রবিবার ১৯ মে ২০২৪
Online Edition

ঝরনার পানিতে একাকার শত শত মানুষ

বর্ষা মৌসুমে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের সাত পাহাড়ি ঝরনায়

চট্টগ্রাম ব্যুরো ও মিরসরাই সংবাদদাতা : দীর্ঘ সময় করোনাকালীন সময়ে ঘরবন্দী থাকার পর মনটা যেন ছটফট করছে একটু ঘুরে বেড়াতে। কার না মন চায় বেড়াতে। আর ঘুরার স্থান যদি হয় অপরূপ পাহাড়ি ঝরনা, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তাই আর বসে না থেকে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকরা ছুটে আসছেন সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। এখানে অন্যান্য পর্যটন স্পট ছাড়াও রয়েছে সাতটি পাহাড়ি ঝরনা। প্রতিদিন এসব ঝরনাগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন শত শত মানুষ। দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে সহজে ছুটে আসছেন এখানে। কেউ কেউ লোকাল বাসে, কার, মাইক্রো, হাইচ, নোহা, লেগুনা ও অনেকে রিজার্ভ বাসে করে উপস্থিত হচ্ছেন এক নজর দেখতে। তবে বন্ধের দিন সবকটি ঝরনায় পর্যটকদের ঢল নামে। দল বেঁধে ছুটে আসে লোকজন। এ যেন এক অন্যরকম মিলন মেলা।এখানে রয়েছে আট স্তর বিশিষ্ট খৈয়াছড়া ঝরনা, রূপসী ঝরনা, নাপিত্তাছড়া ঝরনা, মহামায়া ঝরনা, সোনাইছড়া ঝরনা, বোয়ালিয়া ঝরনা ও বাওয়াছড়া হরিনাকুন্ড ঝরনা। অপার সৌন্দর্যমন্ডিত প্রকৃতির সঙ্গে এখানকার মুখরিত জনপদ হয়ে উঠছে আরও মুখর।
নান্দনিক সৌন্দর্যের আরেক নাম খৈয়াছড়া ঝরনা : প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে দেশের ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ। প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি সেতুবন্ধন করে, সবুজের চাদরে ঢাকা বনানী রূপের আগুন ঝরায়, যেখানে প্রকৃতি খেলা করে আপন মনে, ঝুম ঝুম শব্দে বয়ে চলা ঝরনাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে ধুয়ে সজীব করে তুলছে খৈয়াছড়া ঝরনায়। গ্রামের সবুজ শ্যামল আঁকা বাঁকা মেঠো পথ পেরিয়ে শরীরটা একটু হলেও ভিজিয়ে নেয়া যায় নিঃসন্দেহে। আট স্তরের দেশের অন্যতম বড় প্রাকৃতিক ঝরনাটি দেখতে প্রতিদিন ছুটে যাচ্ছে হাজার হাজার দেশি বিদেশি পর্যটক। উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৪.২ কিলোমিটার পূর্বে ঝরনার অবস্থান। এরমধ্যে ১ কিলোমিটার পথ গাড়িতে বাকি পথ হেঁটে যেতে হবে।
 মহামায়া ঝরনা : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার ঠাকুর দীঘি বাজারের এক কিলোমিটার পূর্বে। ছায়াঘেরা সড়ক। দেশের যে কোন স্থান থেকে এসে লেকে যেতে রাস্তায় প্রস্তুত আছে সিএনজি অটোরিক্সা। কিছুদূর পর দেখা মিলবে রেলপথ। রেল লাইন পেরুলেই কাছে টানবে মহামায়া। প্রাণের টানে ছুটে আসা পথ যেন ক্রমশই বন্ধুর হতে চাইবে মনের কোণে জাগা মৃদু উত্তেজনায়। দূর থেকে দেখা যায় প্রায় পাহাড়সম বাঁধ। উভয় পাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। বাঁধের ধারে অপেক্ষমান সারি সারি ডিঙি নৌকো আর ইঞ্জিনচালিত বোট। কিছুদূরেই দেখা যাবে পাহাড়ের কান্না। অঝোরে কাঁদছে। অথচ তার কান্না দেখে নিজের কাঁদতে ইচ্ছে হবে না। উপরন্তু কান্নার জলে গা ভাসাতে মন চাইবে। তারও পূর্বে যেখানে লেকের শেষ প্রান্ত, সেখানেও বইছে ঝরনাধারা। কি নীল, কি সবুজ, সব রঙের ছড়াছড়ি যেন ঢেলে দেওয়া হয়েছে মহামায়ার প্রকৃতিতে। এর সঙ্গে মিশতে গিয়ে মন এতটাই বদলে যাবে, যেন মন বারবার ঘুরে আসতে চাইবে ফেলে আসা স্মৃতিতে।
