শুক্রবার ৩১ মার্চ ২০২৩
Online Edition

ছদ্মবেশি নবাব

মাখরাজ খান:

কাঁধে ঝোলা, মাথার চুল উসকুখুসকো চেহারা মলিন, চোখ লাল যেন আগুন বের হচ্ছে। তিনি কখনো দ্রুত, কখনো ধীরলয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। নজফ খাঁ তার পিছনে, যখন  ঝোলাওয়ালা পিছন ফিরে চান Ñ নজফ খাঁ পাগড়ির কোণা দিয়ে মুখ ঢাকেন, মাথা নিচু করেন যেন তাকে দেখতে না পান চিনতে না পারেন। মুঙ্গের থেকে নজফ খাঁ এভাবেই তার পিছনে তাকে নিরিবিলি পাননি তার সংগে কথা বলা হয়নি। পরিচয় জিজ্ঞেস করেননি। এবার বোধ হয় কথা বলার সুযোগ হবে, নজফ খাঁর সংগেও একটা  ঝোলা আছে কালো কাপড়ের তৈরি আর তার সামনের ব্যক্তির ঝোলাটা চটের তৈরি নকশা করা দেখলে মনে হয় তিনি সুফি তরিকার লোক। সুফিরা যেমন পথ চলতে জিকির করেন সামনের এই লোকটি সেরকম কিছু করছেন না। লোকটা চলছে তো চলছেই পায়ের চটিতে কাদা লেগে থাকায় বুঝা যাচ্ছে না এটা সাধারণ চটি না কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির অসাধারণ পাদুকা। এখন যে পথ দিয়ে যাচ্ছে পথটি নির্জন। সামনের লোকটা একটা অশ^ত্থ গাছের নিচে বসলেন ঝোলাটা রাখলেন কোলের উপর, নজফ খাঁ দূর থেকে সব দেখছেন তিনি ভাবতে লাগলেন এ সময় তার সামনে উপস্থিত হওয়া ঠিক হবে কিনা? নজফ খাঁ যে তাকে অনুসরণ করতে করতে এক মাস একদিন গত করেছেন এটা জানতে পারলে তিনি গোস্বা হবেন হয়তো? না আর বিলম্ব নয় এখনই তার সামনে যাওয়া উচিত এরপর কোনদিক চলে যাবেন কথা বলাই হবে না। এত পরিশ্রম, এত চেষ্টা বিফলে যাবে। এই নির্জন পথে হঠাৎ দুজন পথিক এলো নজফ খাঁ এদের দেখেই আন্দাজ করে নিলেন এরা ব্যবসায়ী। এরা ঝুলাওয়লা লোকটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ঘোড়ার উপর থেকে তীক্ষè নজরে দেখে নিলেন ঝুলাওয়ালা লোকটা তখন রুমালের চেয়ে বড় আকারের একটা কাগজ বের করে সূর্যের দিকে ধরে আছেন। নজফ খাঁর প্রথমে মনে হয়েছিল এ কাজ নিছক পাগলামী কিন্তু না। লোকটা পাগলামী করছে না। কিছু উদ্ধার করতে চাচ্ছে- নজফ খাঁ এবার নিশ্চিত হলেন লোকটা এই কাগজ থেকে অদৃশ্য কোনো লেখা উদ্ধার করতে চান। গোটা বাংলাতে অদৃশ্য কালি আর লেখা উদ্ধারের কৌশল দুজনেই জানেন তার একজন হলেন খসরু নামের একজন ইউরোপিয়ান আর আরেকজন হলো নজফ খাঁ নিজে।

খসরুর  কাছ থেকেই নজফ খাঁ অদৃশ্য কালি বানানো কৌশল এবং এই কালির লেখা পত্র বা দলিল পাঠ করার হিকমত শিখে নেন। দিল্লির বাদশারা এ কালি ব্যবহার করতেন। বাংলার নবাবের কাছে দু’একটা পত্রও এসেছিল কয়েক বছর আগে ওগুলো তো নজফ খাঁই পাঠ করে নবাবকে শুনিয়েছিলেন। দিল্লির বাদশার কাছে যখন এর জবাব দেয়া হয়েছিল সেটা লেখা হয়েছিলো অদৃশ্য কালিতে। খসরু ফার্সি ভাষা জানতেন না তাই তিনি বাধ্য হয়ে নজফ খাঁকে অদৃশ্য কালি তৈরির পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

নজফ খাঁর এত বছর পর আজও মনে আছে খসরু তাকে বলেছিল-

পাঁচ ড্রাম এমিল কপার অ্যামিটোল আর্মেনেট তিন আউস অ্যামিটেন, এক মিল এমিল এ্যালকহল হলে মিশিয়ে প্রচ- গরম করতে হয়। এই গরম করার সময় যে বাষ্প বের হয় তাতে মিশ্রনের মধ্যে থাকা তেল, মোম ঘন অবস্থায় থাকাসহ আঠালো পদার্থ উবে যায়। এরপর রাসায়নিক পদার্থটিকে ঠা-া করে কাঁচের বোতলে সংরক্ষণ করতে হয়। এই সংরক্ষিত পদার্থটিই অদৃশ্য কালি। খসরু নজফ খাঁ সতর্ক করে দিয়েছিলেন এই কালি বানানোর সময় বাষ্প যেন কোনোভাবেই নাসিকা দিয়ে প্রবেশ না করে তা হলে ঐ ব্যক্তির জীবন বিপন্ন হবে।

এই কালি দিয়ে শুধু কাগজে নয় কাপড়েও লেখা যায়। নজফ খাঁর মনে পড়ছে দিল্লি থেকে যে চিঠি এসেছিল সেটা ছিল রেশমী রুমাল। যার পাঠোদ্ধার করা হয়েছিল আগুনের ছেক দিয়ে। নজফ খাঁ এক পা দু পা করে ঝুলাওয়ালা লোকটির কাছে এলেন, সরাসারি সামনে না গিয়ে পাশে দাঁড়ালেন। লোকটা তার দিকে জিজ্ঞেস দৃষ্টিতে তাকালেন- তার মানে কি চাও?

নজফ খাঁ বললেন, জনাবের হাতে ওটা কি, কোনো জরুরি বার্তা?

