শুক্রবার ৩১ মার্চ ২০২৩
Online Edition

বাংলা মুদ্রণশিল্পের পশ্চাৎপট ও ওয়ারেন হেস্টিংস

সোলায়মান আহসান : আজকাল রঙিন ঝকঝকে ছাপা পত্রিকা যখন হাতে আসে আমরা বুঝতেই পারি না এ সুন্দর ছাপা পত্রিকার পশ্চাৎপট কম প্রাচীন নয়।

আশির দশকে ঢাকায় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় সাংবাদিকতায় যখন কেবল যুক্ত হয়েছি, একদিন ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার একটি সংখ্যা হাতে পড়ল। ওমা! একি অবাক কা-! সম্পূর্ণ রঙিন এক পত্রিকা। ঝকঝকে ছাপা। সাদা কাগজ। মুগ্ধ হয়েছিলাম।

তখন আমাদের দেশে সাদা কালোর যুগ চলছে। ফুজি, কোডাক এদের বেেদৗলতে ছবি রঙিনের জগতে প্রবেশ করলেও পত্রিকা এবং গ্রন্থের জগতে রঙ তখনও অনুপস্থিত। বইয়ের কভার বাই কালারে ছাপা হতে শুরু করেছে। শিশুদের জন্য কিছু বইপত্রে সাহসী প্রাকাশকরা রঙ ছড়াতে উদ্যোগী হয়েছেন সামান্য। তার মানে রঙের জগতে আমরা প্রবেশাধিকার পাইনি।

তখন ছোট ছোট খোপে (কাঠের) সাজানো সীসার লেটার কম্পোজ করা, স্টীলের ফ্রেমে মেইক আপ দেয়া, ছাপার মেশিনে ছাপ তুলে প্রুফ দেখা ইত্যাদি দৃশ্য ছিল স্বাভাবিক। এসব কম্পোজ করার ঘর সাধারণত খুব প্রশস্ত এবং আরামদায়ক ছিল না। চাপাচাপি করে ফন্ট কেইস বসানো হতো। ছোট্ট টুলে বসে স্বল্প আলোতে মাথার ওপর ফ্যান না ঘোরা গরমে সিদ্ধ হওয়া পরিবেশে কম শিক্ষিত ‘ছাপাশিল্পী’ কম্পোজিটররা কাজ করতেন। আরো আগে পা দিয়ে চালানো মেশিনে ছাপার ইতিহাসটা আমাদের বেড়ে উঠা জীবনেই। সত্তর দশকের কথা।

আশির দশকে শুরুর দিকে ঢাকায় পত্রিকায় যখন যুক্ত হলাম তখন মদ্রণ জগতে বিপ্লব ঘটে গেছে। অফসেট সিস্টেম তখন হুরমুর প্রবেশ করতে শুরু করেছে। বিশ^বিদ্যালয় জীবনেও অফসেট সিস্টেমে ছাপার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। আশির দশকের সূচনালগ্œে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রবস্থায়।

ঢাকায় এসে দেখতে পেলাম পত্রিকা ছাপার এক অভিনব পদ্ধতি। সীসার লেটারে কম্পোজ এবং মেইক আপ করে সেলোপিন পেপারে (এক ধরনের স্বচ্ছ কাগজ) ছাপ নিয়ে তা থেকে তীব্র লাইটের প্রতিফলন ঘটিয়ে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত অফসেট প্লেটে ছাপ ফেলে তা দিয়ে ছাপার মেশিনে ছাপানো হতো। এত ছাপা হতো ঝকঝকে। ছবিও পরিষ্কার আসতো। এক্ষেত্রে দু’ধরনের ছাপার মেশিন চালু ছিল। রোলান্ড এবং গজ। রোলান্ড মেশিনে কাগজ কেটে দিতে হতো। যা এক পিঠ ছাপা হতো। বড় আকৃতির গজ মেশিনে কাগজের রোল দিয়ে এক সঙ্গে আট কিংবা ততোধিক পৃষ্ঠা ছেপে কাটিং হয়ে বের হতো। এধরনের মেশিন ঢাকায় তখন সীমিত ছিল। সাধারণত বড় পত্রিকাগুলো এমন মেশিনে পত্রিকা ছাপতে পারতো

এর মধ্যে ছাপার জগতে আরো কিছু পদ্ধতি এসে গেল। মনো কাস্টিং সিস্টেম। ফটোসেটার। মনো কাস্টিং সিস্টেমে সীসার ফন্ট তৈরি হয়ে বের হতো। একবারের জন্য তা ব্যবহৃত হতো। ফটো সেটার ছিল সীসার পরিবর্তে ফ্লিমে প্রিন্ট হয়ে বের হতো কম্পোজ করা মেটার। মেইক আপ করতে হতো ফ্লিম কোট কেটে। তারপর অপসেট প্লেটের মাধ্যমে মেশিনে তোলা হতো।

