বিখ্যাত বায়তুল হিকমা গ্রন্থাগার

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : বিশ্ব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কালকে মধ্যযুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কখন থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কখন এটি শেষ হয়, সর্বোপরি এর পরিব্যাপ্তি নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ইউরোপীয় ইতিহাসের আলোকে মধ্যযুগ বিবেচনা করা হয় ৪৭৬ হতে ১৪৯২ সালের আগ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর সময়কালকে। এ সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের পতন, আধুনিক ইউরোপের নব যাত্রা, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নতুন বিশ্ব আবিষ্কার, ইউরোপীয় রেনেসাঁ যুগের সূচনাসহ ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্র্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব কারণে এ সময়কালটিকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়। যথা: মধ্যযুগীয় সময়, অন্ধকারের যুগ এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের যুগ ইত্যাদি।
অপরদিকে এ সময়টিতেই ইসলামের আবির্ভাব, ইসলামী সোনালী যুগের প্রবর্তন ও সমাপ্তি, বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের পতন, ক্রুসেডের যুদ্ধ ও এর প্রভাবসহ নানা ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আরব দেশের পবিত্র মক্কা নগরীতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব হয়। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নবুয়তপ্রাপ্ত হন এবং ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় হিজরত করেন এবং সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ব ইতিহাসের এক জটিল পরিস্থিতিতে তাঁর আবির্ভাব হয় এবং তিনি জাহেলিয়্যাতের কঠিন চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে আল কুরআনের শিক্ষা ও তাঁর সুমহান চরিত্রের মাধ্যমে তিনি বিশ্বে একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তিনি পরিণত হন বিশ্ব ইতিহাসের সর্বাধিক আলোচিত, প্রশংসিত এবং প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্বরূপে। তাঁর সুমহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, নেতৃত্বের অসাধারণ গুণাবলি এবং সৌন্দর্য ও সুকীর্তির সমন্বয়ে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ও মহত্তম ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁর এ আবির্ভাব ও নতুন বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে সোনালী যুগ শুরু হয়। তাঁর পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদার সময়কাল, উমাইয়া যুগ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.), আব্বাসীয় যুগ (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.), ফাতেমীয় যুগ (৯০৯-১১৭১ খ্রি.) ইত্যাদির ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ১৯২২ সালে তুরস্কের উসমানীয় খেলাফতের পতনের মাধ্যমে ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিসমাপ্তি হয়। এ দীর্ঘ সময়কালে মুসলমানরা বিশ্বে এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেন। ইসলামের ইতিহাসের এ দীর্ঘ সময়কাল সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে সকল যুগ সমান না হলেও সামগ্রিকভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশেষ করে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কাল হতে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত জ্ঞান বিজ্ঞানের সৃষ্টি ও বিকাশের জন্য ‘সোনালী অধ্যায়’ হিসেবে বিবেচিত হয়।
তথাপি ইসলামী সোনালী যুগের ব্যাপ্তি নিয়ে গবেষকদের নানা মত রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে, সময়টা সপ্তম শতকের মাঝামাঝি থেকে ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত। অর্থাৎ আব্বাসীয় শাসনামলের পতনকাল পর্যন্ত। আবার কেউ কেউ অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীকে ধরেছেন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, অবশ্য এ সময়কাল পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘায়িত। তবে অত্র প্রবন্ধে বক্ষ্যমান আলোচনা উসমানীয় খেলাফতের পূর্বযুগ (৬২২-১৪৫২ খ্রি.) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে।
