ঈদুল আযহা : ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর

ড. মো: ছামিউল হক ফারুকী:
ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ ত্যাগের অনুপম অনুশীলনের এক স্মরণীয় নাম। আল্লাহর প্রেমে পাগলপারা হয়ে নিজেকে আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দেওয়ার এক প্রতীকী মহড়ার নাম ঈদুল আযহা। আযহা বা কুরবানির মর্মকথা হলো নিজের সবকিছু, এমনকি প্রয়োজন হলে নিজের জীবনটাও আল্লাহর জন্য নিবেদন করা। মোট কথা একান্তভাবে নিজেকে আল্লাহর কাছে সপে দেয়া বা আল্লাহর কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করা।
কুরবানির ইতিহাসের সাথে যার নাম জড়িত তিনি হলেন, মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহীম (আ)। আল কুরআনে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যখন তাঁর প্রভু তাকে বললেন, তুমি আত্মসমর্পণ কর। তিনি বললেন, আমি জগতসমূহের প্রভুর নিকট আত্মসমর্পণ করলাম।’(২, সূরা আল্ বাকারা : ১৩১)
যায়িদ ইবন আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, এ কুরবানিগুলো কি? তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ) এর সুন্নাত। (হাকিম, আল্ মুস্তাদ্রাক ‘আলাস সাহীহাইন, তাফসীরু সূরাতিল হাজ্জ, হাদীছ নং ৩৪৬৭।) হাদীছটি মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯৩৮৩; ইবন মাজাহ্, কিতাবুল আযাহী, বাবু ছাওয়াবিল উযহিয়াহ, হাদীছ নং ৩১২৭; তাবারানী, আল্ মু‘জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫০৭৫, বায়হাকী, সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৯০১৬ তেও বর্ণিত হয়েছে। হাকিম হাদীছটির সনদ সহীহ্ বলে উল্লেখ করেছেন। অপর দিকে আবু হাতিম এ হাদীছের একজন রাবী ‘আয়িযুল্লাহকে মুনকারুল হাদীছ বলে উল্লেখ করেছেন। (ইমাম যাহাবী, মিযানূল ই‘তিদাল, পৃ. ৭৪০)
ইবরাহীম (আ) ছিলেন শিরকের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সংগ্রামী পুরুষ। শিরকের জাল ছিন্ন করে নির্ভেজাল তাওহীদ প্রতিষ্ঠাই ছিল তার জীবনের একমাত্র ব্রত। তিনি শিরকপূর্ণ সমাজে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, “আমি আমার নিজেকে সবদিক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার দিকে নিবিষ্ট করলাম, যিনি আকাশসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। (৬, আল আন‘আম : ৭৯)
তিনি আরো ঘোষণা দিয়েছিলেনÑ “আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ জগতসমূহের প্রভু আল্লাহর জন্য।” (৬, সূরা আল আন‘আম : ১৬২)
কুরবানির সময় দু‘আ হিসেবে এ আয়াত দু’টি পাঠ করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত: শিরক মুক্ত হয়ে তাওহীদের ঘোষণা প্রদান করা হয়, যার অর্থ হলো নযর, মান্নত, কুরবানি, ‘ইবাদাত বন্দেগী শুধুমাত্র আল্লাহর নামে এবং আল্লাহর জন্যই করতে হবে, অন্য কারো জন্য করা যাবে না।
প্রাচীনকাল থেকেই পৌত্তলিকরা বিভিন্ন দেবদেবী, মূর্তি, গাছ, পাথর, আগুন, চন্দ্র, সূর্য, তারকা প্রভৃতির পূজা এবং তাদের নামে এবং তাদের জন্য নযর, মান্নত, কুরবানি প্রভৃতি করে আসছে। বর্তমানে এক শ্রেণীর মুসলিমও কিছু ব্যক্তির কবরকে মাযারে পরিণত করে সেখানে গরু, ছাগল, টাকা-পয়সা, খাবার প্রভৃতি মান্নত করছে যা সুস্পষ্ট শিরক। এধরনের সকল শিরক থেকে মুক্ত হয়ে কেবলমাত্র আল্লাহর নামে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে সবকিছু করা ও নিবেদন করাই হলো ইবরাহীম (আ) প্রবর্তিত কুরবানির মূল শিক্ষা।
