শুক্রবার ৩১ মার্চ ২০২৩
Online Edition

কুরবানি- ঈদুল আযাহা ও আমাদের করণীয়!

অধ্যাপক এবিএম ফজলুল করিম

কুরবানি: কুরবানি হলো আল্লাহ প্রদত্ত সমস্ত শরীয়াতের ইবাদাত ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশবিশেষ। যেটা যুগ যুগ ধরে সকল নবীর উম্মতদের প্রতি আল্লার হুকুম এবং একই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নিয়েমে কুরবানি করার আদেশ দিয়েছেন। মানুষ যেসব পদ্ধতিতে আল্লার ছাড়া ভিন্ন ভিন্ন মা'বুদের এবাদত করে এ সমস্ত এবাদত নিষিদ্ধ করে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে দেয়াই হচ্ছে ইবাদাতের ক্ষেত্রে একত্ববাদের অন্যতম মৌলিক দাবি। ঠিক এমনিভাবে মানুষ তার নিজের মনগড়া উপাস্যদের জন্য পশু বলি করে আসছে। আল্লাহর শরীয়াতে পশু কুরবানিকেও গায়রুল্লাহর জন্য একেবারে হারাম এবং আল্লাহর জন্য ওয়াজিব করে দিয়েছে। আল্লাহর নামে কুরবানি করাই হচ্ছে ইবাদাত। কুরবানি কখন করা হবে, কোথায় করা হবে, কিভাবে করা হবে, কি দিয়ে করা হবে এ সমস্ত বিস্তারিত নিয়মাবলী মোটেই কোনো মৌলিক বিষয় নয়। বিভিন্ন যুগের, জাতির ও দেশের নবীদের শরীয়াতে অবস্থার প্রেক্ষিতে এ বিস্তারিত বিষয়াবলীতে পার্থক্য ছিল। কিন্তু সবার মূল প্রাণশক্তি ও উদ্দেশ্য একই রয়েছে। যা মহান আল্লাহ এভাবে বলেছেন : বলো, নিশ্চয় আমার নামায, আমার কুরবানি সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য, (সূরা আল- আনয়াম ১৬২)।

আদিকাল থেকেই কুরবানির প্রচলন : দুনিয়ায় মানব বসতির আদিকাল থেকেই কুরবানির প্রচলন শুরু হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আমাদের আদি পিতা ও নবী আদম (আ.) এর সন্তান হাবিল ও কাবিল এর মাধ্যমেই ছিল প্রথম কুরবানি। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন :

আর তাদেরকে আদমের দু'ছেলের সঠিক কাহিনীও শুনিয়ে দাও। তারা দুজন কুরবানি করলে তাদের একজনের কুরবানি কবুল করা হলো, অন্য জনেরটা কবুল করা হলো না। সে বললো, “আমি তোমাকে মেরে ফেলবো। সে জবাব দিল, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের নজরানা কবুল করে থাকেন।” (সূরা আল-মায়িদাহ ২৭) 

আদি পিতা আদম (আ.)-এর দুই পুত্র কাবীল ও হাবীলের দেওয়া কুরবানি থেকেই কুরবানির ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপর এটা জারী ছিল। আমাদের উপর যে কুরবানির নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক শিশু পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে আল্লাহর রাহে কুরবানি দেওয়ার অনুসরণে সুন্নাতে ইবরাহীমী' হিসেবে চালু হয়েছে। মক্কা নগরীর জনমানবহীন 'মিনা' প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহীম ও ইসমাঈল আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে ‘ঈদুল আযহা' বা কুরবানির ঈদ। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের প্রকৃষ্ট নমুনা এই কুরবানিতে প্রতীয়মান। 

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছা.) বলেছেন, 'সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়'। এটি ইসলামের একটি মহান নিদর্শন' যা সুন্নাতে ইবরাহীম' হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানি করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহ সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কিতাব ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত।

ঈদুল আযাহাঃ “লিকুল্লি কাওমিন ঈদ, হাযা ঈদুনা।” প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব উৎসব রয়েছে। ঠিক তেমনি আমাদের জন্যও তেমনি দুটো উৎসব রয়েছে। মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক চাহিদা মোতাবিক দুঃখের পরে সুখ এবং বিষাদের পরে আনন্দের একটি অপরিবর্তনীয় রীতি বা নিয়ম পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রচলিত রয়েছে। এমনি আনন্দের সুসংবাদ দিতে গিয়ে বিশ্ব-মানবতার খাঁটি বন্ধু ও মুক্তিকামী হয়রত মুহাম্মাদ (সা.) উপরোক্ত কথা বলেছিলেন। 

পৃথিবীতে যেমন অনেক জাতির মানুষ রয়েছে, তেমনি রয়েছে তাদের আনন্দ, বেদনা প্রকাশে বিভিন্ন ধরনের বিশেষ দিন। অন্যান্য জাতির ন্যায় মুসলমানদের কতোগুলো স্মরণীয় দিন রয়েছে, যেসব দিনে তারা নানা রুপ আনন্দ উৎসব পালন করে থাকে। কিন্তু ঈদের আনন্দ ও অন্যান্য আনন্দের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। মহান আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের সওগাত সমৃদ্ধ হয়ে কুরবানির মাধ্যমে ত্যাগ-তিতিক্ষার শিক্ষার মাধ্যমে আনন্দের অনুপম মাধুরী এনে দিয়েছে ঈদুল আজহা। ঈদকে কেবলমাত্র আনন্দের বা পানাহারের উৎসব বলে মনে করলে চলবে না। বরং ঈদের উৎসব পালনের মাধ্যমে সৌভ্রাতৃত্ব, তাকওয়া অর্জন করা এবং আল্লাহর পথে প্রিয় জিনিস ত্যাগের মহান ও অনুপম তাৎপর্য রয়েছে তা উপলব্ধি করতে হবে।