লোকটি রুমাল আকৃতির কাগজটি ঝুলার নিচে রেখে আবার জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালেন। তার মানে- তুমি কি করে জানলে এটা তো একটা সাদা কাগজ।

নজফ খাঁ জবাব দিলেন, সাদা কাগজেও বার্তা থাকে।

 লোকটির একইরকম দৃষ্টি, তার মানে তুমি কি করে বুঝলে?

-এটা বুঝার বিষয় নয়, অভিজ্ঞতার বিষয়। সম্রাট, বাদশা নবাবেরা এরকম অদৃশ্য কালিতে বার্তা, চিঠি ফরমান পাঠাতেন, আমার মনে হয় এটা তেমনি কোন কিছু হবে। আপনি রোদে দিয়ে এর লেখাগুলো দেখতে চেয়েছিলেন কিন্তু এটা তো এভাবে পড়তে পারবেন না।

 লোকটার এবার করুণ চাহনি- তার মানে কি করে এর পাঠ করা যাবে?

-আমাকে দিন

 লোকটার মুখে কোনো কথা আগেও ছিলো না এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিও বন্ধ।

নজফ খাঁ বললেন, আপনার এ জিনিস আমি নিব না, এর কোন ক্ষতিও করবো না তবে এর মধ্যে কি লেখা আছে আপনাকে জানিয়ে দিতে পারবো।

এবার লোকটি আদেশের সুরে বললো তুমি কোথা থেকে অদৃশ্য কালির চিঠি পড়া শিখলে বল? 

-আমি এক রাজকর্মচারী ছিলাম।

-না তুমি সেনাবাহিনীর উচ্ছপদস্থ কেউ ছিলে।

-ঠিকই বলেছেন জাঁহাপনা, আমি সেনাবাহিনীতে ছিলাম। কিন্তু আমার বদনসিব আমার নগরের নবাবী নেই, আমারও চাকরি নেই।

কে তুমি? কোন নবাবের সেনাপতি তুমি?

-তার আগে যদি জিজ্ঞেস করি আপনি কে জনাব? 

-আমার পরিচয় দেয়া এখন নিরাপদ নয়।

-আমার ও নবাবের নাম বলা নিরাপদ নয়।

-তাহলে কোনটা নিরাপদ, নিজেকে লুকিয়ে রাখা?

-বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার মতে সেটাই উত্তম। আমি আপনার সংগে থাকতে চাই, আপনার সেবা করতে চাই।

- কেন থাকবে, আমার সাথে, আমি প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ঘুরছি।

- সেজন্যই তো আপনার ছায়া হয়ে থাকার বাসনা জেগেছে, জন্ম আর মৃত্যু নিয়েই সারাজীবন যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করেছি, হক আর বাতেল নিয়ে আমার জীবন কেটেছে।

ঝুলাধারী ব্যক্তি বললেন, কি পরিচয়ে থাকবে তুমি?

-আমি আপনার গোলাম আর আপনি আমার মনিব।

-আমার গোলাম রাখার সামর্থ নেই, যে সময় ছিলো সে সময় রেখেছি এখন এমন অবস্থা চেনা মানুষ দেখলে অচেনা লাগে, বিশ^াস করতে ভয় জাগে।

ঝুলাধারী ব্যক্তি এবার ঝুলার নিচে রাখা কাগজটি বের করলেন। নজফ খাঁ বললেন এটা দেখেই আপনার কাছে আসা জনাব, আমার খুব ইচ্ছে এতে কি লেখা আছে সেটা দেখার।

তুমি কি পারবে?

-মনে হয় পারবো।

-এখন বড় দুঃসময়, চেনা মানুষ দেখলে অচেনা বলে মনে হয়, দিল সাই না দিলেও মুখে বলি তুমি আমার অচেনা।

-আমার ও একই অবস্থা, আমি আমার নবাবকে খোঁজে ফিরছি, হৃদয়বান কোন ব্যক্তির কাছাকাছি এলেই তাকে নবাব বলে ভক্তি করতে ইচ্ছে হয়।

ঝুলাধারী ব্যক্তি মুচকি হাসলেন তারপর কাগজটি নজফ খাঁর হাতে দিয়ে বললেন, দেখ এর ভিতর কি আছে? 

নজফ খাঁ তার ঝুলার ভিতর থেকে চকমকি পাথর বের করলেন যে গাছের নিচে বসেছিলেন সেখান থেকে কিছু শুকনো পাতা জড়ো করলেন। তারপর চকমকি ঠুকে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। 

ঝুলাধারী ব্যক্তি আর্তনাদ করে বললেন হায় হায়! একি করছো তুমি, এটাকে পুড়িয়ে ফেলবে নাকি?

-না জনাব এর পাঠোদ্ধার করবো?

-আগুন দিয়ে পুড়িয়ে?

-না, দেখুন কিভাবে এর লেখা স্পষ্ট হয়।

নজফ খাঁ আগুন জ¦লে উঠার পর রুমাল আকৃতির কাগজটি আগুনের উপর ধরলেন।

ঝুলাধারী ব্যক্তি তাকিয়ে আছেন, কোন লেখা দেখা যাচ্ছে না।

-কিছুই তো দেখছি না।

- দেখবেন, অনেকদিনের পুরানো তো একটু তাপ লাগবে।

ঝুলাধারী চুপ করে রইলেন নজফ খাঁ কাগজটি একইভাবে আগুনের উপর ধরে আছেন ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে কাগজে লেখা গোপন বাণী।

প্রথম বাণী-

ঝুটা ডর, বদ খেয়াল

ফালতু বাদ

লুকছানি আওয়াজ কি

তাছিরছে মাহরুম রয়েগা।

দ্বিতীয় বাণী-

তন্দুরস্তি হাজার নিয়ামত

নফসে মুতমাইয়িনা

পেরেশানী আমল

জান্নাতি জিন্দেগী।

তৃতীয় বাণী-

দিল ওয়াজুত কা আমির হায়

ওয়াজুত হামেশা দিলকো

ইফতেদা করেগা।

ঝুলাধারী নজফ খাঁর দিকে তাকালেন নজফ খাঁও তার দিকে তাকিয়ে আছেন।

নজফ খাঁ বললেন, আপনি যে ভাবনায় ছিলেন এই বাণীগুলোর মধ্যে মনে হয় তার সমাধানের ইঙ্গিত আছে।

-সমাধানের ইঙ্গিত নয়, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার একটা ইশারা বলতে পার।

-মানুষ যখন পেরেশানীতে থাকে তখন পেরেশানীর খারাপ দিকগুলি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না।

-ঠিক বলেছ, এতদিন কোনো মানুষের সংগে কথা না বলতে বলতে এরকম ভাবনা মাঝে মাঝে হতো, হয়তো আর কারো সাথে কথাই বলবো না, কথা বলতে ভাল লাগবে না, কিন্তু তোমার সংগে কথা বলতে এখন আর অস্বস্তি লাগছে না। মনে হচ্ছে, কথা বললে মনের ভার কেটে যায় ক্ষণিকের জন্য হলেও ভারমুক্ত হতে পারি।

নজফ খাঁ বললেন, আপনার ভাবনা যথার্থ, কিন্তু কথা বলার সময়ও যারা দুজন কথা বলে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। আমি আপনার সাথে কি সম্পর্কে, কোন পরিচয়ে কথা বলবো?