ইবরাহীম (আ) আজীবন শিরকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য চরম ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেছেন। এজন্য নমরূদ তাকে অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করেছিল। আল কুরআনের সূরা আল্ আম্বিয়ায় আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমি ইতোপূর্বে ইব্রাহীমকে দিয়েছিলাম সত্য পথের সঠিক জ্ঞান, আর আমি তার ব্যাপারে সম্যক জ্ঞাত ছিলাম। যখন সে তার পিতা ও স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল, এ মূর্তিগুলো কি, যাদের পূজায় তোমরা রত রয়েছো? তারা বলল, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এগুলোর পুঁজা করতে দেখেছি। সে বলল, নিশ্চয় তোমরাও রয়েছে সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে এবং তোমাদের পিতৃপুরুষরাও। তারা বলল, তুমি কি আমাদের নিকট সত্য নিয়ে এসেছ, না কি কৌতুক করছ? সে বলল, না, বরং তোমাদের রব তো আকাশম-লী ও পৃথিবীর রব, যিনি সেগুলো সৃষ্টি করেছেন, আর আমি সে বিষয়ে অন্যতম সাক্ষী।” (২১, সূরা আল্ আম্বিয়া : ৫১-৫৬)
“তিনি আরো বললেন, তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত এমন কিছুর ‘ইবাদাত করবে, যা তোমাদের কোনো উপকার করতে পারে না এবং তোমাদের কোনো ক্ষতিও করতে পারে না? ধিক তোমাদেরকে এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাদের ‘ইবাদাত করছো তাদের! তবুও কি তোমরা বুঝবে না?”(২১, সূরা আল্ আম্বিয়া : ৬৬-৬৭) অবশেষে ইব্রাহীম (আ.)কে মূর্তি ভাঙ্গার অপরাধে আগুনে পুড়িয়ে মারার দণ্ড প্রদান করা হয়। “তারা বলল, তাকে জ্বালিয়ে দাও এবং তোমাদের দেবতাদেরকে সাহায্য করো, যদি তোমাদের কিছু করার থাকে।” (২১, সূরা আল্ আম্বিয়া :৬৮)
যমীনে বিশাল গর্ত খনন করা হলো এবং প্রচুর খড়ি সংগ্রহ করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে প্রকাণ্ড এক অগ্নিকু- প্রজ্জ্বলিত করা হলো। অতঃপর সে অগ্নিকুণ্ডে ইব্রাহীম (আ.)কে নিক্ষেপ করার ব্যবস্থা করা হলো। ইবন ‘আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সময় ইবরাহীম (আ.) এর শেষ কথা ছিল, ‘হাস্বিয়াল্লাহু ওয়া নি‘মাল ওয়াকিল’- আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি অতি উত্তম কর্মবিধায়ক। আর মুহাম্মদ (সা.)ও ঠিক এ কথাটিই বলেছিলেন, (বদর যুদ্ধের পূর্বে) যখন তাকে বলা হলো, ‘নিশ্চয় লোকেরা তোমাদের জন্য সমবেত হয়েছে, সুতরাং তাদেরকে ভয় করো। তখন তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেল এবং তারা বলল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। অতি উত্তম কর্মবিধায়ক তিনি’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৭৩)। (হাকিম, আল্ মুস্তাদ্রাক ‘আলাস সাহীহাইন, কিতাবুত্ তাফসীর, তাফসীরু সূরা আলে ‘ইমরান, হাদীছ নং ৩১৬৭) আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত অন্য একটি হাদীছে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ইব্রাহীম (আ.)কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ আপনি আকাশে একক সত্তা আর যমীনে আমি একাই আপনার ‘ইবাদাত করছি।’ (কানযুল ‘উম্মাল, হাদীছ নং ৩২২৮৬; ইবন কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, খ. ৫, পৃ. ৩৬১, সূরা আল্ আম্বিয়ার ৬৮ নং আয়াতের তাফসীর) অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, এ সময় জিবরীল (আ.) বলেছিলেন, আপনার কি সাহায্যের প্রয়োজন আছে? ইবরাহীম (আ.) বলেছিলেন, আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই, তবে আল্লাহর সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। (ইবন কাছীর, প্রাগুক্ত) এ সময় আল্লাহ তাঁর খলিলের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আগুনকে নির্দেশ দেন, ‘হে আগুন তুমি ঠাণ্ডা এবং ইবরাহীমের জন্য শান্তিদায়ক হয়ে যাও’ (২১, আল আম্বিয়া : ৬৯)। ফলে নমরূদ তার কোন ক্ষতি করতে পারেনি। বরং তার সকল ষড়যন্ত্র ভেস্তে যায়। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা তার সাথে ষড়যন্ত্র করেছিল, কিন্তু আমরা তাদেরকে পরাভূত ও অপদস্ত করেছিলাম।’ (২১, সূরা আল্ আম্বিয়া : ৭০)
