শুক্রবার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

বেগম রোকেয়ার সাহিত্য ও নারীমুক্তি আন্দোলন

নাজিব ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। তাঁর এই পরিচয় বিধৃত হয়েছে তাঁর নারীমু্িক্ত ও শিক্ষানুরাগী কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে যেমন, তেমনি সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়েও। তিনি একাধারে নারীশিক্ষা আন্দোলনের অগ্রণী নেত্রী, এবং নারীবাদী সাহিত্যের স্রষ্টাও। এদেশে এক্ষেত্রে তিনি পথিকৃৎ। এমনকি ইউরোপ-আমেরিকায় বুদ্ধিবৃত্তিক, দার্শনিক এবং সামাজিক আন্দোলন হিসেবে ‘নারীবাদ’ (Feminism) আবির্ভূত হওয়ার অনেক আগেই বেগম রোকেয়া এ নিয়ে লেখালেখি এবং অনুশীলন করেছেন। একটি পরাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার কারণে তাঁর এই অবদান তৎকালীন বহির্বিশ্বে প্রচার লাভ করেনি। 

বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালে, রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের সম্ভ্রান্ত ও ধনী রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে। তখনকার অধিকাংশ মুসলিম পরিবারে মেয়েদের কিছু ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার চল থাকলেও কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো দূরের কথা বাড়িতে বসেও বাংলা-ইংরেজি পড়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু পিতার স্নেহময় অনুমোদন ও বড় ভায়ের বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতায় রোকেয়া বাড়িতে বাংলা শেখার সুযোগ লাভ করেন। ১৮৯৬ সালে তাঁর বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুরের অবাঙ্গালি আমলা বিপত্নীক সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। স্বামীর উৎসাহে তাঁর লেখাপড়া অব্যাহত থাকে, তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। ১৯০৯ সালের ৩রা মে তাঁর স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। বড় বোন করিমুন্নেসা চুরি করে সাহিত্যচর্চা করতেন। হয়তো তাঁরই প্রভাবে কিছুটা, এবং কিছুটা স্বশিক্ষা তাঁকে লেখালেখির প্রতি আগ্রহী করে তোলে। তিনি লিখতেন মিসেস আরএস হোসেন নামে। ১৯০২ সালে তাঁর প্রথম রচনা ‘পিপাসা (মহরম)’ প্রকাশিত হয় হরেন্দ্রলাল রায় ও জ্ঞানেন্দ্রলাল রায় সম্পাদিত ‘নবপ্রভা’ পত্রিকার চৈত্র ও বৈশাখ ১৩০৮-১৩০৯ সংখ্যায়। ১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ মতিচুর (প্রথম খণ্ড)। সাতটি চিন্তাশীল প্রবন্ধ নিয়ে এই বইটি রচিত। দক্ষিণারঞ্জণ মিত্র দীর্ঘ গ্রন্থালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন- ‘...‘মতিচুর’ পড়িতে পড়িতে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্ত’, ‘লোকরহস্য’ এবং কালীপ্রসন্নের ‘ভ্রান্তিবিনোদ’ মনে পড়ে। অতুল কাব্যালঙ্কারে, বিপুল রহস্য বিজড়িত রসপূর্ণ যে সুগভীর সমস্যা-প্রশ্নসমুচ্চয়ে কমলাকান্তাদির উৎপত্তি হইয়াছিল, ‘মতিচুর’ও সেইরূপ অগণ্য সমস্যা-ভাব আনিয়া উপস্থিত করিয়াছে। পার্থক্য কেবল, তাহাদের মূল প্রধানতঃ দর্শনে; ইহার ভিত্তি সমাজ সমস্যার উপরে। ...‘মতিচুর’ শুধু হিন্দু-মোসলেম সমাজকে নহে, সর্ব্বশ্রেণীর পাঠককে- ভাবতরঙ্গে আলোড়িত করিয়াছে। মুসলমান মহিলা লিখিত সর্ব্বপ্রথম বাঙ্গালা গ্রন্থের এ ক্ষমতা কতদূর বিস্ময়কর, তাহা ভাষায় বুঝানো সুকঠিন। [রোকেয়া রচনাবলী, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০৬, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৫৬২]

বেগম রোকেয়ার প্রথম ইংরেজি, ব্যঙ্গরসাত্মক রূপক রচনা Sultana’s Dream প্রকাশিত হয় মাদ্রাজ থেকে কমলা সাতথিয়া নাথান ও সরোজিনী নাইডু সম্পাদিত Indian Ladies Magazine পত্রিকায়, ১৯০৫ সালে। এটি গ্রন্থরূপ লাভ করে ১৯০৮ সালে। ইংরেজি পত্রিকা The Mussalman-এ এর একটি সমালোচনা বেরিয়েছিল ওই বছর ডিসেম্বরে। তাতে বলা হয়েছিল-We have found a genuine pleasure in the perusal of the booklet. It seems to us that Mrs. R. S. Hossain the able authoress is a lady of whom any nation may be proud..’ [পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৮৭]। শিখা গোষ্ঠীর আবুল হুসেনও এই পুস্তিকার একটি নাতিদীর্ঘ সমালোচনা লিখেছিলেন। সেটি ছাপা হয়েছিল ‘সাধনা’ পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩২৮ সংখ্যায়। 

মতিচুর (দ্বিতীয় খণ্ড) প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। এতে রয়েছে প্রবন্ধ, রূপকথা ও গল্পসহ বিভিন্ন ধরনের রচনা। Sultana’s Dream-এর নিজের করা অনুবাদ সুলতানার স্বপ্ন এই গ্রন্থে সংকলিত হয়। পদ্মরাগ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। নকশা জাতীয় রচনার সংকলন অবরোধ-বাসিনী ১৯৩১ সালে বের হয়। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর অনেক ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, ব্যাঙ্গরচনা প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও অনেক লিখিত অভিভাষণ ছিল। তাঁর সমগ্র রচনা, অভিভাষণ ও চিঠিপত্র নিয়ে ১৯৭৩ সালে রোকেয়া রচনাবলী প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী। ১৯৮৪, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালে তিনটি পুনর্মুদ্রণের পর এর পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। বাংলাদেশে নারীমুক্তি আন্দোলনের বিস্তার ও শক্তি অর্জন এবং নারীবাদী সাহিত্য রচনার প্রবণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বেগম রোকেয়ার রচনাবলী ও কর্মকীর্তি ক্রমশঃ অধিকতর প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

বেগম রোকেয়ার জীবৎকাল ১৮৮০ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত, আর ইউরোপ-আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম তরঙ্গ ১৮৩০ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। নারীবাদী আন্দোলনের ‘ধর্মগ্রন্থ’ হিসেবে গণ্য সিমোন দ্য বোভেয়ারের দি সেকেন্ড সেক্স প্রকাশিত হওয়ার (ফরাশি ভাষায় ১৯৪৯ সালে, ইংরেজি অনুবাদে ১৯৫৩ সালে) ৩৩ বছর আগে, এবং ১৯৬০ সালে এই আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গ শুরুর ২৮ বছর আগে রোকেয়ার মৃত্যু হয়। প্রথম তরঙ্গের মূল বিষয় ছিল বিয়ে, শিশুপালন, পারিবারিক সম্পত্তি, শিক্ষা এবং ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার অর্জন। শেষ দিকে এসে কেউ কেউ যৌনতা, সন্তান জন্মদান এবং অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্নও তোলেন। বেগম রোকেয়ার নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি বিষয়ক প্রথম লেখা ‘অলঙ্কার না Badge of Slavery?’ প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে গিরিশচন্দ্র সেন সম্পাদিত মাসিক ‘মহিলা’ পত্রিকায়। পরের বছর সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত ‘নবনূর’ পত্রিকায় এটি ‘আমাদের অবনতি’ নামে পুনর্মুদ্রিত হয়। ১৯০৪ সালে মতিচুর (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থে এটি ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ নামে সংকলিত হয়। মতিচুর (প্রথম খণ্ড)র অন্যান্য প্রবন্ধগুলিও ১৯০৪-এর আগেই লেখা। Sultana’s Dream ছাপা হয় ১৯০৫ সালে। অর্থাৎ বাস্তবে এটি লেখা হয় আরো আগে। এর থেকে বোঝা যায়, বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তিচিন্তা তাঁর একান্ত নিজস্ব, ইউরোপ-আমেরিকার আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত নয়, নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও মানসপ্রবণতা থেকেই উদ্ভূত। 

