শুক্রবার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩
Online Edition

ফুটপাতই তাদের আপন ঘর সংসার

খুলনা অফিস : প্রখর রোদ, কনকনে ঠান্ডা কিংবা তীব্র বৃষ্টির মধ্যেও ফুটপাথে খোলা আকাশের নিচেই জীবন কাটছে ‘সিনিয়র সিটিজেন’ খ্যাত দু’বয়স্ক বৃদ্ধার। খেয়ে-না খেয়ে জীবন কাটছে তাদের। কিন্তু তাদের দিকে ফিরে তাকানোর যেন ফুসরত নেই কারোর। ঘরবাড়ি ও স্বজনহারা এ দু’বৃদ্ধার আহাজারি কি তাহলে কারোরই কানে পৌঁছে না- এ প্রশ্ন যে কেউই করতে পারেন। বোধহয় বিষয়টি বুঝতে পেরেই এই দুই বৃদ্ধা ফুটপাতকেই বেছে নিয়েছেন জীবনের শেষ অবলম্বন হিসেবে। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে তারা এখন আর কারো কাছে কোন আশ্রয় চান না।
এ দৃশ্য মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র খুলনা সদর থানা মোড়ের। থানা বাউন্ডারির মাত্র ২২ গজের মধ্যে (থানা কোয়াটার লাগোয়া কার্ড সেন্টার-২’র সামনে) বছরের পর বছর ধরে এ চিত্র দেখা মিললেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যেন চোখে পড়েনি। এমনকি নগর ভবনের খুব কাছেই এ দৃশ্যের অবতারণা হলেও নগর পিতারও যেন নজর পড়েনি। শুধু থানা পুলিশ বা নগরপিতা-ই কেন কাছেই জেলার ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয় থাকলেও তারও চোখ এড়িয়ে গেছে। এমনকি কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি বা রাজনৈতিক নেতারও নজর পড়েনি অবহেলিত এ দুই বৃদ্ধার দিকে। হয়তো পড়লেও চোখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তারা। যার ফলে বৃদ্ধা নুরজাহান বেগম ও সবুরুন্নেসা খেয়ে না খেয়ে খোলা আকাশের নিচেই জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছেন।
স¤প্রতি থানা ফুটপাত দিয়ে হেটে যেতেই নজর পড়লো বৃষ্টির মধ্যে কম্বল পেচিয়ে ঠান্ডা থেকে রক্ষার চেষ্টায়রত এ দুই বৃদ্ধার দিকে। একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে কনকনে ঠান্ডায় যেন আড়ষ্ঠ হয়েছিলেন তাঁরা। জবুথবু অবস্থা। কাছে গিয়ে এ পরিস্থিতির কারণ জিজ্ঞাসা করলেও প্রথমে ঠোঁট আওড়িয়ে শুধু বিড়বিড় করছিলেন নুরজাহান বেগম। কোন কথা-ই- যেন গলার স্বর থেকে বের হতে চাইছিল না। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর ধীরে ধীরে জীবন কাহিনী শোনাতে লাগলেন তিনি।
বৃদ্ধা নুরজাহান বেগম জানান, তার গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলা সদরের খলিশাখালি গ্রামে। এক সময় স্বামী-সংসার- সন্তান সবই ছিল তার। কিন্তু এখন আর কিছুই নেই। স্বামী মোহাম্মদ মনসুর আলী শেখ কত বছর আগে মারা গেছেন সেটি তার মনে নেই। এমনকি একমাত্র ছেলে আনোয়ার হোসেন শেখ অসুস্থ হয়ে কয়েক বছর আগেই মৃত্যুবরণ করেছে। আর তারপর থেকেই নুরজাহান বেগম বাড়ি থেকে অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন। খুলনা শহরে এসে মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে দু’ মুