ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ও বর্তমান
অধ্যাপক এবিএম ফজলুল করীম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : ১৯১২ সালে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ ভারত সরকারের নিকট আবেদন জানান নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ.কে ফজুলুল হকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দের আবেদনের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ভারতের ক্ষমতাশীলদের পক্ষে ‘ঢাবি প্রতিষ্ঠার’ ওয়াদা করেন লর্ড বার্ন্ডিজ। ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভায় পাশ করা হয় “দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি” এ্যাক্ট (এ্যাক্ট নং ১৩) ১৯২০।
অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে অবশেষে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ৬০০ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত স্বায়ত্তশাসিত সরকারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। সেই মোতাবেক গত ১লা জুলাই ঢাবি শতবর্ষে পদার্পণ করেছে। প্রতিষ্ঠার সময় মাত্র ৬০ জন সম্মানিত শিক্ষক এবং ৮৭৭ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ঢাবিতে প্রথম ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৩৮,০০০ (আটত্রিশ হাজার) এবং শিক্ষক সংখ্যা ১৮০৫ জন। প্রতিষ্ঠার সময় এ বিশ্ববিদ্যালয় ৩টি অনুষদ তথা কলা, বিজ্ঞান ও আইন এবং ১২ বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বিভাগগুলো হলো :- ১) বাংলা ও সংস্কৃতি, ২) ইংরেজী, ৩) আরবি ও ইসলামিক স্টাডি, ৪) ফারসি ও উর্দু, ৫) ইতিহাস, ৬) অর্থনীতি ও রাষ্ট্র বিজ্ঞান, ৭) দর্শন, ৮) গণিত, ৯) পদার্থবিদ্যা, ১০) রসায়ন, ১১) আইন ও ১২) শিক্ষা। উল্লেখ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আরো ৮টি বিভাগসহ মোট ২০টি বিভাগের সুপারিশ করেছিল।
ঢাকার আশে-পাশের জেলার নবাবদের ও মুসলিম নেতাদের আর্থিক অনুদান ও ৬০০ একর জমি দানের মাধ্যমে এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে যাত্রা শুরু করে। ঢাবি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের মানবিক গুণাবলী বিকাশ ও উন্নত নৈতিক বলিষ্ঠ চরিত্রের আদর্শ মানুষ রূপে গড়ে তোলা। অল্প সময়ের মধ্যে ঢাবি শিক্ষার মান রক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য কঠিন ভাবে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালায় ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় “প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাতি” অর্জন করতে সক্ষম হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রসঙ্গ : VC ১৯২১ সালে থেকে ২০২১ সালের ৮ জুলাই পর্যন্ত ঢাবিতে ২৮ জন ভিসি দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রথম VC - স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ (Hartog)।
২৮তম অর্থাৎ শেষ VC - প্রফেসর মোহাম্মাদ আক্তারুজ্জামান (বর্তমানে চলমান)।
ঢাবি, ডাকসু প্রসঙ্গ : ডাকসু প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এবং বর্তমান পর্যন্ত ডাকসুর ২৬ জন ভিপি ও ২৬ জন জিএস দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ডাকসুর প্রথম ভিপি মো: মমতাজ উদ্দিন ও জিএস জগচন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।
ডাকসুর ২৬তম অর্থাৎ শেষ ভিপি মো: নুরুল হক নুরু ও জিএস গোলাম রব্বানি। এই ডাকসুর মেয়াদ ও বর্তমানে শেষ। ডাকসুর নির্বাচন অনিশ্চিত অথচ কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা : ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছে। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, ঢাবি প্রতিষ্ঠিত না হলে হয়তোবা এত সহজে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেতাম না।
তারা আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ভূমিকার কারণে সহজেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী ও কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচালনা করতে পারবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশিক্ষিত নৈতিক চরিত্রের ধারক বাহক ছাত্ররা।
আমার ব্যক্তিগত স্বপ্ন : আমি এবিএম ফজলুল করীমের ব্যক্তিগত স্বপ্ন ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হওয়ার। আলহামদুলিল্লাহ! আমি আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে সেই সুযোগ পেয়েছিলাম। বর্তমানেও কিন্তু আমাদের সন্তানরা একই স্বপ্ন লালন করে। কারও স্বপ্ন পূরণ হয়, আবার অনেকেরই হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। আমার সৌভাগ্য হয় এমন শিক্ষকের ক্লাশ করার, যাদের সুনাম ও খ্যাতি বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে আর্ন্তজাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল । তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো :
প্রফেসর ড: কাজী দ্বীন মোহাম্মদ।
প্রফেসর ড: আহম্মদ শরীফ।
প্রফেসর ড: নীলিমা ইব্রাহিম।
প্রফেসর ড: ওয়াকিল আহমেদ।
প্রফেসর ড: সানজিদা খাতুন। (কন্ঠ শিল্পী)
প্রফেসর ড: নরেশ বিশ্বাস।
ড: রফিকুল ইসলামসহ আরও অনেকে।
আমি অত্যন্ত আনন্দ চিত্তে ও খোশ মেজাজে ঢাবি’তে অধ্যয়ন করেছি। ১৯৮৪ সালে ঢাবি থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করে আবুজর গিফারী কলেজে ১৯৮৫ সাল থেকে শিক্ষকতা শুরু করি এবং ২০২০ সালে অবসর গ্রহণ করি। বর্তমানে আমি বিভিন্ন সামাজিক কাজের পাশাপাশি সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখালেখি করছি।
স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ঢাবি’র গৌরবময় ইতিহাস কখনো ম্লান হতে থাকে আবার কখনো গৌরব অর্জন করতে থাকে। এমনিভাবে উত্থান ও নিম্নগামী হতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মাঝে মধ্যে ছাত্রদের অস্ত্রের ঝনঝনানী ও সন্ত্রাস, মারামারি, হানাহানি চলতে থাকে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাবি এখনও পরিপূর্ণভাবে গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারে নাই। এইভাবে চলতে থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ‘নৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আলোকিত মানুষ’ ভবিষ্যতে তৈরি হবে কীনা জানিনা। কর্তৃপক্ষের উচিত ঐ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট সদস্য হিসেবে আমার ক্ষুদ্র ভূমিকা : আমি ২০০৩ সালে ঢাবি এর রেজিস্ট্রার গ্রাজুয়েট নির্বাচনে বিপুল ভোটে ঢাবি’র সিনেট সদস্য নির্বাচিত হই। ২৫ জন রেজিস্ট্রার সিনেট নির্বাচনে আমি তৃতীয় স্থান অর্জন করে ঢাবি’র সিনেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম।
আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে ২০০৩ সালে আমি ঢাবি’র সিনেট সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও সার্বিক উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ দীর্ঘ সময় ধরে পাই। সিনেট সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে ও ঢাবি’র হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি।
সিনেট অধিবেশনে প্রস্তাব ও পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে সিনেটের সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য আমি বহু প্রশ্ন, পরামর্শ এবং আবেদন জানাই। যেমন :
সমগ্র ঢাবি’কে ধূমপান মুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়া। যা আমি আইন হিসেবে চালু করতে চাইলেও তা পাস করাতে পারিনি।
আবাসিক ছাত্রীদের জন্য পূর্বের ন্যায় সন্ধা আইন চালু করা। তাও প্রয়োজনীয় সমর্থনের অভাবে আইন হিসেবে চালু করা যায়নি। (চলবে)