শুক্রবার ৩১ মার্চ ২০২৩
Online Edition

জ্ঞান মেধা ও দেশপ্রেম

আবু মহি মুসা:

আমরা সব সরকারের আমলেই উন্নয়নের জোয়ারের কথা শুনে আসছি। সব সরকার দেশের জন্য  কিছু না কিছু কাজ করেছে। কেউ বেশি, কেউ কম।  আমরা এটাকে অস্বীকার করতে পারবো না। সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের আমলে যে উন্নয়ন হয়েছে তা উল্লেখ করার মতো। বর্তমান সরকার যে উন্নয়ন করছে তাও উল্লেখযোগ্য। উন্নয়ন হয়েছে বাহ্যিকভাবে। কিন্তু সেই উন্নয়নের ধারা অব্যহত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে উন্নয়নের কথা বলছি,  অন্য দিকে দেশ বিভিন্ন সমস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যত বেশি উন্নয়ন, তত বেশি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে বাহ্যিক উন্নয়ন হচ্ছে  অনুনয়নের নামান্তর। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য যেমন বাহ্যিকভাবে উন্নয়নের প্রয়োজন, তেমনি অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের প্রয়োজন।

এক সময়ে দেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রাজা বাদশারা জ্ঞানী, গুণী, কবি, সাহিত্যকদের নিয়ে দরবারে বসতেন। এখন আর সেভাবে কোনো দরবার হয় না। তারা মনে করেন, তাদের সেভাবে পরামর্শের   কোনো প্রয়োজন পড়ে না। বর্তমান সময়ে যারা রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানকে  পরামর্শ দিয়ে থাকেন তারা সুচিন্তিত মতামত দিতে পারেন না। কারণ তাদের যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব রয়েছে। যেমন, মাননীয় প্রধান মন্ত্রীকে পরামর্শ দিলেন, সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দেয়া হলে তারা ঘুষ খাবে না।’ কি চমৎকার পরামর্শ। পুলিশের একজন  কনস্টবল ৬হাজার টাকা বেতন পেত। বর্তমানে সে ২৬ হাজার টাকা বেতন পায়। একজন এএসআই পাচ্ছে ৩৮ হাজার টাকা। আমি বলেছি, সরকারী কর্মচারীদের বেতন যদি সর্বনি¤œ ১ লক্ষ টাকা দেয়া হয়, দুর্নীতি কমবে না। কারণ মানুষ জন্মগতভাবে অপরাধপ্রবণ।  ফলে কি দাঁড়ালো? মুদ্রাস্ফিতি বেড়ে গেল। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ নয়, বহু গুণ বেড়ে গেল। যাদের বেতন সীমিত তারা সংসার চালাতে হিমসিম  খেয়ে যাচ্ছে। তবে যারা রিকসা চালায় তাদের পোয়া বারো। একজন রিকসা চালকের মাসিক আয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। কল্পনা করা যায়? 

আমি যে বিষয়ে কথা বলবো, তা হচ্ছে জ্ঞানহীন সিদ্ধান্তের কথা। এ সব উপদেষ্টারা সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না। তাদের  সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত এটা যাচাই করার কোনো ব্যক্তি সরকারের মধ্যে নেই। একথা অনেক বার প্রসঙ্গক্রমে লেখা হয়েছে যে, পৃথিবীর ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষের জ্ঞান হচ্ছে পশু পাখির জ্ঞানের চেয়ে কম। এ বিষয়ে কিন্তু ব্যাখ্যাও দিয়েছি। এটা পড়ে হয়তো কেউ আমাকে গালি দেবেন, নতুবা প্রশংসা করবেন। কিন্তু কেউ গালি বা প্রশংসা, কোনোটাই দেননি। তার মানে এটা তারা পড়েননি। পৃথিবীর ৯৯,৯৯ ভাগ মানুষের জ্ঞান যদি পশু পাখির জ্ঞানের চেয়ে কম হয়, সে মানুষ উপদেষ্ট হিসেবে কি উপদেশ দেবেন?

