বুধবার ২৯ নবেম্বর ২০২৩
Online Edition

কুরবানি ও এর বিধান

প্রফেসর ড. মো: ময়নুল হক, ইবি

কুরবানি: 

আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভের উদ্দেশে ঈদুল আযহার দিনগুলোতে বা আইয়্যামু তাশরিকে চতুষ্পদ জন্তু যবেহ করাকে কুরবানি বলা হয়। আহলুল ইলমের ইজমা হলো কুরবানি ইসলামী শরয়ী বিধান। এর হিকমাহ হলো আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা এবং ইব্রাহীমি সুন্নাহর পুনর্জীবন দান করা। রাসূল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় দু’টি কাবাশ বা বকরী কুরবানি করেছিলেন এবং সাহাবাগণও সে সময় কুরবানি করতেন। 

আল্লাহ তা’আলা সালাতের সাথে কুরবানির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন পবিত্র কুরআনুল কারীমের বেশ ক’জায়গায় এর বড়ত্ব, মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব বুঝানোর উদ্দেশ্যে। যেমন সূরা হাজ্জে: আমরা প্রতিটি জাতির জন্য কুরবানিকে রীতিসিদ্ধ বা শরয়ী বিধান করেছি যাতে তারা তাদেরকে প্রদত্ত রিযিক যা চতুষ্পদ জন্তুসমূহ থেকে দেয়া হয়েছে তার উপর আল্লাহর নাম স্মরণ করে বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। (সূরা হজ্জ) সূরা কাউসারে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঅত:পর আপনি সালাত আদায় করুন এবং পশু যবেহ করুন। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.), ইকরামা, আ’তা মুজাহিদ , হাসান, কাতাদাহ, কা’ব ইবনু মুহাম্মদ, দাহহাক, আ’তা আল-খোরাসানী, ইসমাঈল (রহ.) প্রমুখ বলেছেন:  হজ্জ আদায়ের পর কুরবানির উদ্দে্েয প্রেরিত পশুর রক্ত প্রবাহিত করাকেই অনহার বলে বুঝানো হয়েছে। তাফসীরে তাবারিতে এ সূরা অবতীর্ণ হওয়ার সময় কাল হুদায়বিয়ার সন্ধির সাথে সম্পৃক্ত বলা হয়েছে। ইমাম তাবারী (রহ.) সাঈদ ইবনু জুবাইর এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিলেন যেন তিনি সালাত আদায় করেন, সাথে নিয়ে আসা পশুগুলোকে যবেহ করেন এবং হুদাইবিয়া থেকে মদীনায় ফিরে যান। এটি একেবারেই স্পষ্ট যে, ’অনহার’ শব্দ দ্বারা আল্লাহ তা’আলা যা নির্দেশ করেছেন তা হলো  হে রাসূল (সা.) আপনি কুরবানির পশু যবেহ করুন। তাফসীর আল-মায়সার, আস-সা’দী, আল-ওয়াসীত্ব লিত ত্বনত্বাভী, আল-বাগাভী ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থসমূহেও ‘অনহার’ এর ব্যাখ্যায় কুরবানির পশু যবেহ করার কথা বলা হয়েছে। ইবনু আবি হাতিম একটি কঠিন মুনকার হাদীস উল্লেখ করেছেন (যা অগ্রহণযোগ্য) যাতে বলা হয়েছে: অতঃপর আপনি সালাত আদায় করুন এবং দুই হাত উত্তোলন করুন (বা রফউল ইয়াদাইন করুন)।

আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে  বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন যার সামর্থ আছে অথচ কুরবানি করবে না সে যেনো আমাদের ঈদগাহে না আসে। (ইবনু মাজাহ-২১২৩, মুসনাদে আহমদ-৮২৭৩)। সহীহুল জামে’-৬৪৯০, মুহাদ্দিস আলবানী এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। এ হাদীসে কুরবানি করার গুরুত্ব প্রদান এবং কৃপণতার শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। কুরবানিকে ওয়াজিব যারা বলেছেন এটি তাঁদের দলীল। ইবনু হাজর (রহ.) বলেছেন এ হাদীসের বর্ণনাকারীগণ সবাই নির্ভরযোগ্য কিন্তু এটি মারফুউ না মাওকুফ তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মাওকুফ হওয়া সঠিকতা সদৃশ। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন: তিনটি বিষয় আমার উপর ফরয কিন্তু তোমাদের উপর নফল- বিতর, কুরবানি এবং দ্বি-প্রহর এর সালাত।(মুসনাদে আহমদ-২০৫০, বায়হাকী, খ.-২,পৃ.৪৬৭)। আয়িম্যায়ে মুতাকাদ্বেমীন এবং মুতায়াখখেরিন এর বিশাল দল (আহমদ ইবনু হাম্বল, বায়হাকী, ইবনুস সালাহ, ইবনুল জাওযী ও ইমাম নববী রহ.সহ) এ হাদীসকে অধিক দুর্বল হাদীস বলেছেন। ইবনু হাজর (রহ.) বলেছেন: এ হাদীসের সনদে আবু জানাব আল-কালবী বর্ণনাকারী দুর্বল এবং মুদাল্লিস। তিনি একজন আনআনা পদ্ধতিতে হাদীস বর্ণনাকারী। যারা কুরবানিকে মুস্তাহাব বলতে চান তারা এ হাদীসকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। 

