বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

করোনা ও মূল্যস্ফীতি

ইবনে নূরুল হুদা : সুবেদার শায়েস্তা খান বাংলার সপ্তদশ শতাব্দীর শাসক হলেও তার সময়ের দ্রব্যমূল্য এখনো আলোচনার বিষয়। জানা যায়, সে সময় দ্রব্যমূল্য ছিল খুবই কম। এমনকি তখন টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এতে প্রমাণ হয়, শায়েস্তা খান মূল্যস্ফীতিকে ঠিকমত ‘শায়েস্তা’ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমরা ঠিক উল্টোবৃত্তেই রয়ে গেছি। মূল্যস্ফীতিই এখন আমাদেরকে ঠিকমত ‘শায়েস্তা’ করতে শুরু করেছে; প্রকাশ পাচ্ছে রাষ্ট্রের অসহায়ত্ত ও দুর্বলতা। যা সরকারের কার্যকারিতাকেও করছে প্রশ্নবিদ্ধ।
আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতির নানাবিধ কারণ রয়েছে। পণ্যস্বল্পতা, সরবরাহে অপ্রতুলতা, মজুদদারি, বাজার সিন্ডিকেট ও অতি মুনাফাখোরী মূলত দ্রব্যের উচ্চমূল্যের জন্য দায়ী হলেও সংশ্লিষ্টরা তা স্বীকার করতে চান না। নিজেদের উপর্যুপরি ব্যর্থতা ঢাকার জন্য তারা একেক সময় একেক কথা বলেন। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তারা মূল্যস্ফীতির কথা স্বীকারও করতে চান না। ১/১১ এর জরুরি সরকারের সময়ে মূল্যস্ফীতির  বিষয়টি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হলে সে সময়ের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘শায়েস্তা খানের বাজার দর এখন তো আর সম্ভব নয়’। এতে প্রমাণ হয় তারা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কতটা অসহায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সুবেদার শায়েস্তা খানের কোন জুড়ি এখনও নেই।
দেশে মূল্যবৃদ্ধি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অনেক সময় নানা অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো হয়। মনে করা হয় যে, পরিস্থিতি উন্নতি হলে তা আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হয় না। একবার দাম বাড়লে তা আর কমে না। সে ধারাবাহিকতায় করোনা মহামারির অজুহাতে মূল্যবৃদ্ধির মহড়া বেশ আগেই শুরু হয়েছে। এ সময় জনগণের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। শুধু নিত্যপণ্য কিনতে গিয়েই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সাম্প্রতিক বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে অন্তত ১২টি নিত্যপণ্যের দাম। এরমধ্যে এক সপ্তাহের ব্যবধানে আদা ও হলুদের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪০ টাকা। অর্থাৎ গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে এক কেজি আদা কিনতে ভোক্তাদের ৪০ টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে যে আদার দাম ছিল ১শ’ টাকা কেজি, এখন তা ১শ’ ৪০ টাকা। একইভাবে প্রতি কেজি দেশী হলুদের দামও বেড়েছে ৪০ টাকার মতোই। অর্থাৎ গত সপ্তাহে যে হলুদের দাম ছিল ১শ’ ৪০ টাকা কেজি, এখন তা ১শ’ ৮০ টাকা।
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির দেয়া তথ্যে জানা গেছে, গত এক বছরে ভোজ্যতেল ও রসুনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৭০ শতাংশ। টিসিবির হিসাবে ৭০ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে খোলা পাম অয়েলের দাম। একইভাবে আমদানি করা রসুনের দাম বেড়েছে ৭০ শতাংশেরও বেশি। এছাড়া ৫০ শতাংশেরও বেশি দাম বেড়েছে পেঁয়াজের। গত এক বছরের ব্যবধানে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এছাড়া খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৮১ শতাংশ। গত এক বছরের ব্যবধানে সয়াবিন তেল ৫ লিটার বোতলের দাম বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। এক লিটার বোতলের দাম বেড়েছে ৪১ শতাংশ। পাম অয়েল সুপারের দাম বেড়েছে ৬১ শতাংশ। একইভাবে এক বছরের ব্যবধানে দেশী হলুদের দাম বেড়েছে ৪১ শতাংশ। মসলা জাতীয় লবঙ্গের দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ। তেজপাতার দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশ। চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে ২৩ শতাংশ।
বাজার চিত্রে দেখা যায়, সব ধরনের আটা ও ময়দার দাম বেড়েছে অনাকাক্সিক্ষতভাবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে খোলা আটার দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারি সাধারণ মানুষের আয়-রোজগারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ অবস্থায় জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছেন নিম্নবিত্তের মানুষজন। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান থাকা জরুরি হলেও এ বিষয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্টরা রীতিমত উদাসীন। বিষয়টি রীতিমত রহস্যজনক। ফলে সৃষ্টি হয়েছে জনদুর্ভোগ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের এই সময়ে আমদানি করা রসুনের দাম ছিল ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি। সেই রসুনের দাম এখন ১১০ টাকা থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে গত বছরের এই সময়ে দেশী হলুদের দাম ছিল ১৪০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। এখন সেই হলুদ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা থেকে ২৩০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া ২০২০ সালের এই সময়ে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় এক লিটার খোলা পামওয়েল পাওয়া যেত। এখন সেই পামওয়েল বিক্রি হচ্ছে ১১৪ থেকে ১১৬ টাকা দরে। একইভাবে গত বছরে যে পাম অয়েলের (সুপার ) দাম ছিল ৭১ থেকে ৭৫ টাকা, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ১১৬ টাকা থেকে ১২০ টাকা লিটার দরে। গত বছরের এ সময়ে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ছিল ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা। এখন সেই পেঁয়াজের দাম ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি।
এছাড়া বাজারে নতুন করে তেল, ডাল ও চিনির দাম গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে প্রায় পাঁচ টাকা করে বেড়ে গেছে। তবে গত সপ্তাহে বাড়তি দামে বিক্রি হওয়া কাঁচামরিচের দাম কমে এখন প্রতি কেজি ১শ’ টাকায় নেমে এসেছে। এছাড়া স্থিতিশীল রয়েছে কিছু সবজির দাম।