আল কুরআনে বারবার জ্ঞান চর্চার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে মুসলমানরা আন্তরিকভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আত্মবিয়োগ করেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর জীবদ্দশায় তাঁর সাহাবী ও অনুসারীদের মধ্যে জ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের বিরাট কর্মচাঞ্চল্য পরিচালিত হয়। তাঁর সময়ে সাহাবীদের শিক্ষাদানের জন্য মসজিদে নববী কেন্দ্রিক যে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে সেটাই প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত। বস্তুত ইসলামের প্রাথমিক কাল থেকে শুরু করে উমাইয়া শাসককাল (৭৫০ খ্রি.) পর্যন্ত মসজিদই ছিল জ্ঞান চর্চার বৃহত্তম বিদ্যাঙ্গন। এ প্রসঙ্গে ইতিহাস পর্যালোচক ড. আহমদ আমীন বলেন, ‘‘প্রকৃতপক্ষে তখন মসজিদই ছিল জ্ঞান চর্চার বৃহৎ অঙ্গন। মসজিদ তখন নিছক উপাসনালয় ছিল না, সালাত আদায়ের পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হতো। এমনকি কাযী সাহেবের আদালত ও বিচারসভাও বসতো মসজিদেই। অবশ্যই এখানে আমরা এটুকু শুধু বলতে চাই যে, মসজিদ সে যুগে বিদ্যা চর্চার সর্ববৃহৎ ক্ষেত্র ছিল। মিসরের আমের মসজিদ, বসরার মসজিদ, কুফার মসজিদ, মক্কা ও মদীনার হারাম শরীফ প্রভৃতি মসজিদ জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে আধুনিক যুগের বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকাই পালন করত। বস্তুত ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হিসাবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদকে জ্ঞান চর্চার অঙ্গন বানিয়েছিলেন। গোটা উমাইয়া শাসনকাল পর্যন্ত মসজিদের এ ভূমিকা অব্যাহত ছিল।’’ শুধু তাই নয়, উমাইয়া যুগের পরেও ইসলামী সভ্যতায় মসজিদ গ্রন্থাগার জ্ঞান-চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে। কায়রোর তুলুন মসজিদ, আলেপ্পোর জামে মসজিদ, তিউনিসার যায়তুন মসজিদ, আল আকসা মসজিদ, বাগদাদের যায়দিয়া মসজিদ, কায়রোর আল আজহার মসজিদ, মরক্কোর আল কায়রোয়ান মসজিদ, সিরিয়ার দামেস্ক মসজিদ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস গবেষক ম্যাকারসন মসজিদ গ্রন্থাগারের ভূমিকা সম্পর্কে বলেন-
“Books were presented and many scholars bequeathed his library to the Mosque of his city to ensure its preservation and to render the books accessible to the learned who frequented it. And so grew up the great universities of Cordova and Toledo to which flocked Christians as well as Moslems from all over the world, and the famous al-Azhar in Cairo, which after almost a thousand years is still the most famous educational centre of the Mohammedan world Mackensen 1935, 123).’’
মহানবী সা.-এর অর্বতমানে তাঁর অনুসারীগণ কুরআন-হাদীস সংকলন ও সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে রাসূল (সা.)-এর সীরাত বা জীবনচরিত সংরক্ষণের প্রয়োজনে ইতিহাস রচনার দিকে মনোযোগ দেন। এর পরে কুরআন সুন্নাহর নির্দেশনা মোতাবেক জীবন পরিচালনার জন্য ইসলামী আইন শাস্ত্রের উদ্ভব হয়। জ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের এ ধারাবাহিকতায় গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, মহাকাশ বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যাসহ জীবনঘনিষ্ঠ অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞান তারা আবিষ্কার করলেন। মহানবী সা.