বেগম রোকেয়ার আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল নারীর সার্বিক মুক্তি এবং পুরুষের সমান অধিকার অর্জন। তবে তিনি কাজ করেছেন মূলতঃ নারীশিক্ষার প্রসার এবং অবরোধপ্রথা বিলোপের জন্য। নারী শিক্ষিত হয়ে সমাজের বিভিন্ন স্থানে ও পর্যায়ে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করবে, অবদান রাখবে, এই ছিল তাঁর আকাক্সক্ষা। এই বিষয়গুলো ইউরোপ-আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম তরঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। এবং কাল বিবেচনায়ও বেগম রোকেয়ার সমকালীন, যদিও কোনও যোগাযোগ ছিল না। এই বিবেচনায় বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনকে প্রথম তরঙ্গের ভারতীয় বা বাঙ্গালী সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা চলে। তার সঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে, ইউরোপ-আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম তরঙ্গ ছিল মূলতঃ দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু বেগম রোকেয়া বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পাশাপাশি তার বাস্তব অনুশীলনও করেন তাঁর সাংগঠনিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় তাঁর আন্দোলনকে দ্বিতীয় পর্যায়ে ফেলা যায়। সতীদাহ প্রথা বাতিল এবং বিধবা বিবাহ চালুর আন্দোলন হচ্ছে প্রথম পর্যায়। আর বেগম রোকেয়ার স্ব-সম্প্রদায়, যাদের নিয়েই তিনি প্রধানতঃ কাজ করেছেন, সেই মুসলিম সমাজের প্রেক্ষিতে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।  

বেগম রোকেয়ার উত্থান যে-কালে, সে-কালে ভারতবর্ষের সমাজ, বিশেষত মুসলিম সমাজ, কেবল যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চাদপদ ছিল তা-ই নয়, চরম রক্ষণশীলও ছিল। ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি ছিল সাধারণ ব্যাপার। আশ্চর্যের বিষয়, এইসব বাড়াবাড়ি অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মলঙ্ঘন করেই করা হতো, অথচ তাকে যুক্তিসিদ্ধ করা হতো ধর্মেরই দোহাই দিয়ে। নারীশিক্ষা এবং অবরোধপ্রথার ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতিই তখন বিরাজমান ছিল।  

বেগম রোকেয়া শিক্ষাকেই নারীমুক্তির প্রথম ও প্রধান অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। প্রথমে তুলে নিয়েছেন লেখনি, তারপর প্রতিষ্ঠা করেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। তিনি বলেছেনÑ- ‘শিক্ষা বিস্তারই এইসব অত্যাচার নিবারণের একমাত্র মহৌষধ। ...শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি; ...আমি চাই সেই শিক্ষাÑ যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে, ...শিক্ষা- মানসিক এবং শারীরিক উভয়বিধ হওয়া চাই। [সুবেহ্ সাদেক, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৪১] নিছক সুগৃহিণী হতে গেলেও যে শিক্ষার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য তা তিনি সংসারের নৈমিত্তিক কাজের ফিরিস্তি দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ‘সুগৃহিণী’ (মতিচুর (প্রথম খণ্ড) প্রবন্ধে। 

তিনি নারীশিক্ষার পক্ষে জনমত তৈরি করার জন্য লেখালেখির পাশাপাশি জনসংযোগও করতেন। শেষ পর্যন্ত ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর বিহারের ভাগলপুরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পত্তন করেন। এ স্কুলের নামকরণ করেন সদ্যমৃত স্বামীর নামে, ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। ১৯১১ সালের ১৬ই মার্চ স্কুলটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। আর্থিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা মোকবেলা করে তিনি আজীবন এই স্কুল পরিচালনা করে গেছেন। এই স্কুল নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনকে গতিশীল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

তাঁর এই আন্দোলন পুরুষ ও নারী উভয় সমাজেরই বিরুদ্ধাচরণের শিকার হয়েছিল। অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, তিনি নারীদের ঘরের বাহির এবং ধর্মদ্রোহী করে তুলতে চাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- ‘আমি ভগিনীদের কল্যাণ কামনা করি, তাঁহাদের ধর্ম্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাঁহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না। ...আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায়। আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই’ [অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩১]।

তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় ও যুক্তিসিদ্ধ করতে তিনি তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে নারীশিক্ষা বিষয়ে যে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছিল সেসব উদাহরণ এবং ধর্মীয় বিধানের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন- ‘সম্প্রতি তুরস্ক এবং মিসর, ইউরোপ ও আমেরিকার ন্যায় পুত্র ও কন্যাকে সমভাবে শিক্ষা দিবার জন্য বাধ্যতামূলক আইন করিয়াছেন। কিন্তু তুরস্ক আমেরিকার অনুসরণে সোজা পথ অবলম্বন করেন নাই; বরং আমাদের ধর্ম্মশাস্ত্রের একটি অলঙ্ঘনীয় আদেশ পালন করিয়াছেন। যেহেতু পৃথিবীতে সর্ব্বপ্রথমে পুরুষ স্ত্রীলোককে সমভাবে সুশিক্ষা দান করা কর্ত্তব্য বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন, তিনি আমাদের রসুল মকবুল (অর্থাৎ পয়গাম্বর সাহেব)। তিনি আদেশ করিয়াছেন যে, শিক্ষালাভ করা সমস্ত নরনারীর অবশ্য কর্ত্তব্য। তের শত বৎসর পূর্ব্বেই আমাদের জন্য এই শিক্ষাদানের বাধ্যতামূলক আইন পাশ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আমাদের সমাজ তাহা পালন করে নাই, পরন্তু ঐ আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছে এবং তদ্রুপ বিরুদ্ধাচরণকেই বংশ-গৌরব মনে করিতেছে।’ [বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতির সম্মেলনে প্রদত্ত সভানেত্রীর অভিভাষণ, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২৭]

অবরোধ-প্রথার বিরুদ্ধে তিনি সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। তিনি তাঁর অধিকাংশ লেখার মধ্যে কোনও না কোনওভাবে এই প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তাঁর অবরোধ-বাসিনী গ্রন্থের পুরোটাই অবরোধ-প্রথার কুফল নিয়ে রচিত। কিন্তু তিনি উগ্রপন্থা অবলম্বন করেননি। তিনি নিজে পর্দা করতেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- ‘...অবরোধের সহিত উন্নতির বেশী বিরোধ নাই। উন্নতির জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই। ...সকল সভ্যজাতিদেরই কোন না কোন রূপ অবরোধ প্রথা আছে। এই অবরোধ-প্রথা না থাকিলে মানুষ ও পশুতে প্রভেদ কি থাকে? ...তবে সকল নিয়মেরই একটা সীমা আছে। এদেশে অবরোধ-প্রথা বেশী কঠোর হইয়া পড়িয়াছে। ...আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠন (ওরফে বোরকা) সহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয় না। তবে সে জন্য সামান্য রকমের একটু অভ্যাস (practice) চাই; বিনা অভ্যাসে কোন কাজ হয়?’ [বোরকা, মতিচুর (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৩]।

তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণ এবং রচনাবলী থেকে প্রতীয়মান হয় যে বেগম রোকেয়া পর্দার বিরোধী ছিলেন না, পর্দার নামে নারীদের গৃহবন্দী করে রাখার বিরুদ্ধে তাঁর যত আপত্তি। - ‘...আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হই নাই। কেহ যদি আমার ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে পর্দাবিদ্বেষ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য দেখিতে না পান, তবে আমাকে মনে করিতে হইবে আমি নিজের মনোভাব উত্তমরূপে ব্যক্ত করিতে পারি নাই, অথবা তিনি প্রবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন নাই। সে প্রবন্ধে প্রায় সমগ্র নারীজাতির উল্লেখ আছে। সকল সমাজের মহিলাগণই কি অবরোধে বন্দিনী থাকেন? অথবা তাঁহারা পর্দানশীন নহেন বলিয়া কি আমি তাঁহাদিগকে সম্পূর্ণ উন্নত বলিয়াছি? আমি মানসিক দাসত্বের (enslaved মনের) আলোচনা করিয়াছি।’ [অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৫]। অন্য একটি প্রবন্ধে একটি চরিত্রের বাচনে তিনি বলেন- ‘আমার মনে হয়, হিন্দুরা আমাদের নিকট অবরোধপ্রথা শিক্ষা করিয়াছেন, এবং কাট-মোল্লারা হিন্দুর নিকট নারীর প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করিতে শিখিয়াছেন। নতুবা কোরাণ শরীফের বিধান মানিলে অবলা-পীড়নও চলে না; অন্যায় অন্তঃপুরপ্রথাও চলে না’ [নারীপূজা, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০৩]।