আল্লাহ তাঁর খলিলকে আরো বড় বড় পরীক্ষা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে স্বীয় স্ত্রী হাজেরা (আ)কে বায়তুল্লাহর সন্নিকটে বিজন মরু প্রান্তরে একাকী রেখে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি সে নির্দেশ দ্বিধাহীন চিত্তে প্রতিপালন করেছিলেন এবং দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমা‘ঈলসহ স্ত্রী হাজিরা (আ.)কে সেখানে রেখে এসেছিলেন। অথচ সে সময় সেখানে না ছিল কোনো মানুষজন, আর না ছিল কোনো পানি বা খাবার ব্যবস্থা। ইব্রাহীম (আ.) যখন হাজেরা (আ.)কে রেখে ফিরে আসছিলেন, তখন তিনি তার পিছনে পিছনে কিছুদূর এসেছিলেন। বারবার তাকে বলছিলেন, এ জনমানবহীন প্রান্তরে আমাদেরকে রেখে আপনি কোথায় যাচ্ছেন? কিন্তু ইব্রাহীম (আ.) তার দিকে তাকাচ্ছিলেন না। পরিশেষে তিনি তাকে বললেন, আল্লাহ কি আপনাকে এর নির্দেশ দিয়েছেন? তিনি বললেন, হাঁ। তখন হাজেরা (আ.) বললেন, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে ধ্বংস করবেন না। এরপর তিনি ফিরে গেলেন। ইব্রাহীম (আ.)ও চলে গেলেন। যখন তিনি গিরিপথে এতদূর গেলেন যে, তার স্ত্রী-সন্তানদেরকে দেখা যাচ্ছিল না, তখন তিনি বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে দু’হাত তুলে দু‘আ করেছিলেন,‘হে আমাদের রব! আমি আমার বংশধরের কতককে তোমার পবিত্র ঘরের সন্নিকটে ফল-ফসনহীন এক উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে গেলাম। হে আমাদের রব! যাতে তারা সালাত কায়েম করে। সুতরাং তুমি কিছু মানুষের অন্তর ওদের প্রতি অনুরাগী করে দাও এবং ফলফলাদি দ্বারা ওদের রিযিকের ব্যবস্থা করো, যাতে ওরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে’ (১৪, সূরা ইব্রাহীম : ৩৭)। (বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, হাদীছ নং ৩৩৬৪) প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করুন, আল্লাহর নির্দেশে একজন স্বামী, একজন পিতা কিভাবে তার প্রিয়তমা স্ত্রী এবং অতি স্নেহের শিশু সন্তানকে একাকী রেখে যাচ্ছেন। লক্ষ্য করুন একজন স্ত্রী আল্লাহর নির্দেশ জানার পর কিভাবে সে সিদ্ধান্তকে নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছেন। এটিই হলো ইসলাম (আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করা)।
ইব্রাহীম (আ.) এর জন্য এর চেয়েও বড় পরীক্ষা ছিল আল্লাহ তার প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আ)কে কুরবানির নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্ কুরআনে এর চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে,
“পুত্র সন্তানটি যখন তার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে উপনীত হলো, সে (ইবরাহীম) তাকে বললো, ‘হে আমার ছেলে, আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি তোমাকে যবেহ্ করছি। তুমি চিন্তা করে দেখ, তোমার অভিমত কি। সে বললো, ‘আব্বা, আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা কার্যকর করুন। ইন্শাআল্লাাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যেই পাবেন। অত:পর তারা উভয়ে অনুগত্যে শির নত করে দিলো এবং সে পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলো। এবং তখন
আমি তাকে ডাকলাম, ‘হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছো। নিশ্চয়ই আমি এইভাবেই মুহসিন ব্যক্তিদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটি ছিলো একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি একটি কুরবানির পশুর বিনিময়ে তাকে (ছেলেটিকে) মুক্তি দিলাম এবং আমি পরবর্তীদের জন্য তা নিয়ম হিসেবে রেখে দিলাম।” (৩৭, সূরা আস্ সাফ্ফাত : ২-৮)