-এর ইন্তেকালের এক শতাব্দীকালের মধ্যেই ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকা তথা স্পেন থেকে আরম্ভ করে ভারতের সিন্ধু নদ পর্যন্ত ইসলামী সভ্যতা বিকাশ লাভ করে। এ বিশাল অঞ্চলজুড়ে মুসলমানরা জ্ঞান সৃৃষ্টি, চর্চা ও বিকাশে এক অনন্য নজীর স্থাপন করেন। এ যুগের মুসলমানরা শুধু দেশ জয় করে ক্ষান্ত থাকেননি বরং তারা বিজিত এলাকায় জ্ঞান চর্চা ও বিকাশের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, গ্রন্থাগার স্থাপন করেছেন, পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গকে জ্ঞান বিতরণের জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সম্মানিত করেছেন। মুসলমানদের উদ্যোগেই বাগদাদ, কায়রো, ফেজ, কর্ডোভাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। এমনকি সেগুলোর বিস্তৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ লাভ করেছিল। তারা শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছিল। জন্ম দিয়েছিল আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের। সার্বিকভাবে বলা যায়, মুসলমানরা মধ্যযুগে জ্ঞান সৃষ্টি ও বিকাশের ক্ষেত্রে একটি সোনালী অধ্যায় রচনা করেছিলেন। ইসলামের নব উদ্দীপনা বলিয়ান হয়ে মুসলমানরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ভাষায় রচিত মনীষী, বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারকদের গ্রন্থাবলি সংগ্রহ করত তা আরবী ভাষায় ভাষান্তর করেন। বিশেষ করে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় রচিত গ্রন্থসমূহ সংগ্রহ করত তা আরবী ভাষায় ভাষান্তরিত করা হয়। সেগুলোই পরবর্তীকালে বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম গবেষক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসকদের আবির্ভাবের পথ তৈরি করে দিয়েছিল। অন্যদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এই প্রবহমান ধারায় মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ পাঠাগার। এর মধ্যে বাগদাদ, কায়রো, বোখারা, সমরকন্দ, নিশাপুর, মসুল, মার্ভ, বসরা, ইস্পাহান, শিরাজনগর, কায়রো, কর্ডোভা, সেভিল, দামেস্কে, মক্কা, মদীনা প্রভৃতি নগরীতে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোর কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
নিম্নে মধ্যযুগের বিখ্যাত বাইতুল হিকমাহ গ্রন্থাগারের বিবরণ প্রদান করা হলো-
ইসলামের ইতিহাসে আব্বাসী যুগকে (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.) জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণযুগ বলা হয়। নিঃসন্দেহে এ যুগ মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ। আব্বাসী শাসকগণ এশিয়া ও ইউরোপের বিশাল অংশ নিয়ে সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। এ সময়ে জ্ঞান চর্চা ও শিক্ষা-দীক্ষা চরম উৎকর্ষ লাভ করে। আব্বাসী খলীফা আল মানসুর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.) ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ নগরীকে নতুন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন। এরপর থেকে প্রভাবশালী আব্বাসী খলীফাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ, অনুবাদকরণ ও গবেষণায় এক অত্যুজ্জ্বল তীর্থভূমির মর্যাদা লাভ করেছিল এ বাগদাদ। আল মানসুরের বিদ্যানুরাগ ও জ্ঞানচর্চার পরিপোষকতায় মুসলিম সমাজে পুস্তকপ্রীতি আশাতীতরূপে বৃদ্ধি পায়। ‘বাইতুল হিকমা’ বা House of Wisdom ছিল সেই সময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রথম বৃহদাকার গ্রন্থাগার। আব্বাসী খলীফা হারুনুর রশিদ (শাসনকাল ৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) ‘বাইতুল হিকমাহ্’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার সুযোগ্যপুত্র খলীফা আল মামুন (৮১৩-৮৩৩ খ্রি.)-এর সময় এটি উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে। নবম শতকের মধ্যভাবে ‘বাইতুল হিকমাহ’ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রন্থভা-ার। এ বিশাল গ্রন্থকেন্দ্র ছিল একাধারে গ্রন্থাগার, অনুবাদকেন্দ্র, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং মানমন্দির। এটিকে ইসলামী স্বর্ণযুগের প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাইতুল হিকমাহ্ সম্পর্কে ইতিহাসবিদ পি.কে হিট্টি বলেন- The first prominent institution for higher learning of Islam was the Bayt at Hikmah (the house of wisdom) founded by al Mamun (830) in his capital. Besides serving as translation bureau this institution functioned as a academy and public library and had a observatory connected with it.