 তোমার যা ইচ্ছে।

-আমি যার সেনাপতি ছিলাম তার চেহারার সাথে আপনার চেহারার পুরোপুরি মিল আছে, আমি কি আপনাকে জাঁহাপনা বা নবাব সম্বোধন করতে পারি?

ঝুলাধারী নজফ খাঁর দিকে এবার আরো গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর বললেন, আমিও একজন নবাবকে চিনতাম তার সেনানায়কের চেহারা তোমার মতো, তবু তোমাকে আমি সেনাপতি বলবো না কারণ, আমাদের দুজনের চেহারা দুই প্রভাবশালীর মতো। এ কারণে-

-এ কারণে কি জনাব?

-আমরা এখন বন্ধু।

নজফ খাঁ হাত জোর করে বললেন, যার চেহারা জাঁহাপনার মতো তাকে তো সব সময় মনিব বলেই ভেবেছি, এখন কি বন্ধু ভাবতে পারবো?

-তাহলে আমরা দুজন সওদাগর।

-একি বলছেন জনাব, আমার হাতে কানাকড়িও নেই, আছে ঝুলার ভিতর পাগড়ি একটা কিরিঞ্জাল আর যুদ্ধের ময়দানের আক্রমণ পরিকল্পনার কিছু কাগজপত্র।

- তোমার ওসব জিনিস তোমার কাছে থাক আমার কাছে এখনো একশ’ মোহর আছে, ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিলেও এগুলো দিয়ে আমরা তেজারতি করবো না। প্রয়োজনে অসহায় মানুষকে সাহায্য করবো। 

-আপনার কথাই মঞ্জুর চলুন এ স্থান ত্যাগ করি।

-এ স্থান ত্যাগ করে কোথায় যাব? তুমি যার চেহারার সাথে আমার চেহারার মিল খুঁজে পেয়েছো, তিনি বলতেন বাংলার মাঠ ছেড়ে কোথাও গেলে মনে হয় আমি আমাকে হারিয়ে ফেলেছি।

নজফ খাঁ মনে মনে বললেন নবাবের মুখে তিনি বহুবার এ কথা শুনেছেন। তিনি যুদ্ধ যাত্রার সময় সমগ্র সেনাবাহিনীর সাথে যখন কথা বলতেন তখন এ কথাটাই সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, আমরা জীবন হারাতে পারি মাঠ যেন না হারাই।

নজফ খাঁ বললেন, আমি আপনার সাথে একমত তবে এভাবে এই গাছতলায় থাকা কি আপনার জন্য নিরাপদ।

ঝুলাধারী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তারপর বললেন, তোমার ভয় করছে? তাতো করবেই তুমি কি জান ভয় মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসে। আগুন ছেক দিয়ে যে লেখা তুমি উদ্ধার করেছো প্রথমেই তাতে ভয়ের কথা আছে। অমূলক ভয় মানুষকে দুর্বল করে, তার ইচ্ছা, স্বপ্ন, সাহসকে পঙ্গু করে দেয়।

-এটা অমূলক ভয় নয় আর আমি আমার জীবনের মায়া করি না আমার চিন্তা আপনাকে নিয়ে। 

এইভাবে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনার পায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে।

ঝুলাধারী ব্যক্তি এতক্ষণে খেয়াল করলেন তার চটিতে কাদা লেগেছিল বলে সেটা তিনি ঐ গাছের তলায় রেখে এসছেন। চটির কথা মনে পড়ার পর তার মনে হলো, পা দুটি সত্যি ব্যথা হয়ে গেছে কিন্তু গ্রামের রাস্তার পাশে তাদের বসার কোনো উন্মুক্ত জায়গা নেই। হাঁটতেই হবে দুজনই সামনে পিছনে হেঁটে চলছেন ঝুলাধারী সামনে নজফ খাঁ পিছনে। সামনেই একটি বটগাছ তার পাশ দিয়ে নদী কিছু মানুষ ঐ গাছের নিচে জড়ো হয়ে কি যেন করছে।

ঝুলাধারী বললেন, ওখানে কি হচ্ছে দেখে এসো।

নজফ খাঁ বললেন, আপনাকে একা রেখে যাওয়া কি ঠিক হবে? 

তাহলে চলে আমিও যাই।

সমাবেশের কাছাকাছি যাওয়ার পরই তারা গায়েব আওয়াজ পেলেন। কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই একজন সুর করে পড়ছে-

শুন সবে একভাবে কাব্যরসের কথা

নবাবে লুটিল কুটির শহর কলিকাতা।

নবাবের খবর শুনি দুধে ধোওয়া কোম্পানী কহিছে,

তয়ের কর দেখি ফিরিছি কত তেলেঙ্গা আছে।

বিলাতি জাহাজ পুরে, চলো ঠেলে বানের শহর দিয়া মধ্যে কার নদী পাড় হবো হকসিদ্ধ দিয়া।

জাটাযো আজার করে।

জাটাযো আজার করে পানসীভরে দেখতে লাগে ভয়। 

যত তেলেঙ্গা সোরা কোর্তা লালে লাল।

মোকাম তার বক্সার।

মোকাম তার বক্সার সঙ্গে আছে তুড়–ক সোয়ার

আগুন পানি নাহি মানে করে

সামনে শুল্কি গেড়ে ধরল যত তেলেঙ্গা গোরা’

লাড়াই ছেড়ে পালিয়ে গেল মাহমুদ তকীর ঘোড়া।

তলোয়ার আপনি ধরে।

তলোয়ার আপনি ধরে মহিম করে পেতনী কাঁপে ডরে,

ঝিম তরাতের লেগেছে, কেউ নাই কো খোড়ে,

ঘেরলো মাহমুদ তকি, তা দেখে দাঁতে কাটলে ঘাস,

বাবুজান একটি চাবুর তেরা নফর মুজো করা।

আমলা বলে বাঙ্গল মুলুক ছেড়ে দিব ফিরিঙ্গী স্যার 

রাতারাতি মেরে নিল সূতীর বাজার।

ঝুলাধারী একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়লেন। তিনি মনে মনে বললেন তকী খাঁর বিশ^াসঘাতকতার কথা গ্রামের মানুষ ও জেনে গেছে। শুধু মীর কাসেমের দুঃখের কথা কেউ জানতে পারলো না।

নজফ খাঁ বললেন, চলুন জনাব।

-হ্যাঁ চল, এভাবে ভবঘুরের মতো ঘুরাঘুরি আর ভাল লাগছেনা।

-তাহলে কোথায় যেতে চান?