ইউরোপ এবং আমেরিকায় যে নারীবাদী আন্দোলন গতিমান হয়েছিল, বিশেষতঃ প্রথম তরঙ্গের শেষে এবং দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রথমদিকে, তা ছিল মূলতঃ বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক চর্চা। বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির চিন্তা ছিল বাস্তবতা-নির্ভর। তবে তাত্ত্বিক ভাবনাও তার মধ্যে পরোক্ষভাবে নিহিত ছিল। এসবদিক থেকে আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর মিল রয়েছে। সেখানে যেমন ১৯৬৬ সালে ‘ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ উইমেন’ গঠনের মধ্য দিয়ে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়, এখানে তেমনই বেগম রোকেয়া ১৯০৯ সালে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ এবং ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি’ গঠন করেন তাঁর আন্দোলনের প্রসার ও বাস্তব রূপদান কামনায়। 

বেগম রোকেয়ার নারীচিন্তার গতি-প্রকৃতি ও তাঁর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি, তিনি নারী ও পুরুষের মধ্যকার জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্যকে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করেছিলেন। এদিক থেকে তাঁকে তাঁর মৃত্যুর অন্ততঃ তিরিশ বছর পরে উদ্ভূত ‘এসেনশিয়ালিস্ট নারীবাদ’ আন্দোলনের সমগোত্রীয় ভাবা চলে। এসেনশিয়ালিস্টদের মতোই তিনি মনে করতেন, নারী হওয়া কোনও অগৌরবের বিষয় নয়। পুরুষ-কেন্দ্রিক মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠা সামাজিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতি ও কাঠামো থেকে মুক্ত হয়ে নারীকে অনন্য নারী পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। যেসব যুক্তি ও বিষয়কে অবলম্বন করে নারীকে অবনমিত ও বন্দী জীবনযাপনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে সেগুলিকে শনাক্ত ও দূর করতে হবে যেন নারী পুরুষের সমানাধিকার অর্জন করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। তাঁর বিশ্বাস- ‘আমরা পুরুষের ন্যায় সুশিক্ষা ও অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না পাওয়ায় পশ্চাতে পড়িয়া আছি। সমান সুবিধা পাইলে আমরাও কি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারিতাম না? আশৈশব আত্মনিন্দা শুনিতেছি, তাই এখন আমরা অন্ধভাবে পুরুষের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করি, এবং নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে করি।’ [অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩১]।

১৯৬৯ সালে কেটি মিল্লেত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ সেক্সুয়াল পলিটিক্স লিখে প্রমাণ করেন যে, পুরুষরা সবসময় কিছু-কিছু প্রতীক, উপমা ও চিত্রকল্প এবং ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নারীকে কোমল, দুর্বল, লজ্জাবনত, কম মেধাসম্পন্ন, আত্মসমর্পিত ও উপভোগ্য হিসেবে চিত্রিত করে থাকেন। সেই ভাবনাকে বেগম রোকেয়া তার অনেক আগেই (১৯০৫) ধারণ করেছিলেন। তিনি এক প্রবন্ধে পাত্র-পাত্রীর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে এই ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যেমন womanish শব্দ ব্যবহারে আপত্তি প্রকাশ করেছেন। [সৌরজগৎ, মতিচুর (দ্বিতীয় খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬১]।

প্রকৃতির সঙ্গে নারীর সঙ্গতি ও সমন্বয় এবং নারীত্ব ও মাতৃত্বকে বেগম রোকেয়া অস্বীকার করেননি, বরং সম্মানের বিষয় বলে মনে করেছেন। তাঁর এই বৈশিষ্ট্য তাঁকে অধুনা-উদ্ভূত ‘ইকোফেমিনিজম’ (Ecofeminism)-এর (এসেনশিয়ালিস্ট নারীবাদের একটি প্রকার) সঙ্গে সংযুক্ত করে। তিনি মনে করেন- ‘সমাজের বিধি ব্যবস্থা আমাদিগকে তাহাদের অবস্থা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিয়াছে। তাঁহাদের সুখ দুঃখ এক প্রকার, আমাদের সুখ দুঃখ অন্য প্রকার।’ [অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭]। কিন্তু তিনি ‘সেপারেটিস্ট ফেমিনিজম’-এর প্রবক্তাদের মতো নারীকে পুরুষ থেকে আলাদা করে নিতে চাননি। সে কারণে ‘লেসবিয়ান ফেমিনিজম’-এর চিন্তাও তাঁর মধ্যে ছিল না। তাঁর চিন্তাধারায় মার্কসবাদী ও সমাজতন্ত্রী নারীবাদীদের মতো পুঁজিবাদের ঘাড়ে সকল দোষ চাপানোর চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয় না, যদিও তিনি নারীর কর্মসংস্থান এবং অর্থোপার্জনের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। 

