বাসকিউল্স ভুত

সাঈদ চৌধুরী : ভুতের বিষয়টি সব সময় রোমাঞ্চকর! রোমাঞ্চ একটি বিশেষ্য পদ। শিহরণ, রোমহর্ষ, পুলকোদ্গম, ভয়-বিস্ময়াদিতে শরীরের রোমাবলী খাড়া হওয়া বুঝায়। বিলেতে সাধারণত রহস্যজনক বিষয়-আশয় শনিবারকে ঘিরে আবর্তিত হয়।
এইতো সেদিন সেন্ট্রাল লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজে এক ভুতুড়ে কান্ড সংঘটিত হয়েছিল। ২২ আগষ্ট শনিবার টেমস নদীতে বিকেল ৪টার দিকে একটি জাহাজ অতিক্রম করছিল। হঠাৎ আটকে গেল।
সাধারণত টাওয়ার ব্রিজের নীচ দিয়ে জাহাজ পারাপারের সময় মধ্যবর্তী অংশটি দুই পাশে উঠে যায়। এটি ‘বাসকিউল্স’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সেদিন তা উঠেনি। একটি ‘বাসকিউল্স’এর ওজন ১১শ’ টনের বেশি। জাহাজগুলো ব্রিজ অতিক্রম করার সময় দুটি ‘বাসকিউল্স’কে উপরে টেনে তুলতে ১ হাজার ৪০০ টন ওজনের শক্তি প্রয়োগ করতে হয়।
জাহাজ আটকে যাবার ঘটনায় যানবাহন ও পথচারী পারাপারে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। শত শত মানুষ সেতুর দু’পাশে আটকে পড়ে। অবশেষে বিকল্প পথ হিসেবে চেলসি, ওয়াটারলো, লন্ডন ব্রিজ, ব্লাকওয়াল অথবা রদারহাইথ ট্যানেল ব্যবহার করতে হয়েছে তাদের।
অনেক বিজ্ঞ প্রকৌশলী ঘণ্টার পর ঘন্টা চেষ্টা করেও সমস্যা দূর করতে পারেনি। মজার ব্যাপার হল, তারা কোন যান্ত্রিক সমস্যাই খুঁজে পায়নি। মধ্যরাতে নাকি বাসকিউলস এমনিতেই ঠিক হয়ে গেছে। এ ধরনের যান্ত্রিক সমস্যা এই প্রথম নয়। ২০০৫ সালেও একই কারণে টাওয়ার ব্রিজ ১০ ঘণ্টা বন্ধ ছিল।
রাজধানী লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজটি পর্যটকদের জন্যে আকর্ষণীয় স্থান এবং প্রতিদিন অসংখ্য ভ্রমণপ্রেমী মানুষ আসেন। রহস্যজনক কান্ডটি জানার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জড়ো হন শত শত মানুষ। আমরাও দ্রুত ছুটে গেলাম।
একজন নয়, দুজন নয়; উন্নত বিশ্বের আধুনিক ও উচ্চ শিক্ষিত অসংখ্য মানুষের মুখে মুখে এটি ভুতের কান্ড হিসেবেই নানা রকম ব্যাখ্যা শুনলাম। আমি এর নাম দিলাম বাসকিউল্স ভুত। একজন স্থানীয় অধিবাসী বললেন, দুর্গঘেরা এই জায়গাটি অনেকের কাছেই রহস্যময়। এখানে প্রায়ই ঘটে থাকে রহস্যজনক সব ঘটনা।
জানতে চাইলাম ভুতের কাহিনী। মি. জন নামের একজন বললেন, এই যে, লন্ডনের ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান ‘টাওয়ার অব লন্ডন‘ এটা মূলত ভুতের দুর্গ। এখানে শনিবারে সন্ধ্যায় কেউ ঢুকলেই শুনতে পায় অদ্ভুত সব আওয়াজ। ভয় পেলে পথ হারিয়ে ফেলে। এদের কেউ কেউ হয়ে পড়ে বদ্ধ উন্মাদ।
মি. জন যখন আমার সাথে কথা শুরু করেন, আমি তখন কিছুটা ভীত ছিলাম। মনে হয়েছে তিনি কেবল ড্রিংক করেছেন। বিকট গন্ধ বেরুচ্ছে মুখ থেকে। দেখতে কিছুটা উদ্বাস্তের মত। কিন্ত তার কথাবার্তা ছিল খুব গোছানো, দার্শনিক সুলভ।
পরিচয় জানতে চাইলে হাত নেড়ে তিনি বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইলেন। আগের কথার প্রসঙ্গ টেনে বললেন, লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় যে সব বিপন্ন সাদা মানুষ দেখা যায়, এরা কোন গরীব দেশ থেকে আসেনি। এরা বিলেতেরই মানুষ। তাহলে অসহায়-আশ্রয়হীন উদ্বাস্তের মতো ঘুরছে কেন? নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে কোন অশুভ শক্তির প্রভাব আছে।
মি. জন আমাকে টাওয়ার অফ লন্ডন সম্পর্কে বলতে বলতে ভেতরের দিকে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটি দেয়ালের রেখাচিত্র দেখালেন। নিখুঁত হাতে আঁকা যেন চিত্রশিল্প। এতে বেশ কয়েকটি টাওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত মধ্য লন্ডনের এই ঐতিহাসিক এবং দর্শনীয় স্থানটির বর্ণনা রয়েছে।
অ্যামিরাত এয়ারলাইনের একটা ম্যাগাজিনে শেখর কাপুরের ‘এলিজাবেথ’ সিনেমার রহস্য সম্পর্কে চোখ বুলিয়ে ছিলাম। তখন প্রবল কৌতুহল জন্মেছিল এই দুর্গের প্রতি। যতবার এখানে এসেছি নতুন নতুন রহস্য উন্মোচন হয়েছে।
এই সেই ভয়ংকর জায়গা, রাজতন্ত্রের প্রতি ষড়যন্ত্রের অভিযোগে প্রথম এলিজাবেথকে লোক চক্ষুর আড়ালে নদী পথে এনে এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল।