-দিল্লী। দুটো ঘোড়া ক্রয় কর তেজী ঘোড়া।

-যথা আজ্ঞা কিন্তু জনাব, আজ তো পারবো না

- চেনা প্রায় শেষ আগামীকাল ঘোড় পেয়ে যাবেন।

নজফ খাঁ এবং ঝুলাধারী ব্যক্তি মসজিদে রাত কাটিয়ে ফজরের নামাজের পর রওনা হলেন। নজফ খাঁ গতকালই ঘোড়া বিক্রেতাদের একজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তারা ঘোড়া নিয়ে এসেছে। ঝুলাধারী দাম জানেন না দাম মিটিয়েছেন নজফ খাঁ।

ঝুলাধারী আগে নজফ খাঁ পিছনে-

-  কেমন লাগছে জনাব?

- এতদিন তো পায়ের ওপর ছিলাম এখন ঘোড়ার ওপর বেশ ভাল লাগছে।

- ঘোড়া যেভাবে চলছে তাতে আমাদের দিল্লী পৌঁছতে দেড় দিন লাগবে।

- আমারও তাই মনে হয়।

-আমরা থাকবো কোথায়?

-বাদশা শাহ আলমের প্রাসাদের কাছাকাছি থাকলে ভাল হয়।

-বাদশার কাছাকাছি থাকা কি নিরাপদ? তাছাড়া আমরা বিদেশি ওখানকার লোকজন তো আমাদের এমনিতেই সন্দেহের চোখে দেখবে।

-তুমি ঠিকই বলেছো, তবে দিল্লীতে আমরা বিদেশি নই ভিস্তি। পানি বিক্রিওয়ালা।

- সেটাই উত্তম। ভিস্তিরা যেমন রাজপ্রাসাদে যেতে পারে তেমনি গরীবখানায়ও যেতে পারে ভিস্তিদের চলাফেরায় কোনো বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু ঘোড়া দুটি কি করবো?

- কেউ যদি নেয় বিক্রি করে দেবে না হয় কাউকে দান করবে?   

 ঘোড়া দ্রুতবেগে ছুটছে দিন গিয়ে রাত নেমেছে, ঘোড়ার চলার বিরাম নেই। নজফ খাঁ বললেন, রাতে নগরীতে ঢুকা কি ঠিক হবে জনাব?

- তাহলে নগরের বাইরে এখানেই অবস্থান কর।  

রাত পোহানোর পরেই নজফ খাঁ আর ঝুলাধারী কুতুব মিনারের কাছে গিয়ে হাজির হলেন। এর উপরে দাঁড়ালে পুরো শহর দেখা যায়। ঝুলাধারীর একবার উঠতে ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু বয়সের কথা চিন্তা করে নিজেই মুচকি হাঁসলেন।

- আমরা কি এখানেই থাকবো?

-হ্যাঁ ভিস্তিওয়ালারা যে কোন জায়গায় থাকতে পারে রাস্তার পাশে ঢেড়া তোলার ব্যবস্থা কর, আর ঘোড়া দুটোকে ছেড়ে দাও।

- ঘোড়া দুটি তো বিক্রি করার কথা বলেছিলেন,

-হ্যাঁ, কিন্তু এখন ভেবে দেখলাম, এতে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, আর এগুলো যুদ্ধের ঘোড়া সাধারণ ব্যবসায়ীরা বিক্রি করে না। ঢেড়া তোলা হয়ে গেছে। নজফ খাঁ ঢেড়ার ভিতর চটের একটি বিছানাও করে রেখেছেন।

এরপর জনাব একটু আরাম করতে পারবেন। 

ভিতর থেকে নজফ খাঁ ডাকলেন-

- আসুন জনাব।

ঝুলাধারী ভিজে কাপড়ে ঢেড়ার সামনে এসে জানালেন তিনি সামনের পুকুর থেকে গোছল সেরে এসেছেন।

খুব ভাল হয়েছে, আমি আপনার জন্য শাহী রুটি আর মাংস এনে রেখেছি। খেয়ে বিশ্রাম নিন।

- ভিস্তিওয়ালাদের কি শাহী রুটি মোগলাই পরাটা খাওয়া শোভন।

নজফ খাঁ বললেন, যার চেহারা নবাব মীর কাসেমের মত তার কি ঢেড়ার মধ্যে থাকা শোভন?

-  চেহারা এক হলেই তো বিপদ বাড়ে।

- এ জন্যই এ শাহী রুটি তাতে বিপদ দূরে থাকে।

ঢেড়ার ভিতর ঢুকে ঝুলাধারী তাজ্জব বনে গেলেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে কি সুসজ্জিত ঘর তৈরি করেছে নজফ খাঁ, যুদ্ধের সময় নবাবদের থাকার জন্য যে ধরনের আয়োজন থাকে সেই রকমই ক্ষুদ্র আয়োজন।

ঝুলাধারী রুটি মাংস খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে যাওয়ার পরই তিনি স্বপ্ন দেখতে লাগলেন, বাংলা আবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছে। দলে দলে মানুষ যুদ্ধে নামছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে, দেশীয় ইংরেজ দালালেরা পালিয়ে যাচ্ছে তিনি তার পতœী জুহুরা বিবির হাত ধরে মীর জাফরের মহল থেকে বের হচ্ছে। এমন সময় পিছন থেকে জহুরা বাঈকে জড়িয়ে ধরলেন, মীর জাফর পতœী মুন্নি বেগম, তার পিছনে মীর নাজিমউদ্দৌলা, মনি বেগম বলছেন, তোমরা এখানেই থাক যেয়ো না তোমরা চলে গেলে বাংলার মানুষ আমাদের ছাড়বে না। মীরজাফর ও এগিয়ে আসছেন ধীরে ধীরে, বাবা কাসেম।