কিন্তু এসব কিছুকে বিদায় করে দেয় নব্বইয়ের দশকে হঠাৎ কম্পিউটার এসে। নানা পালাবদলের মধ্য দিয়ে এখনও চালু আছে কম্পিউটার। ছাপার নানা প্রকরণ, পদ্ধতির প্রবেশ ঘটেছে সেই সাথে। 

এই যে মুদ্রণ শিল্পের ক্রমধারার কথা বললাম তার ইতিহাসটা কিন্তু সাড়ে তিনশ বছরের বেশি।

আসুন, সেই পুরনো দিনের ইতহাসে ফিরে যাই। ১৭৭৮ খ্রীস্টাব্দে হলহেডের বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশ পায়। বইটি ইংরেজিতে লেখা হলেও এর বাংলা দৃষ্টান্তগুলো উইলকিনস নির্মিত বাংলা হরফে মুদ্রিত হয়েছিল। এই থেকেই বাংলা মুদ্রণ শিল্পের সূচনা। কিন্তু এই সূচনা কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, এর পশ্চাতে রয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট কার্যকারণ পরম্পরা যার মূল সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে নিহিত।

১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করার পর ইংরেজরা কার্যত বাংলার প্রভু হয়ে বসল। তাদের প্রভুত্ব নবাব ও জমিদারদের সহায়তায় চলত। জনসাধারণের সঙ্গে ইংরেজদের কোন প্রশাসনিক যোগ ছিল না। প্রজার উপর ছড়ি ঘোরাত নবাব ও জমিদারদের কর্মচারীরা।

১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে কোম্পানির স¤্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি পেল। কিন্তু তার পরেও সরাসরি শাসনভার হাতে তুলে নিতে কোম্পানী আগ্রহ বোধ করল না। রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব নবাব এবং জমিদারদের হাতেই রয়ে গেল। কোম্পানি কর্মচারীদের মূল লক্ষ্য ছিল যে কোন প্রকারে ব্যক্তিগত আয় বৃদ্ধি করা।

সুতরাং ১৭৬৫-র আগে ও পরে প্রকৃত প্রস্তাবে চলছিল দ্বৈত শাসন। আসল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল কোম্পানির হাতে অথচ দেশ শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে রাজস্ব আদায়ের ভার ছিল নবাব ও জমিদারদের ওপর। রাজস্ব আদায়ের নাম করে জমিদার ও নবাবের কর্মচারীরা জনসাধারণের উপর নানাভাবে অত্যাচার নিপীড়ন চালাত। এই দ্বৈত শাসনের পর্বটি বাংলার ইতিহাসে এক ভয়াবহ অধ্যায়। মূলত হিন্দু জমিদারদের সংখ্যাই ছিল বেশি। যারা কোম্পানিকে নানাভাবে সন্তুষ্ট করে অর্থ উপঢৌকন দিয়ে জমিদারী এস্টেট ইজারা গ্রহণ করত। নবাবের ধার না ধেরে তারা প্রজাদের ওপর নানা হুকুম জারী করত। নবাব ছিল এসব হিন্দু জমিদারদের ক্রীড়নক বা পুতুলসম। এসব হিন্দু জমিদারদের মাত্রাতিরিক্ত শোষণের ফলে ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দে বাংলায় মারাত্মক দুর্ভিক্ষ ঘটে। যেটা কুখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হিসাবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। 

দ্বৈত শাসনের কুফল ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায়। ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত পর্বটিতে শুধু যে প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল তাই নয় জনগণের ব্যাপারে শাসক সম্প্রদায়ের যে দার্য়িত্ব থাকে, তা এই পর্বে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। এই সময় দেশে সত্যিকার অর্থে কোন সরকার ছিল না। কোম্পানি শাসন বলতে যা বোঝাত তা মানুষকে নির্যাতন করে রাজস্ব আদায়। এতে মানুষ মনে মনে কোম্পানীর ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের খবর পৌঁছাল ইংল্যান্ডে শাসকদের কাছে। কোম্পানির দুঃশাসনের খবরও জানতে পারলেন স্বয়ং রাণীও।

কোম্পানির এই দুঃশাসনের কবল হতে বের করে একটি আইনী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংসকে গভর্ণর করে বাংলাদেশে পাঠান হলো। হেস্টিংস এসে সর্বপ্রথম দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটিয়ে কোম্পানির প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। রাজস্ব আদায়ের ভার নবাব-জমিদারদের হাত হতে নিয়ে নেয়া হল। প্রতি জেলায় রাজস্ব সংগ্রহের জন্য নিযুক্ত হলো একজন করে কালেকটর।  রাজস্ব বিভাগের সর্বময় কর্তৃত্ব ন্যস্ত হল রেভিনিউ বোর্ডের ওপর। বিচার ব্যবস্থাকে সৃদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য জেলায় জেলায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপিত হল। প্রশাসনিক আরও কিছু সংস্কারের ফলে জনসাধারণের মনে একটা আস্থা ও নিরাপত্তার ভাব সৃষ্টি হল। ফলে শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ ধীরে ধীরে গড়ে উঠল। হেস্টিংসের ব্যক্তিগত আগ্রহ ব্যতীত এত অল্প সময়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারত কিনা সন্দেহ। ব্রিটিশ শাসকের রেগুলেটিং অ্যাক্ট অনুসারে ১৭৭৩ সালে ভারতের গভর্ণর জেনারেল হিসেবে নিযুক্তি পান হেস্টিংস।

