এনবিআরকে ঢেলে সাজানো দরকার
জাতীয় অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হলেও সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে দেশের কর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। একই সাথে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কার্যক্রমকে করতে হবে গতিশীল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫ দশক পরও জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানের স্থবিরতা কেটে যায় নি। ফলে এনবিআর এখন সাক্ষীগোপাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কাজ হলো দেশের কর ব্যবস্থাকে সময়োপযোগী করে যোগ্য করদাতারদের কাছ থেকে নায্য হারে কর আদায় করে জাতীয় অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে কত লোকের কর প্রদানের সামর্থ্য রয়েছে, সে হিসাবও জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। মূলত, বাংলাদেশে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ কর দেন। আর ২৪ লাখ ৪৩ হাজার করদাতা বার্ষিক আয়কর বিবরণী দেন।
সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম ও সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) ‘অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়’ বিষয়ক এক সমীক্ষায় এসব কথা বলা হয়েছে। সেখানে কর-ন্যায্যতার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। সমীক্ষাটি নিয়ে গত ৭ জুলাই অনলাইনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। যা খুবই বাস্তবম্মত বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এতে বলা হয়েছে, এ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রতিদিন নানাভাবে কর দিয়ে থাকেন। যেমন মুঠোফোনের বিল, গ্যাস, ওষুধ, বিদ্যুৎসহ নানা ধরনের জরুরি সেবার ওপর ভ্যাট দেন গরিব মানুষেরা। কিন্তু তাঁরা যে প্রতিনিয়ত কর দেন, তা নিয়ে তাঁদের কোনো ধারণা নেই। অথচ দেশের ৭১ শতাংশ গরিব মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতার বাইরে আছেন। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে গরিব নন, এমন মানুষ সুবিধা ভোগ করেন। যা নাগরিকদের সাথে সুস্পষ্ট ও সংবিধানের পরিপন্থী।
প্রদত্ত সমীক্ষায় ভ্যাটখাত বিস্তৃত না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়, মাত্র ১০টি খাত থেকে ভ্যাটের ৮১ শতাংশ আসে। এই খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সিগারেট, গ্যাস, নির্মাণ, মুঠোফোন, আগাম ভ্যাট, সরবরাহ সেবা, ওষুধ, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা, বিদ্যুৎ, ব্যাংক সেবা। কিন্তু এসব খাত আরও সম্প্রসারণের সুযোগ থাকলেও সে সুযোগগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছে না এনবিআর।
নতুন ভ্যাট আইনে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করার কথা। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ১০ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসকেল ডিভাইস (ইএফডি) বা ভ্যাটের মেশিন বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই পর্যন্ত ৩ হাজার প্রতিষ্ঠানে ইএফডি বসানো হয়েছে, যা ভ্যাটের অনলাইন নিবন্ধন নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মাত্র ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। ফলে বিষয়টি এখনও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
এতে আরও বলা হয়, মোট রাজস্ব আদায়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের ব্যবধান কমে আসছিল। তিন-চার বছর ধরে তা আবার বাড়ছে। এখন মোট রাজস্ব আদায়ের ৭০ শতাংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে। আর প্রত্যক্ষ কর আসে ৩০ শতাংশের মতো। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঠিকভাবে সরকারি সেবা পান না বলেই মানুষ কর দিতে উৎসাহিত হন না। আবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বারবার দেওয়া হয়। কম হারে কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করা যায়। তাই মানুষ কর দিতে আগ্রহী হন না।
মূলত, জাতীয় কর ব্যবস্থাকে গতিশীল করা না গেলে দেশের অর্থনৈতিক সেক্টর স্থবির হয়ে পড়ে। তাই দেশের কর ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার জন্য এনবিআরকে যোগ্য জনবল ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। আর দেশে কত সংখ্যক সক্ষম করদাতা রয়েছে তা সবার আগেই নিশ্চিত করা দরকার। সক্ষম লোকেরা যেন করের আওতার বাইরে না থাকেন এবং কর আদায়ে কারো প্রতি যেন অনাকাক্সিক্ষত আচরণ না করা হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে এনবিআরকে। আসলে দেশের কর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোই হচ্ছে সময়ের দাবি। অন্যথায় রাজস্ব আদায়ে গতিশীলতা ফিরবে না।