তিনি কোন উত্তর দিলেন না। জহুরা বিবিকে নিয়ে মীর জাফরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেন। মুর্শিদাবাদের মানুষ তখন মীর জাফরের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছে। মনি বেগম কাঁদছে, জহুরা বিবিও কাঁদছে মুর্শিদাবাদের জনতা শুধু নয়, সমগ্র বাংলা থেকে দলে দলে মানুষ মীরজাফরের বাড়ির চারিদিকে জমা হয়েছে।

জহুরা বিবি মীর কাসেমকে বলছে, আপনি আমার বাপকে বাঁচান।

-  তোমার বাপ কি ভাল কাজ করেছে?

বক্সার যুদ্ধের পর আপনি যখন আর ফিরে এলেন না তখন আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন

- আমার জন্য কি করেছেন?

-আপনার জন্য কি করা যায় এই চিন্তা করেছেন, মীর কাসেম মুচকি হাসলেন, কি করা যায় সেই চিন্তা করেছেন, তিনিই যে ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে মীর কাসেমকে কাটোয়া, গিরিয়া, উদয়নালা এই তিনটি যুদ্ধেই পরাজিত করেন। আর বক্সার সেটাতো ছিলো দিল্লীর বাদশা শাহ আলম আর অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার- নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা।

জহুরা বিবি মীর কাসেমকে বলল, বাড়ির চারিদিকে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সৈনিকেরাও আছে তারা আপনার অনুসারী, আমার বাবাকে আর একবার সুযোগ দিন। নবাবি আপনি করুন, কিন্তু আমার পিতা যেন যথাযথ সম্মান পান। আপনি এই ঝামেলা সামলান।

মীর কাসেম জবাব দিলেন দাম্পত্য জীবন আর রাজনীতি এক নয়। তুমি আমাকে যুদ্ধের ময়দানে যেতে সব সময় বারণ করেছ। বলেই সিরাজউদ্দৌলার মতো আমাকে বিশ^াসঘাতক সেনাপতিরা শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারে। এসব কথাও বলেছ তোমার বাপের বুদ্ধিতে। আমি তোমার বাপকে শত্রুর হাতে নয়, বাংলার মানুষের হাতে তুলে দিব।

- তা আর পারবে না মীর কাসেম, বললো তার পিছন থেকে মীর জাফরের এক অনুচর। ইংরেজদের কাছে নবাব অবরুদ্ধ হওয়ার বার্তা পৌঁছে গেছে। ইংরেজ সেনারা মুর্শিদাবাদের দিকে আসছে।

- চলো জহুরা।

- না আমার পিতা, ভ্রাতা স্বজনদের ছেড়ে

কোথাও যাব না। বরং আপনি এখানে থাকুন। আপনাকে ইংরেজদের হাত থেকে রক্ষা করবো। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সব অপরাধ যাতে তারা ক্ষমা করে দেন, সেই ব্যবস্থা করবো।

- না, আমি আর কারো অনুগ্রহ চাই না। না ইংরেজদের না তোমার বাবার।

-তাহলে তোমার পথ তুমি দেখ। আমি অন্দরে চললাম।

- বিশ্বাস ঘাতকিনী। চিৎকার করে উঠলেন ঝুলাধারী। নজফ খাঁ দৌড়ে ঢেড়ার ভিতরে এলেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

-জনাব, আপনার ঘুমের ব্যঘাত করলাম নাতো?

ঝুলাধারী চুপ করে রইলেন। নজফ খাঁও চুপ। এতদিন দুজন এক সঙ্গে আছেন এর আগেও ছিলেন। তবু কেউ কাউকে পরিচয় দিতে পারছেন না। এর চেয়ে বড় ব্যাঘাত আর কি হতে পারে? ঝুলাধারী বললেন বাড়িতে তোমার স্ত্রী ছেলেমেয়ে আছে তো?

নজফ খাঁ চুপ করে রইলেন। কী উত্তর দিবেন তিনি। যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে তিনি ঝুলাধারীর সঙ্গে এর মধ্যে কত কিছু ঘটে যেতে পারে।

হয়ত মীরজাফরের অনুচরেরা তার বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছে। তার স্ত্রী মেয়ে যদি যুদ্ধের পরাজয়ের সংবাদ শুনার পরও ওখানে থেকে থাকে তাহলে  তা বিপদ।

- বুঝেছি তুমি চিন্তিত। এক কাজ কর তোমার কোনো বিশ^স্ত লোক থাকলে তার মাধ্যমে পরিবারের কাছে কয়েকটি মোহর পাঠিয়ে দাও।

এবার নজফ খাঁ নিশ্চুপ। দিল্লীতে তার অনেক লোকই পরিচিত কিন্তু এসময় তিনি আছেন আত্মগোপনে এসময় কি কারো কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করা উচিত

নজফ খাঁ ভিস্তিগুলি ঢেড়ার সামনে রেখেছেন। বেলা ওঠার আগেই তিনি বাড়ি বাড়ি পানি দিয়ে আসেন। সবাই ঠেলাগাড়িতে ভিস্তি নিতে পারেন না কেউ নেয় পিঠে করে কেউ বাইকের এমাথায় ওমাথায় বেঁধে। নজফ খাঁ নেন গাধার পিঠে। এজন্য প্রতিদিন চারটি গাধা ভাড়া করতে হয়।

তিনি পানি বিক্রি করার সময় কারো সঙ্গে দর-দাম করেন না, কেউ যদি টাকা না দিতে পারেন তার বিরুদ্ধেও কোনো নালিশ করেন না।

বাদশার আশেপাশের বাড়িতে নজফ খাঁ পানি দিয়েছেন। শাহী মহলে এখনো ঢুকতে পারেননি। এখানে অন্য ভিস্তিওয়ালারা পানি দেয়। দু’একজন হিজড়ার সাথে দেখা হয়েছে, কেউ হাসে, কেউ ভেংচি কাটে। নজফ খাঁ কিছু বলেন না। না তাকানোর ভান করে ফিরে আসেন। কোন কোন সময় তার মনে হয় তিনি বোধ হয় ভিস্তিওয়ালা হয়েই জন্মেছিলেন। বাড়ির সামনে গিয়ে হাঁক দেন ভিস্তিওয়ালা হাজির, পানি নিয়ে নিন।