উরওয়াতুবনুয যুবাইর রা. আয়িশা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন: রাসূল (সা.) নির্দেশ দিলেন শিং ওয়ালা ছাগল নিয়ে আসতে যার পায়ের খুর কালো, পেটের অংশ বিশেষ কালো এবং চোখের পাপড়ি কালো। এ রকম ছাগল তাঁর কাছে নিয়ে আসা হলো যাতে তিনি কুরবানি করতে পারেন। অতঃপর রাসূল (সা.) আয়িশা (রা.) কে বললেন: ছুরি নিয়ে এসো, একে পাথরে ঘঁষে ধারালো বানাও। আয়িশা রা. তাই করলেন। অতঃপর রাসূল (সা.) ছুরি নিলেন এবং ছাগলকে ধরে শুয়ে দিলেন এবং যবেহ করলেন। আর বললেন: বিসমিল্লাহ, হে আল্লাহ মুহাম্মদ ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে এবং তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করুন। এভাবে রাসূল (সা.) ছাগল দ্বারা কুরবানি সুসম্পন্ন করলেন। 

কুরবানির হুকুম: 

এতে দু’টো মত পাওয়া যায় 

১. কুরবানি করা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ: এটি জমহুর ফুকাহাদের মত। ইমাম মালিক, ইমাম শাফেঈ. ইমাম আহমাদ ও ইমাম আবু ইউসূফ (রহ.)এর একমত অনুযায়ী, ইবনুল মুনযের , ছানআনী, ইবনু বায  (রহ.) এ মত গ্রহণ করেছেন।

২. কুরবানি করা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের জন্য ওয়াজিব: এটি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মাযহাব। মালেকী মাযহাবেরও এ মত। হাম্বলী মাযহাবের পক্ষ থেকেও এ মত গ্রহণ করা হয়েছে। শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, আল্লামা শাওকানী ও ইবনু উসাইমিন (রহ.) এ মত গ্রহণ করেছেন।

মান্নতকৃত কুরবানির হুকুম: মান্নতকৃত কুরবানি আদায় করা ওয়াজিব পশু নির্ধারিত হউক বা না হোক। চার মাযহাবের ঐক্যবদ্ধ মত এটি। 

কুরবানিতে অংশিদারিত্ব: 

কুরবানির পশু ছাগল হলে এককভাবে দিতে হবে এটি ইজমা’ উম্মাহ। গরু ও উটের ক্ষেত্রে জমহুর ফুকাহার মত হলো সাতজন অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং পশুর ক্রয়মূল্যে, গোশত বন্টনে ও সাওয়াব বা পুণ্যের ক্ষেত্রে অংশদারিত্ব বৈধ- এটি হানাফী, হাম্বলি ও শাফেঈ মাযহাব এর মত। ইমাম মালিক (রহ.) এর মতে ছাগল, গরু ও উট এককভাবে কুরবানি করতে হবে, তবে সওয়াব বা পুণ্যে অংশীদার করা যাবে যেমনটি রাসূল (সা.) তাঁর আহলে বাইত ও উম্মতে মুহাম্মদীকে তাঁর ছাগল কুরবানিতে পুণ্যে অংশীদার করেছিলেন।

জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বিভিন্ন সনদে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যাতে সাহাবা (রা.) গরু ও উটে সাতজন অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রমাণিত হয়।

জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা হুদায়বিয়ার বছর উটে সাতজন ও গরুতে সাতজন মিলে কুরবানি করেছিলাম। (মুসলিম-১৩১৮)। 

জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন: গরুতে সাতজন এবং উটে সাতজন কুরবানিতে অংশ নিবে। (আবু দাউদ-২৮০৮)। আলবানী (রহ.) এটিকে সহীহ হাদীস বলে সাব্যস্ত করেছেন।

ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন: আমরা রাসূল (সা.) এর সাথে কোন এক সফরে ছিলাম, ঈদুল আদহা এসে গেলো, আমরা গরুতে সাতজন এবং উটে দশজন মিলে কুরবানি করলাম। (সুনানুত তিরমিযী-১৫০১, সুনানুন নাসাঈ-৪৩৯২, সুনানু ইবনু মাজাহ-৩১৩১)। ইবনুল কাত্তান এটিকে সহীহ বলেছেন (আল-ওহাম ওল ইহাম-৫/৪১০)। ইবনুল মুলাক্কিন বলেছেন এ হাদীসের সকল রাবী ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য(আল-বদরুল মুনীর- ৯/৩০৪)। আলবানী (রহ.) এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন (মিশকাত-১৪৬৯)। রাফে’ ইবনু খাদিজ (রা.) বর্ণিত হাদীস উপর্যুক্ত হাদীসের সাক্ষ্যদানকারী যা সহীহুল বুখারী(২৪৮৮) এবং সহীহু মুসলিম (১৯৬৮) এ এসেছে।

ইমাম নববী (রহ.) বলেছেন উপরোক্ত হাদীসসমূহ কুরবানিতে অংশীদারিত্ব বৈধ হওয়ার দলীল এবং এ বিষয়টিতে ইজমা হয়েছে যে ছাগল কুরবানি এককভাবে দিতে হবে। আর গরু ও উটে সাতজন ব্যক্তি শরীক হতে পারবে। (শারহু মুসলিম)। বকরী বা ছাগল এককভাবে কুরবানি করতে হবে মর্মে চার মাযহাব একমত পোষণ করেছে। (বেদায়াতুল মুজতাহিদ, খ--০১, পৃ.৪২০)।

আবু আইয়্যুব আল-আনছারী রা. বলেন: লোকটি তার নিজের পক্ষ থেকে ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কুরবানি করলো। তারা নিজেরা খেলো ও অন্যদেরকে খাওয়ালো যা মানুষদের জন্য যথেষ্ট হলো। বিষয়টি এমন হলো যেমনটি আপনি মনে করছেন। (সুনানুত তিরমিযী-১৫০৫, সুনানু ইবনু মাজাহ-৩১৪৭)। আলবানী এটিকে সহীহ সাব্যস্ত করেছেন (আল-এরওয়া-১১৪২)। যেহেতু রাসূল (সা.) সাহাবীগণকে (রা.) গরু ও উটে সাতজন শরীক হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন সেহেতু এতদুভয় শ্রেণীর পশুতে সাতজন পর্যন্ত শরীক হওয়া বৈধ। উক্ত সাত ব্যক্তি একই পরিবারভুক্ত অথবা ভিন্ন ভিন্ন পরিবার থেকে হতে পারবে, তাদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন থাকুক বা না থাকুক বৈধতার জন্য কোন সমস্যা নেই। (ফতোয়া লুজনাতুদ দায়িমাহ ১১/৪০১)

ইবনু উসাইমিন (রহ.) বলেছেন: একটি ছাগলে একজন ব্যক্তি এবং প্রতিটি গরু ও উটে সাতজন পর্যন্ত মিলিতভাবে কুরবানি করা বৈধ। 

কুরবানির শর্তসমূহ:

১. কুরবানির পশু চতুষ্পদ জন্তুর মধ্য থেকে হতে হবে যেমন উট, গরু, ছাগল। এ বিষয়ে ইজমা’ হয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন ইবনু আব্দুল বার, ইবনু রুশদ, ইমাম নববী, ছানআনী (রহ.) প্রমুখ।

২. পশুর শরীআত সম্মত বয়স হতে হবে। যেমন উটের পাঁচ বছর, গরুর দুই বছর এবং ছাগলের একবছর। তবে ছাগলের ক্ষেত্রে ছয় মাস হলেও ধর্তব্য হবে। এটিও ইজমা’ উম্মাহ। লুজনাতুদ দায়িমাহ এর ফতোয়া এটি।

৩. শরীআ’হ সম্মতভাবে পশুর ত্রুটিমুক্ত হওয়া। যেমন লেংড়া, কুঁজো, উভয় চোখ বা এক চোখ অন্ধ এবং প্রকাশ্য রোগাক্রান্ত পশু না হওয়া । ইজমা’ উম্মাহ এটি।

