়ে রিপোর্টে জানানো হয়েছে, সরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় রোগী প্রতি ব্যয় যেখানে এক লক্ষ ৩৪ হাজার ৪৮৫ টাকা, প্রাইভেট ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয় সেখানে দুই লক্ষ ৪২ হাজার ৭৪ টাকা। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ-এর জন্য যেখানে চার লক্ষ ৪১ হাজার ৩৭৮ টাকা ব্যয় করলে চলে বেসরকারি হাসপাতালে সেখানে পাঁচ লক্ষ নয় হাজার ৫৯ টাকা ব্যয় করতে হয়। ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও একই আনুপাতিক হারে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় রোগী প্রতি ব্যয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ব্যয় যেখানে ১৭ হাজার ৩৮৫ এবং তিন হাজার ২৯৭ টাকা, প্রাইভেট ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয় সেখানে ৬৫ হাজার ৫৫১ এবং ৪১ হাজার ৬৩৭ টাকা।
এভাবে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতাল ও প্রাইভেট ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় ১৩ গুণ পর্যন্ত বেশি। বেসরকারি হাসপাতালে ওষুধের জন্যও জনগণকে চারগুণ বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হলেও তথ্যগুলো কিন্তু অনেক পুরনো। মাঝখানে পাঁচ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকার এমনকি নাম ধরে ধরে কমিটির উল্লেখ করা বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুত করা থেকে নিবৃত্ত থাকার জন্যও কোম্পানীগুলোকে নির্দেশ দেয়নি। এর ফলে একদিকে ওইসব কোম্পানি বহাল তবিয়তে তাদের ওষুধ প্রস্তুত করার রমরমা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের এই প্রশ্নসাপেক্ষ নমনীয় নীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার নামান্তর মনে করে নতুন নতুন আরো কিছু কোম্পানীও ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধ প্রস্তুত করার অঘোষিত প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। প্রকাশিত রিপোর্টে এমন বেশ কয়েকটি কোম্পানীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে- যেগুলো বর্তমানে ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধ প্রস্তুত করার কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধ প্রস্তুত করার এবং যথেচ্ছভাবে চিকিৎসার ব্যয় চাপানোর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে মারাত্মক অপরাধই করে চলেছে ব্যবসায়ী নামের একটি বিশেষ গোষ্ঠী। গণমাধ্যমের রিপোর্টে নাম ধরে ধরে তাদের সম্পর্কে জানানোও হয়েছে। কিন্তু কোনো ওষুধ কোম্পানী বা হাসপাতালের ব্যাপারেই সরকারি কোনো বিভাগ বা দফতরের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখনো হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, বিষয়টি দেখা ও প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব যেসব সরকারি সংস্থার সেসবের কর্তাব্যক্তিদের বিশেষ ব্যবস্থায় ‘ম্যানেজ’ করে থামিয়ে রাখা হচ্ছে। এসবই সম্ভব হচ্ছে আসলে সরকারের গাফিলতির কারণে। এভাবে পুরো জাতিকেই ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
আমরা মনে করি, ভেজাল ও বিষাক্ত ওষুধের পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যয়ের ব্যাপারেও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সদিচ্ছা থাকলে এসব বিষয়ে জানার জন্য এখন আর কষ্ট করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, বিশেষজ্ঞ কমিটির পাশাপাশি অনেক সংস্থাই আজকাল ওষুধ, খাদ্যপণ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কে জরিপ ও গবেষণা করে থাকে। তাদের রিপোর্টও প্রকাশিত হয়। সরকার চাইলে এসব রিপোর্টের ভিত্তিতেই অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করতে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। আমরা তেমন ব্যবস্থা নেয়ার জন্যই দাবি জানাই।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