নবীদের স্বপ্নও ওহী। এ জন্য ইব্রাহীম (আ.) তার পুত্র ইসমা‘ঈলকে কুরবানি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ আল্লাহর হুকুম তাকে প্রতিপালন করতেই হবে। পিতৃত্ব, পুত্রের অদম্য স্নেহ-মমতা কোনো কিছুই তার সামনে এ আদেশ পালনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। যেমন পিতা তেমন পুত্র। স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করতেই ইসমা‘ঈল (আ.) বুঝতে পেরেছিলেন যে, স্বপ্ন হলেও এটি মূলত: আল্লাহরই নির্দেশ। তাই তিনি সে আদেশকে শিরোধার্য করে নিলেন, পিতাকে বললেন, আপনি আল্লাহর হুকুম কার্যকর করুন।
এই হলো ইব্রাহীম (আ.) ও তার পরিবার। তিনি যেমন আল্লাহতে আত্মনিবেদিত প্রাণ মুসলিম ছিলেন, অনুরূপভাবে তার স্ত্রী সন্তানদেরকেও নিবেদিত প্রাণ মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। এ জন্যই ইবরাহীম (আ.)কে মুসলিম জাতির পিতা এবং তার মিল্লাত বা আদর্শকে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে আল্ কুরআনে বর্ণনা করে হয়েছে।
ইসমাঈল (আ)কে কুরবানি দেওয়ার যে নির্দেশ আল্লাহ ইবরাহীম (আ)কে দিয়েছিলেন তা তিনি প্রতিপালন করেছিলেন। অবশ্য আল্লাহ ইসমাঈল (আ)কে মুক্ত করে তার পরিবর্তে একটি দুম্বা কুরবানির ব্যবস্থা করেছিলেন। আল্লাহর জন্য সবকিছু ত্যাগের এ মহান আদর্শকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য আল্লাহ পরবর্তীদের জন্য কিয়ামাত পর্যন্ত কুরবানির বিধান প্রবর্তন করে দেন। ইবরাহীম (আ) আল্লাহর জন্য সবকিছু নিবেদনের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি তা বাস্তব জীবনে কার্যে পরিণত করেও দেখিয়ে দিয়েছেন। এজন্য আল্লাহর এ বান্দাকে আল্লাহ তাঁর ‘খলিল’ বা একান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
ইবরাহীম (আ) নির্দ্বিধায় আল্লাহর এ সকল হুকুম প্রতিপালন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যখন ইবরাহীমকে তার প্রভু কয়েকটি বিষয় দ্বারা পরীক্ষা করলেন এবং তিনি তা পূর্ণ করলেন। তখন আল্লাহ বললেন, নিশ্চয় আমি তোমাকে মানবম-লীর নেতা বানাবো।’ (২, আল বাকারা : ১২৪)
কুরবানির মূল চেতনা হলো আল্লাহ ও তাঁর দীনের জন্য সর্বস্ব বিসর্জন বা বিলিয়ে দেয়ার চেতনাবোধ। এজন্য নিজের প্রিয় বস্তু, প্রিয়জন এমনকি নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হলে, অকাতরে তাও বিলিয়ে দিতে হবে। এ চেতনাবোধ ও এজন্য বাস্তব জীবনে তা প্রতিপালনে সদা প্রস্তুত থাকা, কোন বিপদাপদ বা বাধা প্রতিবন্ধকতায় দমিত না হয়ে তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় অটল অবিচল থাকাই কুরবানির মূল শিক্ষা। এ শিক্ষা গ্রহণ না করে গরু-ছাগল যবেহ করে গোশত খেলে কোনো লাভ হবে না। বরং কুরবানি দেওয়ার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর হুকুমেই সে তার মূল্যমান পশুটি কুরবানি করছেন। অনুরূপভাবে আল্লাহর অন্যান্য সকল হুকুমও তাকে প্রতিপালন করতে হবে, প্রয়োজনে নিজের জান কুরবান করে হলেও।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘কুরবানির গোশত এবং রক্ত কোনটি আল্লাহর নিকট পৌঁছেনা। বরং তাঁর নিকট পৌঁছে শুধুমাত্র তোমাদের তাকওয়া (আল্লাহভীতি)।’ (২২, আল হাজ্জ : ৩৭) সুতরাং শুধু পশুকে নয়, সাথে সাথে মনের পশু (পাশবিক) সত্তাকেও কুরবানি করতে হবে। যাতে মন একান্তভাবে আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়ার পথে কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকে। আল্লাহর ভয় ও তাঁর প্রতি ভালবাসা এবং তাঁর দীনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার দ্বারাই তা অর্জিত হতে পারে। আর তা করতে পারলেই “আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ জগতসমূহের প্রভু আল্লাহর জন্য” কুরবানির এ ঘোষণা সার্থক হবে।