 রূপসী ঝরনার রূপে পাগল হবে যে কেউ : আপনার মনটা যতই খারাপ থাকুক। রূপসী ঝরনায় পা রাখলে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে নিশ্চিত। রূপসী ঝরনার রূপের জাদু আপনাকে পাগল করবে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের আরেক নাম বড় কমলদহ রূপসী ঝরনা। আঁকাবাঁকা গ্রামীণ সবুজ শ্যামল মেঠো পথ পার হয়ে পাহাড়ের পাদদেশে গেলেই শোনা যাবে ঝরনার পানি গড়িয়ে পড়ার অপরূপ নুপুরধ্বনি। দুই পাশে সুউচ্চ পাহাড়। সাঁ সাঁ শব্দে উঁচু পাহাড় থেকে অবিরাম শীতল পানি গড়িয়ে যাচ্ছে ছড়া দিয়ে। রূপসী ঝরনা প্রথম দেখেই তার রূপে পাগল হবে যে কেউ। মেঘের মতো উড়ে আসা শুভ্র এ পানি আলতো করে ছুঁয়ে দেখলেই এর শীতল পরশ মুহূর্তে ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে। টলটলে শান্ত পানির চুপচাপ বয়ে চলার ধরনই বলে দেবে এর উৎস অবশ্যই বিশাল কিছু থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্যটকেরা আবিষ্কার করবেন লাল আর নীল রঙের ফড়িঙের মিছিল! যত দূর পর্যন্ত ঝিরিপথ গেছে তত দূর পর্যন্ত তাদের মনমাতানো ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জন শোনা যায়। চলার পথে শোনা যায় হরিণের ডাক। অচেনা পাখিদের ডাক, ঘাসের কার্পেট বিছানো উপত্যকার সাথে। রূপসী ঝরনার পানিতে গোসল করার লোভ সামলানো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। দেশের বিভিন্ন স্থান হতে যে কোন বাস যোগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড়দারোগাহাট বাজারে নামবেন। এরপর সিএনজি অটোরিক্সা যোগে বাজারের উত্তর পাশের ব্রিকফিল্ড সড়ক দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত যাবে। এরপর পায়ে হেঁটে ঝরনায় যাওয়া যাবেন। অথবা যে কোন বাস থেকে ব্রিকফিল্ড সড়কের মাথায় নেমে অটোরিক্সা ছাড়া আধা কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যেতে পারবেন।
 বাওয়াছড়ার অপরূপ দৃশ্য পর্যটকদের নজর কাড়ে : উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মধ্যম ওয়াহেদপুর বাওয়াছড়া পাহাড়িয়া এলাকায় যুগ যুগ ধরে ঝরনা প্রবাহিত হচ্ছে। সবুজ শ্যামল পাহাড়িয়া লেকে পাখিদের কলতানে আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা সকলের প্রান জুড়িয়ে যাবে বাওয়াছড়া হরিণাকুন্ড ঝরনায়। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ স্থানে ছুটে আসে শত শত পর্যটক। লোকেশন : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড় কমলদহ বাজার থেকে ২ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এটি অবস্থিত।
অনিন্দ্য সুন্দর বোয়ালিয়া ঝরনা : চারদিকে সবুজ পাহাড় আর পাহাড়। সবুজের নান্দনিকতা, বিস্তীর্ণ পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিবেষ্টিত মিরসরাই। এখানে রয়েছে বিমোহিত হওয়া প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় সিক্ত এই এখানকার জনজীবন যেমন সৌহার্দপূর্ণ তেমনি প্রকৃতির মমতায় ভরপুর।