অন্যদিকে, ধর্মের ব্যাপারেও বেগম রোকেয়ার উচ্চ ধারণা ছিল। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালন করতেন। মেরি ডালির মতো উগ্র নারীবাদীদের ন্যায় তিনি ধর্ম, আইন এবং বিজ্ঞানকে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণপ্রক্রিয়ার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেননি। বরং ধর্মের প্রতি তাঁর পক্ষপাতই পরিদৃষ্ট হয়। তিনি বলেন- ‘প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণসমূহের মধ্যে প্রধান কারণ হইতেছেÑ ধর্ম্ম।’ [ঐ, পৃষ্ঠা ৬১]। তিনি বিশ্বাস করতেন- ‘...একমাত্র ইসলাম ধর্ম্মই নারীকে তাহার প্রাপ্য অধিকার দান করিয়াছে; কিন্তু ভারতবর্ষে সেই মুসলিম-নারীর দুর্দ্দশার একশেষ হইয়াছে।’ [নূর-ইসলাম, মতিচুর (দ্বিতীয় খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৩৫]।

ইসলামের পর্দা প্রথা সম্পর্কে তিনি বলেন- ‘শাস্ত্রে পর্দ্দা সম্বন্ধে যতটুকু কঠোর ব্যবস্থা আছে, প্রচলিত পর্দ্দা প্রথা তদপেক্ষাও কঠোর। যাহা হউক কেবল শাস্ত্র মানিয়া চলিলে অধিক অসুবিধা ভোগ করিতে হয় না। আমার বিবেচনায় প্রকৃত পর্দ্দা সে-ই রক্ষা করে, যে সমস্ত মানব জাতিকে সহোদর ও সহোদরার ন্যায় জ্ঞান করে।’ [কূপমণ্ডুকের হিমালয় দর্শন, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৮৯]। সম্পদে নারীর অধিকার প্রশ্নে তিনি বলেছেন- ‘আপনারা ‘মুহম্মদীয় আইনে’ দেখিতে পাইবেন যে বিধান আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্দ্ধেক ভাগ পাইবে। ...তবে দেখিবেন কার্যতঃ কন্যার ভাগে শূন্য (০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে।’ [অর্দ্ধাঙ্গী, মতিচুর (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৯]।

সুলতানার স্বপ্নতে বেগম রোকেয়া যে ‘নারীস্থান’-এর কল্পনা করেছেন, সেখানে পুরুষ জাতিকে গৃহবন্দী এবং নারীজাতিকে বাইরে স্থাপন করেছেন, ‘পর্দা’র ব্যাত্যয় ঘটাননি। -‘ওহো! আমার কি ভ্রম! -আপনি আমাদের নিয়ম আচার জ্ঞাত নহেন, একথা আমার মনেই ছিল না। এ দেশে পুরুষজাতি গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ থাকে।” [সুলতানার স্বপ্ন, মতিচুর : দ্বিতীয় খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৩]। তার মানে তিনি নারী ও পুরুষকে পর্দার মাধ্যমে পৃথকভাবেই রাখতে চেয়েছেন। এভাবে সবকিছু বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘনের পক্ষপাতী ছিলেন না। ইসলাম সুস্পষ্টরূপে নারীকে যেসব অধিকার দিয়েছে সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং ইসলামী বিধানের ভুল ব্যাখ্যার অপনোদন বা নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে উনবিংশ শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যে (মূলত ইরান ও মিসরে) যে ইসলামী নারীবাদী (Islamic Feminism) আন্দোলন শুরু হয় তার দৃষ্টিভঙির সঙ্গে বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারার মিল পাওয়া যায়। যে কালে এবং যে সমাজপ্রেক্ষিতে বেগম রোকেয়াকে কাজ করতে হয়েছে সে বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখলে তাঁর চিন্তা ও কর্মকাণ্ডকে আপসকামী বলার সুযোগ নেই, বরং বৈপ্লবিক না বলে উপায় থাকে না।

