শুক্রবার ৩১ মার্চ ২০২৩
Online Edition

বাংলার মানুষের মনের মণিকোঠায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা                                                                                                        

মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন ভুঁইয়া : ইতিহাস মানুষকে শিক্ষা দান করে, হোক সুশিক্ষা হোক কু-শিক্ষা। আজ- বর্র্তমান, গতকাল- অতীত, আগামীকাল- ভবিষ্যত। কাজেই আজকের ঘটনাবলী গতকাল হলে অতীত। আর অতীত মানেই ইতিহাস। অতীতের ইতিহাসকে যদি মূল্যায়ন না করি, ওখান থেকে যদি শিক্ষা গ্রহণ না করি আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। যে জাতি অতীতকে অস্বীকার করবে এবং অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করবে সে জাতির ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ। 

 ইসলামের ইতিহাসে ইয়াজিদ বা ফেরাউনকে নতুন করে পরিচয় করে দেয়ার কোন কারণ নেই। তাদের অপকর্ম গুলো আজ ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্ম যদি ইয়াজিদ বা ফেরাউনের শেষ পরিণতি ও তাদের জীবন সম্বন্ধে শিক্ষা গ্রহণ করে, তা হলে বোধ হয় বর্তমান প্রজন্ম খারাপ হতে চাইবে না। নমরুদের ঘটনার বেলায়ও তাই। তার পাশাপাশি যদি হযরত ইব্রাহিম আ: থেকে শুরু করে যুগ যুগ ধরে নবী রাসুল পয়গাম্বর থেকে শুরু করে হযরত মোহাম্মদ (স:) এর জীবনী বা ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি তবে বর্তমান প্রজন্ম সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আলোকিত করবে গোটা পৃথিবী। অতপর হযরত আলি (আ:), হযরত ইমাম হাসান (আ:), হযরত ইমাম হোসাইন (আ:) এর জিবনী উল্লেখ করি ওখান থেকেও আমরা ভালো কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি এবং সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধও রক্ষিত আছে। তাই ইতিহাস সংরক্ষণ করা দেশ জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।                                                                                                                                                      

এই রকম অনেক ঘটনা সম্বলিত ইতিহাস আছে যুগ যুগ ধরে। তার পরবর্তীতে যদি আমরা আসি এই ভারত বর্ষে ওখানে শিক্ষা গ্রহণের মতো অনেক ইতিহাস খচিত আছে। তার মধ্যে যদি বাংলার বীর দেশপ্রেমী নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইতিহাসকে সামনে তুলে ধরি তবে দেখতে পাবো যে, নবাব মনসুরুল মুলক মীর্জা মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা বাদশাহ কুলি খান হায়বত জঙ বাহাদুর ছিলেন বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন বীর দেশপ্রেমি নবাব। সিরাজউদ্দৌলা পলাশী যুদ্ধের পর শহিদ হওয়ায় হিন্দু ও ইংরেজরা প্রায় ২০০ বৎসর আমাদেরকে পরাধিন করে রেখেছিলো। যুবরাজ সিরাজউদ্দৌলা নানা নবাব নবাব আলিবর্দী খানের কাছ থেকে সাড়ে ২৮ বৎসর বয়সে বাংলার নবাবে ভূষিত হয়ে নবাবী কার্য পরিচালনা শুরু করেন। অতপর ১৭৫৬ সালে ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে হিন্দুদের কূটকৌশলে পলাশির যুদ্ধে নবাবের পরাজয় ঘটে।

পলাশী একটি বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন বাংলার বীর দেশপ্রেমী নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ঐতিহাসিক তপন মোহন চট্টোপাধ্যায় তার ‘পলাশির যুদ্ধ’ গ্রন্থে এ ব্যাপারে খোলাখুলিই লিখেছেন, “ষড়যন্ত্রটা আসলে হিন্দুদের যড়যন্ত্র। প্রধানত হিন্দুদের চক্রান্ত হলেও বড় মাপের মুসলমান অন্তত একজনও তো চাই!” আসলে মূল ষড়যন্ত্রে ছিল হিন্দুরা এবং এই ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা তাদের সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা করেছে। শুধু নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে তারা  ষড়যন্ত্রে  করেনি, তারা অতীতে বহুবার মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে নানাভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত  ছিল।

২৩ জুন ১৭৫৭, আসলে এই দিনে কোন যুদ্ধের ঘটনা ছিল না। ছিল বিশ্বাসঘাতকতা বা ষড়যন্ত্রের খেলা। সিরাজউদ্দৌলা ও বাংলার স্বাধীনতা সেদিন কুচক্রীদের খেলার শিকারে পরিণত হয়েছিল। গৌরবের কথা এই যে, নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও সিরাজ ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাননি। ইংরেজরা দেশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে ঠিক তবে সেটা রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে হাত মেলাননি দেশপ্রেমী সিরাজউদ্দৌলা। 

সিরাজউদ্দৌলা নিজ নিজ স্বদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি বা নিজের সুবিধার জন্য দেশকে অন্যের হাতে তুলেও দেননি। ২ জনই নিঃসন্দেহে দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক ও সত্যবাদী বীর ছিলেন। তাঁরা প্রতারণা বা শঠতার আশ্রয় নিয়ে বেঁচে থাকারও চেষ্টা করেননি। তাইতো তাঁদের দৃঢ়তা, সাহস ও স্বদেশপ্রেম তাঁদেরকে বিশ্ববীরের মর্যাদা দান করে।                                                                                                                                                   

নবাব আলিবর্দী খানের প্রাণপ্রিয় নাতি যুবরাজ সিরাজউদ্দৌলা ১৯ সেপ্টেম্বর ১৭২৭ ইং সালে তৎকালীন দু বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। সিরাজের সাথে যারা যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের প্রত্যেকে করুণ ভাবে মৃত্যুবরণ করে,তারা হলো- 