ধর্মীয় অনুশাসন পালন করাই ঈদুল আজহার একমাত্র উদ্দেশ্য নয় বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল মানুয়ের পারস্পরিক সদ্ভাব, আন্তরিকতা এবং ভদ্র-নম্র আচরণ করা। আত্মীয় ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে বেশি বেশি মিলিত হওয়া প্রয়োজন। ঈদগাহে গিয়ে একত্রে নামাজ আদায় করতে হয়। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)ও খোলা ময়দানে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করতেন। নবীজীর মতন মুসলমানদের ধনী-দরিদ্র মিলিতভাবে এবং গরিব-দুঃখী সচ্ছল সবার সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ও কোলাকুলি করা কর্তব্য। এর মাধ্যমে আমরা একে অন্যের সৌভাগ্যের, আনন্দের অংশীদার হতে পারি। সুতবাং আমরা বলতে পারি ঈদ হচ্ছে একটি অনুপম সামাজিক উৎসব। আর ঈদুল আজহার উৎসব পালিত হয় ওয়াজিব নামাজ এবং কুরবানীর মাধ্যমে।

আর তাই দুম্বাই কুরবানী হয়ে গেল। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর মনে হলো তিনি তার পুত্রকেই কুরবানী দিলেন। ভেসে উঠলো সেখানে জান্নতী ছবি। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর মুখ থেকে ছুরি চালানোর সাথে সাথেই নিঃসৃত হচ্ছিল “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।” দুম্বার গলায় ছুরি চালিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ও হযরত ইসমাঈল (আ.) মুখেও ছিল ঐ একই ধ্বনি “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।” আর ঐ সময়ে উপস্থিত লাখো ফেরেশতাদের মুখেও ধ্বনিত হচ্ছিল ঐ একই দোয়া “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।”

কুরবানীর শিক্ষা ও আমাদের করণীয়ঃ প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো পিতা আছেন কিনা? যে তার কলিজার টুকরা পুত্রকে নিজ হাতে জবেহ করতে প্রস্তুত? কিন্তুু হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর প্রেমে পাগল-পারা হয়ে, যে কঠিনতর আদেশ স্বেচ্ছায় হাসি মুখে বরণ করে নিয়েছিলেন। এটাই প্রকৃত আল্লাহর আনুগত্য করা। তাই এটাই মুসলমানদের জন্য আনুগত্যের সঠিক নমুনা। কুরবানি মুসলমানদের আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, মহব্বত, প্রেম-ভালোবাসার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে উৎসাহ দেয়। ইব্রাহীম (আ.) এ কুরবানি আজও সূর্যের মতো প্রদীপ্ত, উজ্জ্বল এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা থাকবে। আর এ কারণেই আল্লাহর রাহে সুমহান কুরবানির নমুনারূপে উম্মতে মুসলিমার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে চিরদিন পালিত হবে। তাই পৃথিবীর সকল মুসলমান কুরবানি পালন করে আসছেন। এ আত্মত্যাগ বা কুরবানিী শিক্ষা এই যে, সাচ্চা মুসলমান এবং আনুগত্যকারীরাই তো সেই বান্দা, যে আল্লাহর রাহে তার সব কিছু কুরবানি করতে রাজি । তবেই তা হবে ইব্রাহীম (আ.) এর ত্যাগের নমুনা। মুসলমানদের জান ও মালের প্রকৃত মালিক আল্লাহ, তাই তো আল্লাহ আল-কুরআনে ঘোষণা করেছেন- “কুল ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকী ওয়া মাহ্ইয়া ইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহী রাব্বুল আলামীন।” অর্থাৎ বল, আমার নামাজ , আমার ইবাদত বন্দেগী, আমার দান খয়রাত উৎসর্গ, আমার জীবন-মরন সব কিছুই আল্লাহর জন্য। 

এ কথা কেবল মুখে বললে হবে না। মুসলমানদের বাস্তবজীবনে আল্লাহ দ্বীন কায়েমে এবং তাদের জান ও মাল আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি করতে হবে। গরিব-দুঃখী এতিম মানুষ যখন কুরবানির গোস্ত পেয়ে খুশী হয়, তখন আল্লাহও খুশী হন। আবার কুরবানীর চামড়ার টাকাও গরিব মিসকিনের মুখে হাসি ফুটাতে সাহায্য করে। সর্বোপরি কুরবানির শিক্ষা হলো আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসন কায়েম করার শিক্ষা গ্রহণ করা। তবেই একটি সুখি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব হবে।

তাই আজকের দিনে আমাদের প্রার্থনা আমরা যেন যথাযথ নিয়ম মেনে আল্লাহর রাহে কুরবানি দিতে পারি। আর আমাদের অর্থ হতে হবে হালাল এবং আমাদের নিয়ত হতে হবে কেবলমাত্র আল্লাহকে রাজী ও খুশি করা। ঈদে আমরা আত্মীয়স্বজন, গরীব  মিসকিন, এতিম ও অসহায় মানুষকে সার্বিকভাবে সহায়তা করা। মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে।

আসুন আজ ঈদুল আজহার এই পবিত্র দিনে বছরের বাকী দিনগুলোও নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পথে আমাদের জীবনকে পরিচালিত করার শপথ নেই। ঈদুল আজহার এই আনন্দ যেনো সারা বছর আমাদের জীবনকে ঘিরে রাখে এবং আমাদের জীবনকে আন্দময় করে রাখে। আর আমাদের উচিত কুরবানির ত্যাগের ন্যায় একামতে দ্বীনের কাজেও আত্মনিয়োগ করা। আমীন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