বেগম রোকেয়া কর্মোদ্যোগী মানুষ ছিলেন, কেবল চিন্তার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। তারপরেও তাঁকে চিন্তাবিদ বলতেই হয়, যদিও তিনি দার্শনিক ছিলেন না। আর তিনি তাঁর সকল চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে। তাঁর এসব সাহিত্যকর্মের প্রায় সবটাই জুড়ে রয়েছে নারীমুক্তিচিন্তা। তাঁর প্রবন্ধগুলোর কথা বাদ দিলে সৃজনশীল সাহিত্য হিসেবে গণ্য প্রধান ও বিখ্যাত তিনটি রচনা হচ্ছে সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ এবং অবরোধ-বাসিনী। এ তিনটি রচনা শিল্পকর্ম হিসেবে কতটা উত্তীর্ণ সে প্রশ্ন থাকলেও এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, এগুলো বাংলা ভাষায় তো বটেই, কাল বিবেচনায় বিশ্বপ্রেক্ষাপটেও, প্রথম দিককার সৃজনশীল নারীবাদী সাহিত্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। 

নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের (Feminist Literary Criticism) উদ্ভব বিংশ শতাব্দীর ষাট দশকে প্রথমতঃ অতীতের নারী লেখকদের রচনা আবিষ্কার ও মূল্যায়নের মাধ্যমে। তারপর পুরুষ ও নারী লেখকদের রচনায় নারী-পুরুষ বৈষম্যের প্রেক্ষিত ও চারিত্র্য বিশ্লেষণ এবং নারীবাদী দৃষ্টিভঙিতে সাহিত্য রচনাকে উৎসাহিত করা হয়। 

সুলতানার স্বপ্ন একটি স্বল্পায়তনিক রচনা। এটিকে ছোটগল্প বলাই সমীচীন। এটি একটি ব্যাঙ্গ-রসাত্মক সৃষ্টি। একে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও বলা চলে। নারী যে কোনও অংশেই পুরুষের তুলনায় কম নয় সেটি একটি কল্পকাহিনীর মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন বেগম রোকেয়া। এই গল্পে নারীরা তাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা, উদ্যম এবং কর্মতৎপরতার জোরে যে দেশ গড়ে তুলেছেন সেটি ‘নারীস্থান’, অর্থাৎ নারীদের বা নারীশাসিত বা নারী-প্রাধান্যের দেশ। এখানে লেখক নারীকে পুরুষের সমান নয়, বরং তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর হিসেবে চিত্রিত করেছেন। এই চিন্তা সে কালে এদেশে তো বটেই, সারা বিশ্বেই, একেবারেই অভিনব ছিল। এটি সম্পূর্ণতঃ নারীবাদী চিন্তার ফসল। পদ্মরাগ উপন্যাসের নায়িকা একজন নারী। সে কালে একজন নারীকে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করাও ছিল নতুন ব্যাপার। নায়িকা সিদ্দিকা নারী জাগরণ, নারীশিক্ষা ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মযজ্ঞে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেয়। এটি একটি উদ্দেশ্যবাদী রচনা, এতে যথেষ্ট আবেগও রয়েছে, তথাপি বিষয়গুণে এটি নারীবাদী সাহিত্যের অভাব পূরণ করেছে। অবরোধ-বাসিনী গ্রন্থে তিনি যে ছোট ছোট নকশা জাতীয় ব্যাঙ্গরসাত্মক কাহিনী রচনা করেছেন তার প্রত্যেকটিই অবরোধ-প্রথার বাড়াবাড়িকে আক্রমণ করে লিখিত।

নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গের সময়। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত কেটি মিল্লেত-এর সেক্সুয়াল পলিটিক্স এবং ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ডালি স্পেন্ডারের মাদার্স অফ দি নভেল এবং জেন স্পেন্সারের দি রাইজ অফ দি উওমেন নভেলিস্টস এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। উরসুলা কে. লা গুইন-এর দি লেফ্ট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস (১৯৬৯), জোয়ানা রাস-এর দি ফিমেল ম্যান (১৯৭০), অক্টাভিয়া বাটলার-এর কিন্ড্রেড (১৯৭৯) এবং মার্গারেট অ্যাটউড-এর হ্যান্ডমেইডস টেল (১৯৮৫) কে নারীবাদী সৃজনশীল সাহিত্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অথচ এদের অনেক আগে বেগম রোকেয়া সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ এবং অবরোধ-বাসিনী রচনা করেছেন। একজন নারীবাদী হিসেবে তাঁর মৌলিকত্ব এবং একজন অগ্রণী নারীবাদী সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে তাঁর অনস্বীকার্য গুরুত্ব এখানেই।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