৪. জবহের সময় হতে হবে। কুরবানির দিন ফজর নামাযের পূর্বে কিংবা ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানির পশু যবেহ করা বৈধ নয়। জবহের আউয়াল ওয়াক্ত থেকে আখের এর মাঝে কুরবানি করতে হবে। আউয়াল ওয়াক্ত বলতে ঈদের নামায আদায়ের পর থেকে কুরবানির পশু যবেহ করা যাবে। আখের ওয়াক্ত বলতে ঈদের পরের দু’দিন পর্যন্ত কুরবানির পশু যবেহ করা যাবে। জমহুর ফুকাহা, হানাফী, মালেকী ও হাম্বলী মাযহাব এটি। আইয়্যামে তাশরিকের সব ক’দিনই কুরবানি  বৈধ। শাফেঈ মাযহাবের মত এটি। সালাফের একদল এ মতের পক্ষে। ইবনু তাইমিয়্যাহ, শাওকানী, ইবনু বায ও ইবনু উসাইমিন (রহ.) এ মত গ্রহণ করেছেন।

 কুরবানির বৈধ সময়ে রাতের বেলায় কুরবানির পুশু যবেহ করা মালেকী মাযহাবের মত অনুযায়ী অবৈধ, হানাফী ও শাফেই মাযহাব অনুযায়ী মাকরুহ এবং হাম্বলী মাযহাব মতে বৈধ যা গ্রহণ করেছেন ইবনু হাযম, ছানআনী, শাওকানী ও ইব্নু উসাইমিন (রহ.)। কুরবানি করার বৈধ সময়ের মধ্যে কুরবানির পশু যবেহ করার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করাকে চার মাযহাবেই মুস্তাহাব বলা হয়েছে। 

৫. কুরবানি দাতার কুরবানির নিয়্যত থাকতে হবে। চার মাযহাবের মত এটি।

যবেহ এর শর্তসমূহ:

১. যবেহ করার পূর্বে বিসমিল্লাহ বলা। ফকীহগণ শর্ত, ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ তিন ধরনের মত দিয়েছেন যা মূলত কাছাকাছি।

২. রক্ত প্রবাহিত করা। আহলুল ইলমদের বক্তব্য অনুযায়ী কুরবানির পশুর চারটি অংশ গলা, খাদ্যনালী এবং ওদজাইন (রগ)কাটা হলে রক্ত প্রবাহিত করা পূর্ণ হবে।

 

কুরবানির আদাব ও সুনান:

ক. কুরবানি দাতা কুরবানির পশু যবেহ করার পূর্বে মাথা মু-ন ও নখ কাটা সম্পর্কে তিনটি মত পাওয়া যায়।

১. বৈধ বা জায়েয:  হানাফী মাযহাব এটি। মালেকী মাযহাবের এক মত অনুযায়ী এবং লাইস ইবনু সা’দের মতও এটি। ইবনুল বার এটি গ্রহণ করেছেন। মদীনা ও কুফার সকল ফকীহ এ মতের পক্ষে।

২. হারাম: হাম্বলী মাযহাব মতে। শাফেঈ মাযহাবের বক্তব্যও অনুরূপ। সালাফের একদল এ মতের পক্ষে। ইবনু হাযম ,ইবনুল কায়্যিম, ইবনু বায ও ইবনু উসাইমিন (রহ.) এ মত গ্রহণ করেছেন।

৩. মাকরুহ: মালেকী ও শাফেঈ মাযহাবের মত এটি। হাম্বলী মাযহাবেরও একটি মত এ রকম।

ক. তবে কুরবানি দাতা কুরবানির পশু যবেহ করার পূর্বে মাথা মু-ন বা নখ কেটে ফেললে কোন ফিদইয়া দেয়া লাগবে না- এ বিষয়ে ইজমা’ রয়েছে ইবনু কুদামাহ ও মুরাদাভির বর্ণনা মতে।

খ. কুরবানির পশু যবেহকারী কিবলার দিকে মুখ করে যবেহ করা মুস্তাহাব চার মাযহাব এ বিষেয় একমত।

গ. ছাগলকে যবেহ করার জন্য শুয়ানোর আগেই ছুরি ধার দেয়া মুস্তাহাব চার মাযহাব এ বিষেয় একমত।

ঘ. উটের জন্য নাহর, ছাগলের জন্য যবেহ এবং গরুর জন্য এতদুভয়ের যে কোনটি সুন্নাহ। এটিও ইজমা’ উম্মাহ।