দুর্গটি মূলত রাজপ্রসাদের অংশ। তবে অতীতে রাজ্যের কোষাগার হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া বহুকাল জেলখানা, জল্লাদখানা, ও অস্রাগার ছিল।
গত অলিম্পিকের পদক সমূহ নাকি এই দুর্গে রাখা হয়েছিল । তখন কয়েকটি জাতীয় কাগজ লিখেছিল, ভূতের নিরাপত্তায় রয়েছে অলিম্পিকের পদক।
মি. জন আমাকে ভুতের দুর্গ হিসেবে ১৩টি কাহিনী শুনালেন। এর প্রথমটি হল, ১৬৭৪ সালের ১৭ জুলাই টাওয়ার অফ লন্ডনের এক অংশে নির্মাণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকেরা একটি কাঠের সিন্দুকে দুটো বাচ্চার কঙ্কাল খুঁজে পায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাজা দ্বিতীয় চার্লসের চিফ সার্জন জন নাইট। তিনি ধারণা করলেন কঙ্কালগুলো শত বছর আগে নিখোঁজ হওয়া দুই রাজপুত্রের হতে পারে। এনিয়ে অনেক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সেটা আগ্রহী পাঠকের জন্য আলাদা ভাবে আলোচনা করা হবে।
জন বললেন, সবাই কঙ্কাল গুলোকে পঞ্চম এডওয়ার্ড আর রিচার্ডের কঙ্কাল বলেই ধরে নিলো। ১৬৭৮ সালে সেই কঙ্কাল দুটোকে রাজকীয় মর্যাদায় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সমাধিস্থ করা হয়। তবে তার ধারণা এডওয়ার্ড আর রিচার্ডের আত্মা এখানে বিদ্যমান রয়েছে।
কাহিনী ঘেটে রহস্য আবিষ্কার আমার চিরকালের অভ্যাস। বিজ্ঞানীরা সাধারণত গবেষণা করেন নিত্য-নতুন জিনিস উদ্ভাবনের জন্য। আমি সেরকম নই। আমার চোখে ভেসে উঠল এক নতুন ও রহস্যময় ইতিহাস। রাজা-রাণীর বীরগাথা কাহিনী। সেই সাথে বহু প্রকার নিগ্রহ-নিপীড়ন আর নানা বিশ্বাস ঘাতকতার অজানা তথ্য।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় রহস্য উদঘাটন আমার চিরকালের অভ্যাস। এরই অংশ হিসেবে প্রতিটি দুর্গের প্রতি আমার এমনিতেই রয়েছে এক ধরণের অমোঘ আকর্ষণ। অবশ্য রহস্যময় ঘটনা সব মানুষকেই আকর্ষণ করে। আর তাই ভূত-প্রেত ভয় পেলেও এসব নিয়ে সবাই ভাবতে চায়। অশরীরী বা রহস্যময় ঘটনাবলি আধুনিক প্রযুক্তিকেও বার বার হার মানায়।
মি. জন আমাকে তার জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক কাহিনী শুনালেন। একবার নাকি তিনি লন্ডনের ল্যাংহাম হোটেলে ভুতের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই হোটেলে ভূতেরও বসবাস আছে জেনে তিনি গিয়েছিলেন। সেখানে বহু নামীদামী লোকজন বাস করেছেন বিভিন্ন সময়ে।
হোটেলের রুম নাম্বার ৩৩৩ এ ভিক্টোরিয়ান ইভনিং পোশাক পরা একটি পুরুষের ছায়া দেখা যায়। তবে এই ছায়া নাকি শুধুমাত্র শনিবারেই দেখা যায়। এই হোটেলের ৪ তলায় মিলিটারি পোশাক পরা একজনকে প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায়। ধারনা করা হয় এটা জার্মান প্রিন্সের আত্মা যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এখানে জানালা থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।
স্কটল্যান্ডে ক্যাসেল স্টুয়ার্ট নামে আরেকটি হোটেলের বর্ণনা দিলেন জন। ১৬২৫ সালে স্থাপিত এই ক্যাসেলটি তৈরী করেছিলেন জেমস স্টুয়ার্ট। ক্যাসেলটি তৈরীর পর থেকে হর হামেশাই ভূতুড়ে কান্ডকীর্তি ঘটতে থাকে। এক সময় সেটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়।
স্থানীয় কেউ কেউ তা মানতে রাজি হননি। স্টুয়ার্ট তাদের ফ্রি থাকা এবং পুরস্কৃত করা হবে বলে ঘোষণা দেন। এলাকার ধর্ম যাজক পেট্টি চার্চ সেখানে রাত্রিযাপন করার প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। পরদিন সকালে ক্যাসেলটিতে তার ভয়ার্ত চেহারার বিকৃত মৃতদেহ পাওয়া যায়।
মজার ব্যাপার হল, ভুতের গল্প শেষ হতে না হতে জন হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করলেন। পেছন থেকে আমি যতদূর তাকালাম জন দৌড়াচ্ছেন। হঠাৎ এভাবে দৌড়ে পালানোর বিষয়টি ভাবতে গিয়ে আমার শরীরটা কেমন যেন শিউরে ওঠে!
লেখক: কবি ও কথা সাহিত্যিক। সম্পাদক- সময় (অনলাইন দৈনিক), ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি, ইউকে এশিয়ান রেষ্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি ও মুসলিম ইনডেক্স (ওয়ার্ল্ডওয়াইড)