শনিবার ০২ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

বাংলা সাহিত্যে কুরবানির ঈদ

মুহাম্মদ ইয়াকুব :

সংস্কৃতির ইতিহাস মানবসভ্যতার ইতিহাসের সমান। সংস্কৃতির প্রাচীনতম শাখা সাহিত্য। আবার সাহিত্যের মূল উপজীব্য বিষয়বস্তু হলো সংস্কৃতি। খাদ্যাভ্যাস, জীবন যাপন, পারিবারিক জীবন, খেলাধুলা, জীবিকা, আচার-ব্যবহার ইত্যাদি সাংস্কৃতিক মানসিকতায় বাঙালি একই সংস্কৃতির। অন্যদিকে ধর্মীয় রীতি-নীতি ও বিশ্বাসের দিক থেকে বাঙালি মিশ্র সংস্কৃতির। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় মিশ্র সংস্কৃতির উৎসবগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো বাঙালি মুসলমানের প্রধান দু'টি ধর্মীয় উৎসব ; ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আযহা। আরবি জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের সর্বশেষ দিনটি ঈদ-উল-আযহা যেটি কুরবানির ঈদ হিশেবে উপমহাদেশে প্রসিদ্ধ। কালের পরিক্রমায় দু'টো ঈদই বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। দুই ঈদেই বাংলা সাহিত্য বিস্তর উপাদান পেয়েছে। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত কুরবানির ঈদ নিয়ে বাঙালি সাহিত্যিকদের দ্বারা রচিত হয়েছে কুরবানি কেন্দ্রীক বিশাল সাহিত্য সম্ভার। 

বাংলায় সংস্কৃতি বা কৃষ্টি শব্দটি ইংরেজি ঈঁষঃঁৎব শব্দের সমার্থক হিশেবে বাংলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ঈঁষঃঁৎব এর প্রতিশব্দ হিশেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়। শব্দটির আভিধানিক অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। পরিভাষায় - কোন স্থানের মানুষের আচার-অনুষ্ঠান, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দিক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয় তাই সংস্কৃতি। বাংলাদেশের সংখ্যাধিক্যের ধর্মীয় উৎসব হিশেবে ঈদ উল ফিতর এবং ঈদ উল আযহা জাতীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। ইব্রাহিমীয় ধর্মের হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি কুরবানি। মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাস মতে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সর্বোচ্চ উৎসর্গের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তের ধারাবাহিক স্মরণ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতাই কুরবানি। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর মতো বাঙালি মুসলমানও এদিন ত্যাগের নজির স্থাপন করে। বাঙালি কবি-সাহিত্যকদের সৃষ্টিকর্মে কুরবানির সরব উপস্থিতি জানান দেয়, কুরবানির ঈদ বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। কুরবানি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে বাঙালি মুসলমান লেখকদের স্মৃতিকথায়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রকাশিত মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতানের ‘নবীবংশ'এ কুরবানির রীতি প্রচলনকারী ইব্রাহিম ও ইব্রাহিম পুত্র ইসমাইল (আ:) এর বর্ণনা পাওয়া যায়। সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর ‘ঈদল আজহা’ গ্রন্থে তাঁর ইমামতিতে কুরবানির ঈদের নামাজ আদায়ের বিষয়টি জানা যায়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গান, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, পত্রালাপ, বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে  কুরবানির ঈদকে নতুনরূপে বিশ্লেষণ করেছেন, কুরবানির দার্শনিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপস্থাপন করেছেন। কুরবানির বহুমুখী কল্যাণ ও ত্যাগের নিগূঢ় রহস্য প্রকাশ করে  ঈদুল আজহাকে আখ্যায়িত করেছেন কুরবানির ঈদ, শহীদ ঈদ, দুসরা ঈদ, ঈদ-উল কুরবান ইত্যাদি বিশেষণে। নজরুলের বিখ্যাত গান ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ না বাজলে বাঙালির মনেই হয় না ঈদ এসেছে! ঈদুল-উল-ফিতর নিয়ে গানটি রচিত হলেও কুরবানির ঈদ উদযাপনেও বাঙালি এটি ছাড়া যেন অপূর্ণ। ১৯৩১ সালে শ্যামা সংগীতের রমরমা যুগে কিংবদন্তী সঙ্গীত সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের অনুরোধে ঝুঁকি নিয়ে  গানটি রচনা করেন নজরুল। গানটি আলোর মুখ দেখার নেপথ্যে আরও একজনের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিনি হলেন গ্রামোফোনের ভগবতী বাবু। শ্যামা সংগীতের স্বর্ণযুগে নতুন ধারার ইসলামি গান চলবে না মনে করে ভগবতী বাবু প্রথমে ঝুঁকি না নিতে চাইলেও আব্বাস উদ্দীনের জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত ঝুঁকি নিতে রাজি হয়ে যান। এর পরেরটা তো ইতিহাস!  