আজ রাস্তায় ইংরেজ সেনাদের বহর গোরা সৈন্যও আছে। নজফ খাঁ পাগড়ি দিয়ে মুখ ঢাকলেন গোরা সৈনিকদের মধ্যে কেউ তাকে চিনে ফেলতে পারে। দুপুর গড়িয়ে গেছে, জোহরের নামাজ পড়া হয়নি। নজফ খাঁ পাশের মসজিদের নামাজ পড়ার জন্য রওনা হলেন। জামাত শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে, তার আফসোস হলো আজ জামাতে নামাজ পড়তে পারলেন না। মসজিদ থেকে ফেরার পথে একজন অপরিচিত লোক নজফ খাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো।

নজফ খাঁ বললেন, আমি তো ভিস্তি নিয়ে আসিনি। মসজিদে এসছিলাম। 

 লোকটা নিচু গলায় বলল, তা আমি জানি। আমি দিল্লীতে এসেছি তিনদিন, আগে আপনাকে খুঁজেছি, আজ পেয়ে গেলাম।

নজফ খাঁ বললেন, আমি তো একজন ভিস্তিওয়ালা আমাকে খুঁজছেন কেন?

একটা জিনিষ দেয়ার জন্য। আপনার হাতেই এটা নিরাপদ। আপনাকে দিলেই যিনি যার উদ্দেশে এটা দিয়েছেন তিনি পাবেন।

নজফ খাঁ চিন্তিত হলেন, লোকটা ইংরেজদের গুপ্তচর কিনা বুঝতে পারছেন না। রাস্তায় লোক সমাগম কম, যদি ইংরেজদের গুপ্তচর বা দালাল হন তাহলে কৌশলে নির্জন জায়গায় নিয়ে খতম করে দিতে হবে। এখন কিছু বলার দরকার নেই।

এটা কি জিনিষ, কেন আমাকে দিতে চান?

এই নিন। বলেই লোকটা একটা রেশমী রুমালে জড়ানো বস্তু নজফ খাঁর হাতে তুলে দিলো। দেয়ার পর বললো, একটা অনুরোধ রাস্তায় এটা খুলবেন না, আর একা একা পড়বেন না। যেখানে থাকেন সেখানে চলে যান তার পর পড়ুন। 

নজফ খাঁ রেশমী রুমালে জড়ানো বস্তুটি হাতে নেয়ার পরই লোকটা নিমিষে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

নজফ খাঁ এক পা দু’পা করে ঢেড়ায় এলেন।

ঝুলাধারী এখন ঢেড়ায় নেই, এসময় তিনি বেরিয়ে যান। 

কোথায় যান, নজফ খাঁ কোন সময় জানতে চাননি। ঝুলাধারী তাকে বলেননি।

নজফ খাঁ রুমালে জড়ানো বস্তুটি খুললেন একটা পত্র তিনি পড়তে লাগলেন।

এলাহী ভরসা

এই জয় ও মঙ্গলযুক্ত সময়ে এই মহামান্য ও বিশ্বাসযোগ্য অনুরোধপত্র দ্বারা মীর কাসেম আলী খান এখন বাংলার নবাব না থাকলেও বর্তমান নবাব নজমদ্দৌলা তাহাকে নবাব হিসেবে সম্মান করেন এবং তিনি মুর্শিদাবাদে আসিলে তাহাকে নবাবের প্রাপ্য সম্মান দেয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করিতেছেন। এই ব্যাপারে বর্তমান হাকিম আমলা এবং মৃৎসুদ্দীদের জানাইয়া দেয়া হইয়াছে যে, উল্লেখিত ব্যক্তিকে সম্মোধন করিবার সময় নামের আগে নবাব বলিয়া সম্মোধন করেন। এই বিষয়টি যাহাতে যথার্থভাবে যতœ লওয়া হয়, তাহার জন্য যাহা আবশ্যক তাহা হুজুর আল হইতে তাগিদ দেওয়া হইয়াছে।

যিনি মহামান্য বাংলার ন্যায়পরস্বরূপ, যিনি বাংলার বিশ্বাসনীয়, সম্ভ্রান্ত বংশীয় উচ্চ পদস্থ ও ক্ষমতাসম্পন্ন, যিনি রাজ্যের ধনের সুবন্দোবস্তকারী যিনি তরবারী ও লেখনী পরিচালনায় সুনিপুণ, যিনি পতাকার উন্নয়নে সামর্থ, যিনি সুবন্দোবস্তকারী নিরপেক্ষ নবাব যিনি শুধু বাংলা নয়, সমগ্র ভারতের অবলম্বনস্বরূপ, তিনি তার উজির ও সেনাপতিগণের সবার বিশ^স্ত ও বন্ধু সেই নবাব মনসুর মূলক মীর কাসেম আলী খান নবাব ও জঙ্গ সিপাহসালারের সেনানিবেশ বরাবরেষু।

এই জয়যুক্ত ও আনন্দযুক্ত সময়ে এই চিরস্থায়ী নবাবীর আদেশ দ্বারা মীর কাসেম আলি খান পুনরায় বিশ্বাস ও গৌরবের মূলধন স্বরূপ নবাব খিতাব প্রাপ্ত হইলেন। বাংলার সমগ্র এলাকার বর্তমান ও ভবিষ্যত হাকিম, আমলা ও মৃৎসুদ্দীদের উচিত যে, তাহারা যেন উল্লেখিত ব্যক্তিকে নবাব মীর কাসেম আলি খান নেবেন এবং এ বিষয়ে মনোযোগ দেন। এই ক্ষণে মহামান্য আদেশপত্রে প্রকাশ পাইল যে, মীর কাসেম আলি খান যদি জীবিত থাকেন এবং ইচ্ছা পোষণ করেন তাহা হইলে তিনি মুর্শিদাবাদে অনুপস্থিত থাকিয়া নবাবী চলাইতে পারেন এবং তাহার ইচ্ছানুযায়ী নবাবের কর্মচারী কানুনগো নিযুক্ত করিতে পারেন। তাহার মর্জি মতো কোনো ব্যক্তিকে অপসারণ করিতে হইলে তিনি লিখিত আদেশের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থাও করিতে পারিবেন। তাহার সম্মতিও আজ্ঞা পাইলে এই ফরমান জনগণের মধ্যে প্রচার করিয়া দিব।

মীর নজবুদ্দৌলাহ

বর্তমান নবাব

মুর্শিদাবাদ।

নজফ খাঁ ঝুলাধারী ঢেড়ায় আসার পর তাকে চিঠিটা না দেখিয়ে প্রথমে বিষয়টি নিয়ে অন্যভাবে আলাপ শুরু করলেন।

- আপনি কি শুনেছেন জনাব?