১। মীরজাফর- দুরারোগ্য কুষ্ঠ রোগে মীর জাফরের মৃত্যু হয় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে। তার মৃত্যুর আগে নন্দকুমার কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত আনাইয়া তাহার মুখে প্রদান করাইয়াছিলেন। 

২। মীর কাসেম- ইংরেজদের ভয়ে হীনবেশে পালিয়ে যান এবং রাস্তায় রাস্তায় অনাহারে ঘুরে বেড়ান। অবশেষে অজ্ঞাতনামা হয়ে দিল্লীতে তার করুণ মৃত্যু ঘটে। 

৩। মহারাজ নন্দকুমার- মিথ্যা ষড়যন্ত্রে ফাঁসি। 

৪। রবার্ট ক্লাইভ- রবার্ট ক্লাইভের মৃত্যুও মর্মান্তিকভাবে হয়েছিল। তিনি আত্মহত্যা করেন। পলাশী ষড়যন্ত্রের ঘটনা তাকে পরবর্তীতে কোনোদিন মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে দেয়নি। তিনি দেশে ফিরে গিয়ে একদিন বিনাকারণে বাথরুমে ঢুকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিজের গলায় নিজের ক্ষুর চালিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন।

৫। মহাম্মদি বেগ- মাথা গড়বড় অবস্থায় পাগল হয়ে বিনা কারণে কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন।

৬। জগৎ শেঠ মহাতপ চাঁদ- মীর কাসিম জগৎ শেঠ মহাতপ চাঁদকে অত্যুচ্ছ দুর্গশিখর হইতে গঙ্গাগর্ভে  নিক্ষেপ করেন, মহারাজ স্বরূপচাঁদকেও ঐ সঙ্গে ইহজীবনের লীলা শেষ করিতে বাধ্য করেন। 

৭। রায়দুর্লভ-  তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে সেখানেই তার করুণ মৃত্যু ঘটে।

 ৮। রাজবল্লভ-  রাজা রাজবল্লভের মৃত্যুও মর্মান্তিকভাবে ঘটেছিল। জানা যায়, রাজবল্লভের কীর্তি নাশ করেই পদ্মা হয় কীর্তিনাশা।

 ৯। ওয়াটসন- ষড়যন্ত্রকারী ওয়াটসন ক্রমাগত ভগ্নস্বাস্থ্য হলে কোনো ওষুধে ফল না পেয়ে কলকাতাতেই করুণ মৃত্যুর মুখোমুখি হন।

১০। উমিচাঁদ- মানসিক  ভারসাম্য হারিয়ে  ফেলেন এবং স্মৃতিভ্রমে উন্মাদ অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে তার মৃত্যু ঘটে। 

১১। কৃষ্ণচন্দ্র- মুঙ্গের দুর্গে অনাহারে মৃত্যু ঘটে।

১২। কৃষ্ণদাস- তাকে গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়।

১৩। ওয়াটস- যুদ্ধের পর কোম্পানির কাজ থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় বিলাতেই অকস্মাৎ মনোরোগে করুণ মৃত্যুমুখে পতিত হন। 

১৪। স্কাফটন- বাংলার বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে বিলেতে যাওয়ার পথে জাহাজডুবিতে তার অকাল মৃত্যু ঘটে। 

১৫। ইয়ার লতিফ খান - তাকে গোপনে হত্যা করা হয়। 

১৬। দানাশাহ- বিষাক্ত সাপেড় কামড়ে দানা শাহের মৃত্যু ঘটেছিল। 

১৭। মিরন- ব্রিটিশরা মীর কাসিমের সাহায্যে তাহাকে কৌশলপূর্বক নিহত করিয়াছিলো। পরে বজ্রাঘাতে মৃত্যু বলিয়া প্রকাশ করা হয়। মেজর ওয়ালস ছিলেন এই হত্যার নায়ক।

বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তির কিছু অংশ দুনিয়াতেই হয়ে যায়। কারণ হয়তো সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ দিতে চান। সেই সুযোগও গ্রহণ না করলে পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে তা প্রমাণ আরব-বাংলা-পাক-ভারত জুড়ে অসংখ্য। ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে কোন যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধের জয় পরাজয়ও হয়নি। যা হয়েছে তা হলো বিশ্বাসঘাতকতার  প্রতিযোগিতা, চ্যাম্পিয়ান  হয়েছে মীর জাফর। আর দেশপ্রেমের পরীক্ষায় বিজয়ী হয়েছেন বাংলার প্রিয়জন বাংলার গৌরব নবাব সিরাজউদ্দৌলা। যিনি ইচ্ছা করলে ইংরেজদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে বাকী জীবন ভোগ লালসায় কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে দেশের প্রশ্নে, দেশের মানুষের মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে শহীদ হবার পথকে বেঁচে নিয়েছেন, আর মীর জাফররা বিশ্বাসঘাতকতার ঘৃণ্য পথ বেছে নিয়েছে।

পলাশীর ষড়যন্ত্রের যারা নেতৃত্বে দিয়েছিলো পরবর্তীকালে তাদের পরিণতি হয়েছিল অত্যন্ত ভয়াবহ ও মর্মান্তিক। অস্বাভাবিক পন্থায় এবং অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে আলিঙ্গন করতে হয়েছে তাদের মৃত্যুকে। তাদের সকলের উপরেই পড়েছিল আল্লাহর লানত। আল্লাহর কঠিন শাস্তি থেকে তাদেরকে কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পরেও বিশ্ববাসী যুগ যুগ তথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের এই অপকর্মের প্রতি তীব্র নিন্দাবাদ প্রদান করে আসছে।   

লেখক: ইতিহাস-আইন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