কাজী নজরুল ইসলাম খোদায়ি ফরমান কুরবানি দেয়ার তাকিদ দিয়ে লিখেছেন, ‘ঈদজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ/এল আবার দুসরা ঈদ/কোরবানী দে কুরবানি দে/শোন্ খোদার  ফরমান তাকীদ।’ নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ   ‘অগ্নিবীণা’র ‘কুরবানি’ কবিতাটি ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ‘ভাদ্র সংখ্যা’ মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রত্যেক যুগেই  কুরবানির ঈদ সন্নিকটে উপনীত হলে কিছু পশুপ্রেমীর আবির্ভাব হয়। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে মিথ্যা অজুহাত খাড়া করে কুরবানির ঈদকে অমানবিক, বর্বর, নৃশংস প্রমাণিত করার ব্যর্থ প্রয়াস চালান। এসব সিজনাল পশুপ্রেমীদের মেকি প্রীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ৭৪ লাইনের দীর্ঘ  কবিতা ‘কোরবানি'তে নজরুল বারবার বলেছেন ‘ওরে হত্যা নয় আজ সত্যগ্রহ শক্তির উদ্বোধন'। উল্লেখিত কবিতায় কুরবানির তাৎপর্য বর্ণণা করে নজরুল লিখেন, ‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন/দুর্বল ভীরু চুপ রহো ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন/ধ্বনি ওঠে রণি দুরবানীর/আজিকার এ খুন কুরবানির/দুম্বাশির-রুমবাসীর/শহীদের শির সেরা আজি।’ 

নজরুল তাঁর ‘বকরীদ’ কবিতায় কুরবানির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন, ‘শহীদানদের ঈদ এলো বকরীদ/অন্তরে চির নৌ-জোয়ান যে তারি তরে এই ঈদ/আল্লার রাহে দিতে পারে যারা আপনারে কোরবান/নির্লোভ নিরহংকার যারা যাহারা নিরভিমান/দানব দৈত্যে কতল করিতে আসে তলোয়ার লয়ে/ফিরদাউস হতে এসেছে যাহারা ধরায় মানুষ হয়ে/অসুন্দর ও অত্যাচারীরে বিনাস করিতে যারা/জন্ম লয়েছে চির-নির্ভীক, যৌবন মাতোয়ারা/তাহাদেরি শুধু আছে অধিকার ঈদগাহে ময়দানে/তাহারাই শুধু বকরীদ করে জান-মাল কোরবানে।'

মুসলিম পুনর্জাগরণের কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী কুরবানিকে ‘আত্মকোরবানির প্রতীক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কবি হাসান হাফিজও ‘ঈদের শিক্ষা’ নামক কবিতায় কুরবানিকে  আত্মোৎসর্গের প্রতীক হিশেবে উপস্থাপন করেছেন, ‘নিজের মনের হিংসাকে দাও কুরবানি/ঈদের শিক্ষা তাই/দরকার এই মর্মকথার গভীর জানাজানি’। মুসলমান সংস্কৃতিতে ঈদ শুধু উৎসব নয়, বিসর্জনও। বিসর্জনের মাধ্যমে সুখ খুঁজে নেবার অনবদ্য প্রয়াসের নামই ঈদ। ধনী-গরিব কাঁধে কাঁধ বুকে বুক মিলিয়ে একই শ্রেণিতে রূপান্তরিত হওয়াই ঈদ। মুসলিম সংস্কৃতিতে ঈদ উৎসবের সাম্যবাদী শিক্ষা সম্পর্কে কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘কাল ঈদগাহে ধনী-দরিদ্র মিলবে যে বুকে বুকে/কাল ঈদগাহে ধনীর ধনের দীনও হবে ভাগীদার/পুরাতে হইব কত দিবসের খালি অঞ্জলি তার।'