প্রকৃতির কাছাকাছি কিছু সময় কাটানোর ইচ্ছে কার না হয়? এজন্য এক উপযুক্ত স্থান বোয়ালিয়া ঝরনা। এতে রয়েছে ছোট-বড় অন্তত ৫টি শাখা ঝরনা এবং অনিন্দ্যসুন্দর উঠান ঢাল নামে একটি পাথুরে ঢাল। দীর্ঘ সময় করোনার বন্দী জীবনে হাঁফিয়ে উঠেছে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। তাই বর্ষা মৌসুমে আর ঘরে বসে না থেকে একটু গা ভেজাতে বোয়ালিয়া ঝরনায় ছুটে যাচ্ছেন পর্যটকরা। এ ট্রেইলের মূল ঝরনা হলো বোয়ালিয়া এবং এ ঝরনায় যাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। বোয়ালিয়া ঝরনার বিশেষত্ব হলো এ ঝরনার আকৃতি অদ্ভুত ধরনের। এর আকৃতি অনেকটা ব্যাঙের ছাতার মতো এবং বোয়াল মাছের মাথার মতো বিধায় হয়তো এই ঝরনার নাম হয়েছে বোয়ালিয়া। বোয়ালিয়া ভারি বর্ষায় খুব মারাত্মক রূপ ধারণ করে এবং এ সময়টাতেই এ ঝরনাটি সবচেয়ে সুন্দর। মূল ঝরনার পানি যেখানটায় পড়ে সেটা অনেকটা গুহা কিংবা গভীর খাদের মতো। ভরা বর্ষায়, সাঁতরে এই ঝরনায় যেতে হয়। ঝরনার উপরে আরো ছোট ছোট ঝরনা আছে এবং গিরিপথ খুবই সুন্দর।তবে বোয়ালিয়ার উপরে যাওয়াটা খুবই বিপজ্জনক এবং ভরা বর্ষায় প্রায় অসম্ভব।বোয়ালিয়া ট্রেইলের মূলত দুইটা পার্ট, উত্তর পূর্ব আর দক্ষিণ পূর্ব। দক্ষিণ পূর্বে বোয়ালিয়া যেটি খুব বেশি দূরে না। তবে উত্তর পূর্বেও ট্রেইলে বিভিন্ন নামের আরো চার-ছয়টি ছোট বড় ঝরনা আছে। বেশিরভাগ ভ্রমণপিপাসু বোয়ালিয়া দেখে চলে আসে কিন্তু উত্তর দিকের ছড়া হয়ে উঠান ঢাল কিংবা নহাতিকুম ঝরনা পর্যন্ত যায় না। অবশ্য উঠান ঢালে যেতে হলে খুব দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়। পুরো পথটা যেতে হয় ছড়া দিয়ে হেঁটে হেঁটে। বর্ষাকালে ছড়ায় প্রচুর পানি থাকে। এমনকি কোথাও কোথাও একেবারে বুক সমান পানি। এই ছড়ায় প্রচুর বালি আর অসমান অনেক পাথরের কারণে হাঁটা অনেক কষ্টসাধ্য। তার উপর ভয়ংকর বাঁশের কঞ্চি কিংবা গাছের ঢাল। এই ছড়াটা বেশ অপরিষ্কার মনে হয়েছে। সম্ভবত এ পথে যাতায়াত কম বলে পাথরগুলো মারাত্মক পিচ্ছিল। আঁকাবাঁকা এই গিরিপথে প্রচুর বাঁশঝাড় চোখে পড়ে। পথে ছোট ছোট ঝরনার দেখা মিলে। গিরিপথ হয়ে এক ঘন্টা হাঁটার পর উঠান ঢালের দেখা মিলবে। এ ঢালটা অসম্ভব রকমের সুন্দর। পাহাড়ের বুকে পাথরের আস্তরণ আর পানি নিচের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে কলকল করে, এমন সুন্দর দৃশ্য দেখলে যে কারোই মন জুড়াবে। লোকেশনঃ দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই সদরে গাড়ি থেকে নামতে হবে। এরপর মিরসরাই বাজার হয়ে পূর্ব দিকে সিএনজি যোগে জনপ্রতি ১৫ টাকা ভাড়ায় ব্রাক পোল্ট্রি ফার্ম অর্থাৎ পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে নামতে হবে। সেখান থেকে ছড়া ধরে কিংবা মানুষের তৈরি পাহাড়ি পথ ধরে কিছুটা হাঁটলেই বড় ছড়া পাওয়া যাবে। সেখান থেকে উত্তরে গেলে উঠান ঢাল এবং নহাতিকুম ঝরনা আর দক্ষিণ পূর্বে গেলে বোয়ালিয়া ঝরনা পাওয়া যাবে।
থাকা ও খাওয়া: মিরসরাই পৌর সদর, বড়দারোগাহাট, ও ছোট কমলদহ বাজারে খাওয়ার হোটেল রয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকরা থাকা ও খাওয়ার জন্য যেতে পারেন মিরসরাইয়ের বিভিন্ন পর্যটন স্পট থেকে গাড়ি যোগে মাত্র ৪০-৫০ মিনিটের পথ চট্টগ্রাম শহরের প্রবেশ মুখে একেখান ও অলংকারে কুটুম্ববাড়ি রেস্তোরায়। থাকার জন্য একেখানে মায়ানী রিসোর্ট ও অলংকারে রোজ ভিও হোটেলে। ঈদেও ২৪ ঘন্টা খোলা থাকবে রেষ্টুরেন্ট ও আবাসিক এই হোটেল দুটি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