গৃহহীন ও ভাগ্যাহতদের নিয়ে দুটি ফারসি কবিতা

প্রাসঙ্গিক ও বাঙলায়ন: হাফিজ ইকবাল
[ইলিয়াস আলাভি ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ২ নভেম্বর আফগানিস্তানের দাইকুন্দি প্রদেশে জন্ম নেয়া খ্যাতিমান একজন ফারসি কবি ও চিত্রশিল্পী। তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে শিশু শরণার্থী হিসেবে ইরানে আসেন। অতঃপর ২০০৭ সালে ঝুঁকিপূর্ণ শরণার্থী হিশেবে অস্ট্রেলিয়াতে চলে যান। তারপর নাগরিকত্ব লাভ করেন। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এ্যাডেলাইদেতে তিনি ভিজুয়াল আর্টস এর উপর(২০১২ খ্রি.) স্নাতক এবং পেইন্টিং এর উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ও আফগানিস্তানে তার বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ পর্যন্ত আলাভির তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। বৃত এই তরুণ কবির কাব্যগ্রন্থ তিনটি হচ্ছে মান গোরগে খিয়াবলাবি হাস্তাম বা আমি একজন দিবাস্বপ্ন দেখা নেকড়ে(২০০৮) যা তেহরান থেকে প্রকাশিত; বা’জি যাখম হা বা কিছু ক্ষত(২০১২) কাবুল এবং হুদুদ বা সীমানা(২০১৫) তেহরান থেকে প্রকাশিত। তার কবিতা বিশ্বের অনেক দেশে সমাদৃত হচ্ছে। আরবি, কুর্দিসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় রূপান্তরিতও হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করে আলাভি তার কবিতা পড়েন, ছবি নিয়ে কথা বলেন। আগ্রাসন ও যুদ্ধের ভয়াবহতা ক্যামন হতে পারে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সেই আগ্রাসন ও ভয়াবহতার শিকার আলাভির মতো কোটি কোটি ভাগ্যাহত মানুষ। নিজের দেশ ছিলো, বাড়ি ছিলো, স্বাধীনতা ছিলো। অথচ আজ তারা মোড়লদের গ্রাসের শিকার। ভাগ্যান্বেষণে ছুটে চলছেন দেশ হতে দেশান্তরে। নিজের দেশ নেই, পিতা-মাতা, আত্মীয় পরিজনদের স্নেহ ভালোবাসাহীন হয়ে বেড়ে উঠতে হয়েছে। বন্দীশিবিরের যাতনা, অন্যদেশের মাঝে খাবারের জন্য চাতকের মতো থাকা, রোদ-বৃষ্টিতে কাবু ইত্যাদি নিজের জীবনে দেখে তা মর্মে ধারণ করে বুনেছেন কবিতা। ফলে সে কবিতা হৃদয়বান প্রত্যেক মানুষকে করেছে স্পর্শ। আবেগ উত্থিত হয়েছে পাঠকের। তিনি যেহেতু আফগানিস্তানে জন্ম নেয়া মানুষ তাই তার কাব্যে দারি ভাষার মিথ ও থিম ব্যবহার পরিলক্ষিত। কাব্যে মুক্তক ছন্দের ব্যবহার ও যুদ্ধের শিকার নিপীড়িত মানুষের কথা তুলে ধরার জন্য এক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর এখনকার ফারসি কাব্যজগতে। কাসিদা ও গজল স্টাইলের চর্চাই বেশি করেন। সামাজিক অসাম্য, নির্বাসন, লিঙ্গ বৈষম্য আর মানব আচরণই তার কাব্যের জমিনের ফুল-ফসল।
তেহরানে অনুষ্ঠিত শাহরিভার রাতের উৎসবে(২০০৪-০৬) তিনি কবিতার জন্য সম্মানিত হন। ২০০৫-০৬ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত আফগানি তরুণ কবিদের প্রতিযোগিতা কান্দে ফারসি বা ফারসির মিষ্টিখ-তে তিনি প্রথম পুরস্কার জিতে নেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের জন্য ইরানের তরুণদের বাৎসরিক সেরা বইয়ের সম্মাননায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরকম বেশ কয়েকটি তরুণ ক্যাটাগরির পুরস্কার এবং সম্মাননা লাভ করেন তিনি। শুধু কাব্যে নয় চিত্রশিল্প ও ভিজুয়াল আর্টেও তিনি সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আলাভি বর্তমানে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গবেষণারত।]
মনে পড়ে
হে আমার কাব্য
তুমিও এক নির্বাসিতা
একদিন তুমি কাবুলের ধোঁয়ায় মিশেছিলে
একদিন প্যারিসের জেলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলে
একদিন নাউরুতে
তোমার পঙক্তিমালা ছিঁড়ে গিয়েছিল
ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়েছিল।
হে আমার কবিতা
তুমিও ক্ষুধার্ত
বাকওয়া সমভূমির মতো যে তার শুষ্ক ঠোঁট তুলে ধরে পর্যটকদের জন্য
শাহনাজ এর মতো যে তার চুলগোছা বেচেছিল
একখ- ঠা-া রুটির জন্য
সেই রাষ্ট্রপতির মতো যে আমাদেরকে বিকিয়ে দিয়েছে
একখ- উষ্ণ রুটির জন্য
হে আমার পদ্য
তুমিও নস্টালজিক
আর শীত আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে।
(মনে পড়ে কবিতাটি ‘দেল তাংগি’ কবিতার বাঙলায়ন)
টীকা:
বাকওয়া অনেক বড় উষ্ণ সমভূমি যেটি কান্দাহার ও কাবুলের মাঝখানে অবস্থিত। যেখানে অনেক পর্যটককে হত্যা করা হয়েছে অথবা তাদেরকে ছাই করে দেয়া হয়েছে বোমা মেরে।
অন্যরকম
সেই রাত্রিতে
সেই রাতে যখন তুমি শুয়ে পড়েছিলে
তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম
আর আমার মাথাকে আমার দু’হাতে রাখলাম।
আমি ভাবলাম: তুমি কী করে ঘুমাবে আমার কক্ষে?
আমরা দীর্ঘ একুশমাস আগে হয়েছি আলাদা।
একখ- শশী বাতায়নে ঝিকমিক করছিল
আর আমি তোমার অবয়বকে
গজলের মতো কোমল দেখছিলাম।
মোজার্ট একটু দূরে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসেছিল
পিয়ানো বাজাচ্ছিল
অন্য অনেকেই ছাদের কাঠের ফাটল দিয়ে দেখছিল।
দেখছিলাম তোমাকে সারারাত ধরে
আর তোমার সমস্ত সৌন্দর্য।
সকাল
সেটি ছিল ফেরত যাওয়ার সকাল।
তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে: ‘তুমি কি ফিরে আসবে?’
আমি তোমার দিকে তাকাতে পারিনি
‘আমি জানি না’ বলেছিলাম
এবং টেক্সিতে বসে পড়েছিলাম
টেক্সি ছেড়ে দিয়েছিল
আমি পিছন ফিরে তাকাতে পারিনি।
আমাদের প্রেম ছিল অন্যরকম
বিষাদময়, অপ্রকাশমান।
(অন্যরকম কবিতাটি ‘দেগার গুনেহ’ কবিতার বাঙলায়ন)