- কি হয়েছে?

-মুর্শিদাবাদের বর্তমান নবাব নাকি মীর কাসেমকে নবাব হিসেবে মেনে নিয়েছেন, মীর কাসেমের সম্মতি পেলে তিনি এই ফর্মান প্রচার করবেন।

ঝুলাধারী হাসলেন। তারপর ঢেড়ার বাইরে এসে আসমানের দিকে তাকালেন। আকাশে চাঁদ আছে কিন্তু মেঘে ঢাকা কালো মেঘ চাঁদকে ঢেকে দেয়। কখনো চাঁদ আলো ছড়ায়।

- কিছু বলছেন না যে?

-আমি তো মীর কাসেম নই আমি ভবঘুুরে যদি মীর কাসেমের সাক্ষাত পাও তাকে বল তিনি জবাব দিবেন।

আপনার বিবেচনায় মীর কাসেমের এ অবস্থায় কি করা উচিৎ?

ঝুলাধারী আবার কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন রাজনীতি বড় জটিল বিষয়। রাজনীতির খেলা একেক সময়ে একেক রকম। 

তুমি কি জান ব্রিটিশ পার্লামেন্ট রেগুলেটারি আইন পাশ করেছে?

- আমি পানি বিক্রি করতে গিয়ে শুনেছি কিন্তু বুঝতে পারিনি। এখন বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতের গভর্নর জেনারেল। এখন আর নবাবদের কোনো ক্ষমতা নেই, কোম্পানির কালেক্টরদের যে ক্ষমতা নবাবদের সে ক্ষমতা নেই। এখন আর নবাবদের কোন সেনাবাহিনী থাকবে না। তারা মূলত: কোম্পানীর কর্মচারী।

-জনাব তাহলে মীর কাসেমের কি হবে, মুর্শিদাবাদের নবাব নজমুদ্দৌলার ধারণা মীর কাসেম দিল্লীতে আছেন। তাকে দেয়ার জন্য নাকি একটা পত্রও নবাব দিয়েছেন।

ঝুলাধারী এবার বিমর্ষ হলেন, বললেন- আমার চেহারা তো মীর কাসেমের মতো এ ঢেড়া ভেঙে ফেল, চল আমরা দিল্লীর বাইরে চলে যাই।

- আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে কাল না হয় চলে যাব।

-তুমি যা ভাল মনে কর, তবে আমার মনে হয় নজমুদ্দৌলার মাধ্যমে ইংরেজদের কাছেও এ খবর পৌঁছে গেছে।

-ওয়ারেন হেস্টিংস তো থাকেন কলিকাতায়। দিল্লীতে ইংরেজরা কি করবে?

- হয়তো বাদশাকে জানিয়েছে। দিল্লীর বাদশা শাহ আলমকে ইংরেজরা বাদশাহ বলে স্বীকার করলেও তার কোনো আদেশ এখানে কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। তিনিও তো ইংরেজদের বৃত্তিভোগী বাদশাহ। বক্সার যুদ্ধের পর তিনি মুকুটহীন বাদশাহ হয়েছেন।

-আমি রাজপ্রাসাদের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় কিছু সৈনিক জেনেছি।

-হ্যাঁ আছে একজন কোম্পানীর প্রতিনিধি সবসময় তার দরবারে থাকে, বাদশার প্রতিদিনের কার্জকলাপ আচার আচরণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে জানানো হয়।

নজফ খাঁ মনে মনে বললেন, আপনি তো সবই জানেন জাঁহাপনা, আপনিও তো বাংলার স¤্রাট ছিলেন কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আমার কাছেও স্বীকার করছেন না। আমিও তো চাই আমি যেন দুনিয়া ছাড়ার আগে বাংলার মানুষ ইংরেজদের সাথে লড়াই করছে এ দৃশ্য দেখি। আমার নিজের বয়স হয়েছে, আগের মতো শরীরে বল নেই কিন্তু মনের শক্তি হারায়নি।

- কী ভাবছ নজফ খাঁ?

- আমি ভিস্তিওয়ালা চামড়ার মশক আর গাধার পিঠে পানি বোঝাই করা আর কি ভাবনা ভাবতে পারি?

ঝুলাধারী হাসলেন, বড় করুণ সে হাসি। আজ রাতের পর দিল্লীর শহরে তার থাকা হবে না। বাইরে গিয়ে কোথায় থাকবেন তাও জানেন না।

দুজনের কারো চোখে ঘুম নেই, একবার ঝুলাধারী দীর্ঘশ^াস ছাড়েন আবার নজফ খাঁ। এভাবেই রাত কেটে গেলো। মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে আচ্ছালাতু খাইরুম মিনান নাউম।

দুজনই ঢেড়ার পাশে নামাজ পড়ে নিলেন। তারপর বিসমিল্লাহ তাওক্কালতু আল্লাহ বলে রওনা হলেন। ঢেড়ার কিছুই তাদের সঙ্গে নিলেন না। শুধু মশক আর চারটি গাধার মধ্যে দুটি গাধা।

সকালে লোকজন এসে দেখলো রাস্তার পাশে ঢেড়াটি শূন্য। একজন বললো-

- এখানে একজন সূফি ছিলেন?

- তার একজন শিষ্যও ছিল?

আরে শিষ্য না মুরিদ।

-হ্যাঁ মুরিদ ছিল।

- আমি দু’একবার সূফির সাথে কথা বলতে চেয়েছি, পারিনি, গোঙ্গা কিসিমের মানুষ ছিলেন।

- জেকের আজকারে থাকতেন। কিন্তু এখানে কোন লোকের যাতায়াত ছিল না।

-সূফিরা এক জায়গায় থাকেন না, জায়গায় জায়গায় ঘুরে খানকা গাড়েন।

ঐ দুইজন ইংরেজ প্রহরী আসছে?