রাজধানীর বাজারগুলোতে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৩৮ থেকে ১৪০ টাকা। যা আগের সপ্তাহে ছিল ১৩৩ থেকে ১৩৫ টাকা। একইসঙ্গে বেড়েছে পাম তেলের দামও। একইভাবে চিনির দাম কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা বেড়ে ৮০ টাকায় ঠেকেছে। আর গত সপ্তাহে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হওয়া মসুর ডাল এখন ১০০ থেকে ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে চালের খুচরা বাজারে মিনিকেট ৬২ থেকে ৬৫, আটাশ ৫০ থেকে ৫৫, স্বর্ণা ৪৭ থেকে ৫০ ও নাজিরশাইল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়লেও দাম সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। এক কেজি ওজনের বেশি ইলিশ প্রতিকেজি ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোট আকৃতির ইলিশ ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সর্বোচ্চ ১৪০০ টাকা কেজি দরে ইলিশ বিক্রি করতেও দেখা গেছে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এ বছর ১০ শতাংশ বেশি দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে।
মুদ্রাস্ফীতির সাথে মূল্যস্ফীতি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও বৈশ্বিক মহামারি করোনাকে অজুহাত বানিয়ে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট কোনভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা সরকারে দায়িত্ব হলেও এক্ষেত্রে তারা খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের তেমন মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হয় না।
সম্প্রতি করোনাকে অজুহাত বানিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেছে এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী। তাছাড়াও নানাবিধ  কৌশল অবলম্বন করে বাজার পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলা হচ্ছে। ফলে ক্রেতা-ভোক্তারা বড় ধরনের বিপাকে পড়েছেন। মূলত, মজুদদারি ও অনিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের কারণেই মূল্যস্ফীতি এখন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমতাবস্থায় বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
মূলত, করোনার নেতিবাচক প্রভাবে জাতীয় অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হয়ে  পড়েছে। দীর্ঘ লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় নেমে এসেছে বিপর্যয়। এখন কঠোর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হলেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এখনও ছন্দ ফিরে আসেনি। এমতাবস্থায় চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, তরকারি, মাছ, মাংসের অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে।
এমতাবস্থায় শুধু দরিদ্র মানুষ নয় বরং নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও নানারকম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কিছু অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারণে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য আটকে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি  মোকাবেলা ও দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে এসব অর্বাচীনদের কঠোর হাতে দমন আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে বাজারে মনিটরিং বাড়ানো, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, অনিয়ম প্রমাণিত হলে বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। যেসব ব্যবসায়ী অসৎ ও অনৈতিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে তাদেরকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা দরকার। প্রয়োজনে তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের মতো ব্যবস্থাও নেয়া যেতে পারে। অন্যথায় মূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কোনভাবেই সম্ভব হবে না।
মূলত, প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের যথাযথ  পদক্ষেপ এবং ব্যবসায়ীদের সচেতনতা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে। সরকার ইতোমধ্যে ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্য সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এতে কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমবে বলে আশা করা যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যদি নাগালের মধ্যে থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হ্রাস পাবে। তাই সাধারণ মানুষের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সুলভ মূল্যে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে এসব পদক্ষেপ সম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে এখনো সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে বাজার পরিস্থিতি এখন অতি মুনাফাখোরী ও সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। যা কোন ভাবেই কাক্সিক্ষত নয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটি চলমান প্রক্রিয়া হলেও তা সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা সরকারের দায়িত্ব। মূল্যবৃদ্ধির আগেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বৃদ্ধি করা দরকার। কিন্তু একতরফাভাবে মূল্যবৃদ্ধি অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। যা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষ শায়েস্তা খান আমলের বাজার মূল্য চায় না বরং দ্রব্যমূল্য যাতে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে সেটিই সকলের প্রত্যাশা।
তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণে এবং মজুদদারি ও বাজার সিন্ডিকেট মোকাবেলায় একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করে জনদুর্ভোগ মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। মানুষের ক্ষয়ক্ষমতার সাথে সঙ্গতি রেখেই প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা দরকার। অন্যথায় জনদুর্ভোগ ঠেকানো যাবে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