যারা দর্শন নিয়ে লেখা পড়া করেছেন, বিষয়টি তাদের জন্য অনেকটা সহজবোধ্য হতে পারে। সমগ্র বিশ^ দুটো ভাগে বিভক্ত। একটি বস্তুজগত, অন্যটি ভাবজগত। বস্তুজগৎ বলতে যা দেখা যায়, ছোঁয়া, বোঝা যায়, যার ভর আছে। কিন্তু ভাবগত বিষয় হচ্ছে যা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, বোঝা যায়, যার কোনো ভর নেই। যেমন, মানবিক মূল্যবোধ, জ্ঞান , দর্শন। এগুলো হচ্ছে ভাবগত। আমরা যেটা দেখি তার গুরুত্ব আমরা বেশি দিয়ে থাকি। ভাব জগৎ যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটা নিয়ে আমরা ভাবতে চাই না। ভাবতে পারি না। কারণ, আমাদের সে জ্ঞান নেই। প্রথম মূল্যায়ন করতে ভাবগত বিষয়কে। তারপর বস্তুগত বিষয়। তবে আমরা উন্নয়নের সফলতা পাবো। নতুবা আমরা যতই পরিকল্পনা করি না কেন, উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভেসে যাচ্ছে, সেই উন্নয়নের পেছনে সুনামি আছে সেটা আমরা বুঝতে পারি না। বিষয়টি হয়তো অনেকের কাছে দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। তবে সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো।

নারী নির্যাতন নিয়ে একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এই নারী নির্যাতন নিয়ে ইলেক্ট্রোনিক্স মিডিয়াতে অনেক বছর টক শো করা হয়েছে। টনকে টন কাগজ নষ্ট করা হয়েছে। শেষে নারী নির্যাতন আইন করা হয়েছে, শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আমি বলেছি, মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও নারী নির্যাতন বন্ধ হবে না। কেন বন্ধ হবে না?  শুধু বাহ্যিক দিকটি বিবেচনা করে আইন করা হয়েছে। তাতে আরও হিতে বিপরীত হয়েছে। অনেক পুরুষ এই আইনের অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছে। স্ত্রী স্বামীকে দমন করার জন্য অযৌক্তিকভাবে নারী নির্যাতন মামলা করেছে। নারী নির্যাতনের বাহ্যিক দিক হলো, স্বামী তার স্ত্রীকে নির্যাতন করে, কেন নির্যাতন করে? যৌতুকের জন্য। এর অভ্যন্তরীণ দিক হচ্ছে, যে স্বামী তার স্ত্রীকে ভালোবাসে , সে স্বামী তার স্ত্রীকে নির্যাতন করতে পারে না। তাহলে বলবো, নারী নির্যাতনের মূল কারণ ভালোবাসার অভাব। ভালোবাসার অভাব কেন হয়, এটা গবেষণার বিষয়। বলেছি নারী নির্যাতন আইন করে নারী নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। 

উন্নয়নের জোয়ারের কথ বলা হয়ে থাকে। সত্যি অর্থে কি দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। বাহ্যিকভাবে দেখা যায়, ফ্লাইওভার হয়েছে, পদ্মাব্রিজ হচ্ছে, মেট্রোরেল হচ্ছে। এটাকে কি উন্নয়নের মানদন্ড মনে করে যাবে? এর অভ্যন্তরীণ কারণ হচ্ছে, দেশে প্রেমের অভাব। প্রশ্ন হচ্ছে হচ্ছে প্রেম কাকে বলে? দেশপ্রেমের মধ্যে যে বিষয়গুলো থাকতে হবে, তা হচ্ছে, জ্ঞান, সততা, ন্যায়পরয়নতা,ত্যাগ, মানবিক মূল্যবোধ। এই পাঁচটি বিষয় নিয়ে হচ্ছে দেশপ্রেম। আগে বলেছি, পৃথিবীর ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষের জ্ঞান হচ্ছে পশুপাখির জ্ঞানের চেয়ে কম। তার অর্থ কারো মধ্যে জ্ঞান নেই। জ্ঞান না থাকলে সততা থাকতে পারে না, সততা না থাকলে ন্যায়পরাণতা থাকতে পারে না। ন্যায়পরায়নতা না থাকলে ত্যাগ (দেশের স্বার্থে) থাকতে পারে না। জ্ঞান না থাকলে মানবিক মূল্যবোধ থাকতে পারে না। এখন কি আর দেশপ্রেমের সংজ্ঞা দেয়ার প্রয়োজন আছে? দেশের মধ্যে কতজন দেশপ্রেমিক আছে এটা বলা যাবে? আমরা যদি বিশ^াস করি, বিশ^াস করার যুক্তি আছে যে পৃথিবীর ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষের জ্ঞান হচ্ছে পশু পাখির জ্ঞানের চেয়ে কম। এর অর্থ ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম নেই। একটা প্রবাদ আছে, ‘পান না তাই খান না।’ অপকর্ম করার সুযোগ নেই বলে আমি সত। তার মানে এই নয় আমি দেশপ্রেমিক। 