-চল, এখান থেকে ভাগি।

 ঘোড়ার উপর থেকে একজন প্রস্থান উদুত দুই ব্যক্তিকে ডাকলো-

 তোমহারা ইখানে কি করছিলে?

- এখানে একজন সূফি ছিলেন, তার কাছে এসেছিলাম তিনি চলে গেছেন।

-ছপি, সেন্ট। আমরা তো খবর নিয়েছি ইখানে মীর কাসেম লুকিয়ে আছিলেন।

- কী বলছেন স্যার, এখানে এক ভিস্তিওয়ালা আর এক সূফি থাকতেন, পানি বিক্রি করে এদের দুইজনের জীবিকা নির্বাহ হতো।

-ইরা কোথায় গিছে তোমরা জান?

- আমরা কি করে জানবো, আমরা তো তার দেখা পাইনি।

-আমাদের স্পাই দিল্লীর সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছে মীর কাসেম আর তার ভিস্তিওয়ালাকে খোঁজে আনবে।

-আমরা কি করে আনবো, তাছাড়া আমাদের তো ঘোড়া নেই।

-  ঘোড়া থাকলে কি তোমরা খুঁজিয়া আনিতে পারিতে

- চেষ্টা করতাম।

- চল, কোম্পানি কুটির হইতে তোমাদের ঘোড়া দেওয়া হইবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটি তাগড়া ঘোড়া নিয়ে গোরা সৈন্যরা হাজির হলো। দুইজন এতক্ষণ কথা বলছিল, তারা ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।

- কি হলো/

- সাহেব আমরা তো এত তাগড়া ঘোড়ায় কখনো চড়িনি। একটু হাঁটিয়ে তারপর বশ করতে হবে।

এমন সময় এক লোক দৌড়ে এসে খবর দিলো এখান থেকে অর্ধ মাইল দূরে দুই বাংলাভাষীকে ইংরেজ সৈন্যরা ধরে ফেলেছে। তাদের মধ্যে একজনের চেহারা মীর কাসেমের মতো। তিনি আহত। সৈনিকরা তাকে থামতে বলেছিল তিনি তাদের ডাক শুনেনি। এমন কি তাদের দিকে ফিরেও তাকাননি। একারণে গোলা ছুঁড়া হয়েছে। গুলি তার পায়ে লেগেছে।

ঘোরার উপর থেকে একজন নেমে এলেন। এতক্ষণ দাঁড়ানো ঘোড়ার গদির উপর বসে কথা বলছিলেন।

- তুমি কি দেখেছ?

- আমি দেখি নাই সাহেব আমি শুনেছি।

তাদের নাকি দিল্লীতে নিয়ে আসছে।

দিল্লীর যে সব লোক ভিস্তিওয়ালার কাছ থেকে পানি নিত তারা সমবেত হয়েছে।

একজন বলল, কখন নিয়ে আসবে?

- এখনই।

-আরে সেই সকাল থেকে শুনছি, কেউ আসছেনা তো। 

- আমরা আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে যাব। যমুনার তীরে ঘটনাটা ঘটেছে ওদিকেই যেতে হবে।

- হ্যাঁ তাই চল।

চার পাঁচজন দিল্লীর বাইরে চলে এলো। তাদের সাথে আরো কিছু লোক যোগ দিল। সবার মুখে একই প্রশ্ন মীর কাসেম কি সত্যিই দিল্লী এসেছিলেন।

যাক, আমরা এতদিন তাঁর খোঁজ পাইনি। আজ তিনি ইংরেজ সৈনিকের গুলিতে আহত, আজ যদি কোন উপকার করতে পারি আমরা করবো।

তারা যমুনার তীর পৌঁছাল। এখানে গোয়ালেরা থাকে। গাভী পালন করে। তখন রাত হয়ে গেছে। একজন বললো, এই গোয়ালাদের বস্তিতে আমরা গিয়ে খোঁজ নিতে পারি। এরা ঐ আহত লোকটি দেখেছে কিনা?

- তা নেয়া যায় কিন্তু এখানে থাকলে তো উনি ইংরেজদের হাতে ধরা পড়বেন?

- ইংরেজরা এই বস্তি এলাকায় আসে না।

- দেখা যাক।

বস্তি এলাকায় ঢুকার পথেই একজন লোককে বিমর্ষ বদনে বসে থাকতে দেখলো তার পাশে চাদর দিয়ে ঢাকা কি যেন-

- তুমি কে?

- লোকটি নিরুত্তর।

- কথা বলছ না কেন?

- কোন জবাব নেই।

- তোমার পাশে এটা কি? মনে হয় কোনো মানুষ শুয়ে আছে?

- লোকটা কেঁদে ফেললো।

- তুমি কাঁদছো কেন?

- লোকটা কোনো কথা না বলে কাঁদছে।

তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।

কথা বলার জন্য চেষ্টা করতেই আ-আ শব্দ বেরিয়ে এলো।

- বুঝেছি, তুমি মুর্দার নিয়ে বসে আছ। লোকটা কে?

- লোকটা আবার আ-আ করে উঠলো।

-আগতদের মধ্যে একজন বলল

- আমরা কি তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারি?

- লোকটা আবার আ-আ করে জোরে কেঁদে উঠলো। তারপর বলল, আর সাহায্যের দরকার নেই, সব শেষ হয়ে গেছে। সব আশা অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। সব সংকল্প, সব ইচ্ছাশক্তি এখন প্রাণহীন দেহ। এখন আমার দুঃখ প্রকাশের ভাষা নেই।

- তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি সাধারণ  লোক নও, কিন্তু যার জন্য তোমার এই শোক। তিনি কে?

- সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার নেমে এসেছে। তিনি ছিলেন বাংলার সূর্য। বাংলার পূব আকাশে উঠে, সারাদিন তিনি আলো দিয়ে পশ্চিমে ঢলে পড়েছেন।

- বল ভাই, তিনি কি মীর কাসেম?

- লোকটা আবার আ-আ করে কেঁদে উঠলো।

- আমরা তোমার সঙ্গে আছি বল কি করতে হবে।

আগত লোকজন আলো জে¦লে ঐ জায়গাটাকে আলোকিত করে ফেললো। দেখা গেল মাটির মধ্যে শায়িত মানুষটির হাতে যে আংটিটি রয়েছে তাতে কাসিতে লেখা জনসুরুল মূলক মীর কাসেম আলী খান বীর বাহাদুর।

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