ব্যক্তিগতভাবে খলীফা আল মামুন ছিলেন বহু মানবিক গুণে গুণান্বিত একজন বিদগ্ধ শাসক। জ্ঞানের আদান-প্রদানের জন্য আল মামুন অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিকে বাইতুল হিকমাহতে নিয়ে আসেন। বায়তুল হিকমায় ফার্সী, গ্রিক, মিশরীয়, কালদীয়, ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থ সংগৃহীত হতো। তাঁর উজির ইয়াহিয়া বার্মাকী বিভিন্ন দেশের প-িতদের বাগদাদে আমন্ত্রণ করেছিলেন। আরবদের ‘অগাস্টাস’ খ্যাত এ বায়তুল হিকমাহ্ একাধারে গবেষণাগার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং লাইব্রেরী হিসেবে পূর্ণাঙ্গ জৌলুসপ্রাপ্ত হয়। খলীফা আল মামুন বাগদাদের এ গ্রন্থাগারটিকে বৈশ্বিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্ররূপে গড়ে তুলেছিলেন। তাতে সে যুগেই প্রায় ৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল। বীজ গণিতের জন্মদাতা মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খারেজমি (৭৮০-৮৫০ খ্রি.) সেই বিরাট গ্রন্থাগারের একজন লাইব্রেরীয়ান ছিলেন। তিনি ভারত বিষয়ক একটি বই লিখেছিলেন- যার নাম কিতাবুল হিন্দ। গণিত শাস্ত্রে শূণ্যের মূল্য অপরিসীম। এই শূণ্য [০] আবিষ্কার তার বলে দাবি করা হয়। ‘হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা বইটি তার বিরাট অবদানের একটি উত্তম নিদর্শন। এ সময়কালটিতে বায়তুল হিকমায় বিদেশী গ্রন্থের আরবী অনুবাদের ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়। খলীফা আল মামুন হহুদি, পারসি, খ্রিস্টান, মুসলিম নির্বিশেষে প-িতদেরকে তার অনুবাদে নিযুক্ত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকর্মে স্থপতি ও প্রকৌশলী বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ কাজ করতেন। তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সরকারি দিনপঞ্জির হিসাব রাখতেন এবং সরকারি কর্মী হিসেবেও কাজ করতেন। তারা একইসাথে চিকিৎসক ও পরামর্শদাতাও ছিলেন। খলীফা আল মামুনের কাছে সৌজন্যস্বরূপ আসতো জ্ঞানের অমূল্য সব সংগ্রহ প্রাচীন পা-ুলিপি। তিনি সহল বিল হারুন নামক এক পারসিক ডাক্তারকে নিযুক্ত করলেন মাজুসী সভ্যতার মূল্যবান বই পুস্তকগুলো অনুবাদ করার জন্য। মামুনের উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখে দরবারের সবার ভেতরই অনুরূপ প্রেরণা দেখা দিল। এ যুগে যেসব বই-পুস্তক অনুদিত হয়েছিল তা গ্রিক, ফারসী, কালভী, কিবতী ও শামী ভাষায় লিপিবদ্ধ ছিল। এই লাইব্রেরীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব অনুষদের পুস্তকসমূহ সংগ্রহ করা হয়। এখানে প্রায় ছয় লক্ষেরও বেশী পুস্তক সংগৃহিত হয়।
বায়তুল হিকমাহ্ ‘খিজানাতুল হিকমাহ’ নামেও পরিচিত ছিল। এটি ছিল বাগদাদের সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মানমন্দির। এ গ্রন্থাগারের ভূমিকা প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারকে ছাড়িয়ে যায়। এখানে বিজ্ঞানীরা দিনরাত নিরলস গবেষণা, পর্যবেক্ষণ এবং লেখার কাজে ব্যাপৃত থাকতেন। ভারত, চীন, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ ুতথা বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সব প্রান্ত থেকেই জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটতো এ ‘হাউজ অফ উইজডমে’ জ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্যে। এর গ্রন্থাগারিক ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ মনীষী ও বিজ্ঞানীগণ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন: সহল ইবনে হারুন, হুনাইন ইবনে ইসহাক, মুসা আল-খাওয়ারিজমি প্রমুখ।
খলীফা আল মামুনের উত্তরাধিকারি আল মুতাসিম (শাসনকাল ৮৩৩-৮৪২ খ্রি.) ও তার পুত্র আল ওয়াসিকের সময়কাল পর্যন্ত বাইতুল হিকমাহ্ সগৌরবে জ্ঞানের আলো বিতরণের কাজ চালিয়ে যায়। পরবর্তীকালে খলীফা আল মুতাওয়াক্কিলের আমলে (শাসনকাল ৮৪৭-৮৬১ খ্রি.) এর অবনতি শুরু হয়। ১২৫৮ সালে মোঙ্গল শাসক হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করে শরহটিকে ধ্বংস করেন। লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় লাইব্রেরী, গবেষণা কেন্দ্র। গুঁড়িয়ে দেয়া হয় মসজিদ ও দৃষ্টিনন্দন সব ভবন। এ ধ্বংসলীলায় কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান বায়তুল হিকমাহ্ও।