ঙ. বিসমিল্লাহ বলার পর তাকবীর বলা মুস্তাহাব। এটিও ইজমা উম্মাহ। বিসমিল্লাহ না বলে যবেহ করলে, অথবা অন্য কোন নামে যবেহ করলে তা খাওয়া বৈধ হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি এমন প্রাণির গোশত তোমরা ভক্ষণ করো না, কেননা এটা ফিসক। (সূরা আন আম:১২১)।

চ. কুরবানি দাতা সম্ভব হলে নিজে কুরবানির পশু যবেহ করা মুস্তাহাব। এটিও ইজমা’ উম্মাহ। তবে কুরবানি দাতা যবেহ করার ক্ষেত্রে প্রতিনিধি নিযুক্ত করা বৈধ।

ছ. কুরবানির পশুর গোশত নিজে খাওয়া, অন্যকে খাওয়নো, বিতরণ ও সংরক্ষণ বৈধ- সকল মাযহাবের ঐক্যবদ্ধ মত এটি। বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে মুস্তাহাব পদ্ধতি হিসেবে তিনভাগে ভাগ করে এক ভাগ দরিদ্র-অসহায়দের জন্য, একভাগ আত্মীয়-স্বজনদের জন্য এবং এক ভাগ নিজের জন্য প্রচলিত বিতরণ পদ্ধতি দোষণীয় নয়, তবে এটাকে মুস্তাহাবের উর্ধ্বে ফরয ওয়াজিব মনে করা যাবে না। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন: তোমরা পরষ্পর উপহার বিনিময় করো, এতে পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি আমাদের যে দায়বদ্ধতা সেটার প্রতিফলন ঘটাতে দাঁড়ি পাল্লা দিয়ে সমান তিন ভাগে ভাগ করতে হবে এমনটিও নয়। কারণ কুরবানি দাতার পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি থাকলে সে পুরোটা খেলেও দোষণীয় নয়।

ঝ. যবেহকারী ও গোশত কাটার শ্রমিকদেরকে পারশ্রমিক হিসেবে অর্থ প্রদানের পরিবর্তে কুরবানির পশুর গোশত প্রদান অবৈধ। সকল মাযহাবের ঐক্যবদ্ধ মত এটি। তবে পারিশ্রমিকের অর্থ প্রদানের পর ফকির মিসকিনদের জন্য বন্টিত অংশ তাদেরকে প্রদান করা যাবে যদি এসব লোক ঐ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়। ফকির মিসকিনরা যে পরিমাণ গোশত পাবে তারাও সে পরিমাণ পাবে, কোনক্রমেই বেশি দেয়া চলবে না।

ঞ. শাফেঈ মাযহাব অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করা শরীআহ সম্মত নয়। ইবনু উসাইমিন (রহ.) এ মত গ্রহণ করেছেন। হানাফী, মালেকী ও হাম্বলী জমহুর ফুকাহার মতে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করা যাবে যেমনটি মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করা বৈধ।

ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কুরবানি করা, ঘুষ ও অবৈধ উপার্জিত অর্থ দিয়ে কুরবানি করা, আকিকা দিয়ে কুরবানির দায় সারা ইসলামী শরী’আতের বিধানকে উপহাস করার শামিল। কুরবানি না করে কুরবানির পশু ক্রয়ের টাকা গরীব মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) প্রদত্ত শরীআহকে অবজ্ঞার শামিল। বছরে একবার কুরবানির গোশত বিতরণ করে মিসকিন ও গরীবের মাঝে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার সুযোগ হাত ছাড়া আমরা না করি।

সালাত যেমন একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে আদায় করা হয় অনুরূপভাবে কুরবানির পশু যবেহ একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: হে রাসূল (সা.) আপনি বলুন: আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মরণ একমাত্র বিশ্বজাহানের প্রতিপালক মহান আল্লাহ তা’আলার জন্য যার কোন শরীক নেই। আমি এতদ বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই মুসলমানদের(আত্মসমর্পণকারীদের) মধ্যে প্রথম। (সূরা আলে ইমরান:১৬২-১৬৩) আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: কুরবানির পশুর রক্ত মাংস কোন কিছুই আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের অন্তরের তাকওয়া বা খোদাভীতি। কাজেই নিয়তের পরিশুদ্ধতা অত্যন্ত জরুরি। একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্য আমরা যেন কুরবানি করতে পারি  আল্লাহ আমাদের সবাইকে সে তাওফিক দান করুন। আমীন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