ব্যক্তিগত জীবনে হেস্টিংস সংস্কৃত সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। চৌদ্দ বছর ভারতে থাকবার সুযোগে তিনি এ দেশে শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে আগ্রহান্বিত হয়েছিলেন, সংগ্রহ করেছিলেন কিছু পুরনো পুঁথি। হেস্টিংস ভারতের ধর্ম  ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার ব্যাপারে ছিলেন আগ্রহী। তিনি গীতাকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন। তিনি বন্ধু চার্লস উইকিনসকে দিয়ে গীতা অনুবাদ করান এবং মুদ্রিত করেন।

ক্লাইভের সময় এবং তার পরেও বিভিন্ন দেশের বিদেশী বণিকরা নিজেদের মধ্যে ভাবের লেনদেন করত পর্তুগীজ ভাষায় এক বিকৃত রূপের সাহায্যে। হেস্টিংস উপলব্ধি করলেন বাণিজ্য এবং শাসনের জন্য দেশের লোকের সাথে যোগাযোগ অত্যাবশ্যক এবং সে যোগাযোগ একমাত্র স্থানীয় ভাষার সাহায্যেই হতে পারে। তিনি নিজে বাংলা ও ফারসি খুব ভালো জানতেন। উর্দু এবং আরবীতেও দখল ছিল। ফার্সি  তখন প্রশাসন ও আদালতের ভাষা। সুতরাং ইংরেজ কর্মচারীরা শিখে আসতে পারে তার জন্য হেস্টিংস ১৭৭৩ খ্রীস্টাব্দে প্রস্তাব দিয়েছিলেন অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ে ফারসি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করতে।

বাংলা ভাষা চর্চায় হেস্টিংসের বিশেষ আগ্রহের কতকগুলি কারণ ছিল। পার্লামেন্ট রেগুলেটিং অ্যাক্ট (১৭৭৩) পাশ করার পরিণতি হিসাবে কলকাতা হল ভারতে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের রাজধানী যে জনপদ ছিল কয়েকটি ছড়ানো ছিটানো কুঁড়ে ঘরের সমাহার তা পৃথিবীর পরশাসিত বৃহত্তম সা¤্রাজ্যের রাজধানী হবার পথে যাত্রা শুরু করল। রাজধানী গড়ে তোলবার কর্মযজ্ঞে নানা শ্রেণির কর্মীর আগমন আরম্ভ হল। তাদের অধিকাংশ বাঙালি। 

শুধু ইট কাঠের কাজ নয়, সাংস্কৃতিক আলোচনাও প্রেরণা পেল হেস্টিংসের কাছ থেকে। উইলকিনস, জোনস, হলহেড প্রমুখ প্রাচ্যবিদ্যা চর্চায় আগ্রহী ব্রিটিশ কর্মীদের কাজে সহায়তা করবার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এলেন প-িত ও বিশেষজ্ঞরা।

কলকাতা যত বাড়তে লাগল ততই বাঙালিরা আসতে লাগল। কেউ চায় চাকরি, কেউ করবে ব্যবসা। আর কলকাতার চারদিকেও বাঙালি। বাংলাদেশের কোম্পানির রাজধানী। ব্যবসার দিক থেকেও বাংলার প্রাধান্য। সুতরাং হেস্টিংস স্থির করলেন ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের বাংলা শেখাবার ব্যবস্থা করতে হবে। বন্ধু ন্যাথনিয়াল ব্রাসি হলহেড ইংরেজিতে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ লিখে দিলেন। বাংলা অক্ষরে ব্যাকরণ ব্যবহৃত দৃষ্টান্তগুলি ছাপাবার জন্য আর এক বন্ধু চার্লস উইলকিনস বাংলা হরফ তৈরি করে দিলেন। বাংলা মুদ্রণের সূচনার ইতিহাস হয়তো সবার জানা। কিন্তু অনেকেই হয়ত জানেন না হেস্টিংসের প্রেরণা ও তাগিদ না থাকলে বাংলা মুদ্রণ আরও অনেক বিলম্বিত হত। হলহেড তাঁর ব্যাকরণের ভূমিকায় স্পষ্ট বলেছেন, হেস্টিংসের দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে তাঁরা এ কাজে নেমেছেন।

ইতিহাসের পাতায় মুদ্রণ শিল্পের প্রবর্তক হিসাবে হলহেড ও উইলকিনসের নাম আমরা খুঁজে পাই, শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি কিন্তু এদের পেছনে যিনি বরপুত্র ছিলেন সেই ইংরেজ শাসক হেস্টিংসের কথাও আমাদের মনে করা উচিত।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