দেশের উন্নয়নের জোয়ারের কথা বলা হয়ে থাকে। এ বিষয়ে কথা বলার আগে ছোট্ট একটা গল্প বলতে চাই। খুব সুন্দর একটা মেয়ে, যার সর্বাঙ্গে রূপ। স্বর্ণালঙ্কার পরিয়ে, সাজগোজ দিয়ে তাকে আরো রূপবর্তী করা হয়েছে। তার রূপের আগুনে অনেকেই ঝলসে যেতে পারে। এমন একটি মেয়ের মাথায় যদি ‘ঘিলু’ (জ্ঞান) না থাকে, তাকে নিয়ে কি সংসার করা যায়? মাকাল ফলের দেখতে শুধু সৌন্দর্যটুকুই আছে, কোনো কাজে লাগে না। তেমনি জ্ঞানহীন সুন্দর মেয়েটি যেমন  দেখতেই সুন্দও, ঠিক তেমনি আমাদের উন্নয়নের জোয়ার বাহ্যিকভাবে দেখা যায়। দেশ থেকে কি পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, তার উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। 

এটা সবাই জানেন। কিন্তু উন্নয়নের একটি বাহ্যিক উদাহরণ দেই। রস্তা সুন্দরভাবে কার্পেটিং করা হয়েছে। ইউটিউবে দেখানো হয়েছে, সিমেন্ট বালুর কার্পেটিংয়ের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কার্পেট তুলে ফেলেছে। এটা কেন হয়েছে, সঠিক ভাবে বালু সিমেন্ট দেয়নি। বেশি মুনাফা লাভ করতে চেয়ে। কারণ, তার মধ্যে সততা ছিল না। কাজ না করে  টেন্ডারের টাকা তুলে নিয়েছে। এটা হচ্ছে দেশে উন্নয়নের নমুনা। এ জন্য দায়ী করা যাবে কাকে? সব সরকারের আমলেই এমন ঘটনা ঘটছে। আমি যদি এখনকার কথা বলি, আওয়ামী লীগ সরকার নাখোস হতে পারে। আমি যদি বিএনপি আমলের কথা বলি তাহলে বিএনপি নাখোস হতে পারে। কাজেই কাকে দায়ী করবো, এটা একটি জটিল প্রশ্ন। আমি দায়ী করবো জ্ঞানের অভাবকে। এটা গবেষণার বিষয় যে, পানির যেমন ধর্ম নিচের দিকে গড়ানো। জ্ঞানের ধর্ম ইথারের মতো নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ কমে যাওয়া।

 ইউরোপের একটি দেশের জনগণের জ্ঞান, বাংলাদেশে মানুষের জ্ঞানের লেভেল কি এক? কেউ বলবেন এক? বাংলাদেশের মানুষের জ্ঞানের লেভেল এত নিচে, এত নিচে পৃথিবীতে দুই একটি দেশ থাকলে তা আমার জানার বাইরে। কাজেই ‘উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে যাচ্ছে’ এ কথা যারা বলেন তারা একটি হাসির খরোক সৃষ্টি করছেন। এ জন্য কি করণীয়? বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে? কে ঘন্টা বাধতে পারে এমন একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক নিয়ে আসেন, শুধু দেশের বাহ্যিক উন্নয়নই নয়, এর অভ্যন্তরীণ উন্নয়ও হবে। সবাইকে সততা এবং ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। রাষ্টপ্রধান বা সরকার প্রধান যদি সত হন, দেশের জনগণ সত হতে বাধ্য। জনগণ হচ্ছে  ভেড়ার পালের মতো। সরকার প্রধান হচ্ছেন এর রাখাল। এই পালকে যেদিকে নেবেন সে দিকে যাবে। মিষ্টি কথা দিয়ে তাদের সোজা পথে নেয়া যাবে না। কারণ, মানুষ জন্মগতভাবে অপরাধ প্রবণ। 

বাংলাদেশের মতো এত সুন্দর দেশ পৃথিবীতে কতটা আছে? সুন্দরী কোনো মহিলাকে ভাগে পেলে যেমন তাকে দয়ামায়হীনভাবে ধর্ষণ করা হয়, তারপর হত্যা করা হয়। আমাদের দেশটার অবস্থা কিন্তু অনুরূপ হয়ে গেছে। শুধু দমটুকু আসছে আর যাচ্ছে। এখনও সময় আছে, দেশে অনেক জ্ঞানী বিজ্ঞানী আছেন, তাদের সম্মান দিয়ে ডাকেন, তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেন। তবে মনে রাখতে হবে, সিকিমের প্রধান মন্ত্রী লেনদুব দর্জী পার্লামেন্টে উত্থাপন করে দেশটাকে ভিন দেশের কাছে তুলে দিয়েছে। তার বর্তমান অবস্থা, আসামে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এই পরিনতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