বাংলা কবিতার পাশাপাশি বাংলা কথাসাহিত্যেও কুরবানির সরব উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। মনিরুজ্জামান এসলামাবাদী ১৩২৩ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় ‘আল এসলাম’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘ঈদুল আজহা’ প্রবন্ধে কুরবানির প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা তোলে ধরেছেন এভাবে, ‘কুরবানির দ্বারা একেক দীনদরিদ্র লোকেরা প্রীতিকর ও তৃপ্তিকর ভোজ পায়, পশুচর্ম দ্বারা তাহাদের অন্নবস্ত্রের অভাব আংশিকরূপে দূর হয়, একসঙ্গে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ পশুবধে তাহার রক্ত, হাড়, উদরস্থ গোবর ইত্যাদি সাররূপে জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে। এ জন্য কুরবানির পশুকে মাঠে লইয়া গিয়া জবেহ করার আদেশ দেয়া হইয়াছে।... পশু পোষণ যাহাদের জীবনের প্রধান সম্বল তাহারা সারা বৎসরের মধ্যে এই পর্বোপলক্ষে পশু বিক্রি করিয়া নিজ নিজ সংসার জীবনের নানাপ্রকার অভাব অভিযোগ তদ্দারা মিটাইয়া থাকে।'

কুরবানির ঈদ সম্পর্কে যতই নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হোক না কেন, কালের পরিক্রমায় এটি বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। জাহানারা ইমামের মতো ব্যক্তিও ‘অন্য জীবন’ গ্রন্থে কুরবানির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে হারিয়ে গেছেন শৈশবে, ‘কুরবানির সময় আমাদের বাড়িতে চালের আটার রুটি বানানো হতো সে একটা দেখবার মত জিনিস। রসুনের খোসার মত পাতলা রুটি, ধবধবে সাদা এবং সুগোল।...বকরিদের সকালে কুরবানি না হওয়া পর্যন্ত কেউ কিছু মুখে দিতেন না। পুরুষেরা গোসল সেরে নতুন কাপড় পড়ে নামায পড়তে যেতেন খালি পেটেই। ফিরে এসে একেবারে কুরবানি দিয়ে তারপর বাড়িতে ঢুকতেন। ততক্ষণে মেয়েদের রুটি, হালুয়া, সেমাই, ফিরনি সব রান্না শেষ।’ জাহানারা ইমাম বর্ণিত স্মৃতিকথাই ঈদের দিনের বাঙালি সংস্কৃতি, লোকজ সংস্কৃতি যা এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে হাজার বছর ধরে মিশে আছে। 

বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম কুরবানির দার্শনিক গুরুত্ব যুক্তিপূর্ণ ভাষায় সবচেয়ে  সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন। দুঃশাসন, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে ত্যাগের মানসিকতায় উদ্ভাসিত হয়ে প্রতিবাদমুখর হওয়ার মাধ্যমে মুক্ত-স্বাধীন হওয়াই কুরবানির প্রকৃত সার্থকতা। ব্রিটিশ ভারতে সাম্রাজ্যবাদী দখলদারদের সময়কালে নজরুল মনে করতেন ব্রিটিশ খেদানোটাই সবচেয়ে বড় কুরবানি। তিনি মনে করতেন,  মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিক হিশেবে সম্মান নিয়ে স্বাধীনতা নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ উৎসর্গের প্রতীকী নামই কুরবানি। তিনি বিশ্বাস করতেন, জুলুম মুক্ত হয়ে আল্লার একাত্মবাদ পূর্ণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের মনের মুক্তি হলে পশু কুরবানি যথার্থ হবে। তাই অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই ছিলো নজরুলের চোখে কুরবানির প্রধান সার্থকতা, ‘পশু কুরবানি দিস তখন/আজাদ মুক্ত হবি যখন/জুলুম মুক্ত হবে রে দ্বীন/কুরবানির আজ এই যে খুন/শিখা হয়ে যেন জ্বালে আগুন/জালিমের যেনো রাখে না চিন/আমিন রাব্বিল আলামিন।/আমিন রাব্বিল আলামিন।’ 

নজরুলের সুরে সুর মিলিয়ে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ আজ তাই প্রত্যাশা করছে - একটা শোষণমুক্ত, ধনী-দরিদ্র বৈষম্যমুক্ত ইনসাফপূর্ণ  সমতার সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কুরবানির শিক্ষা বাস্তবায়িত হোক। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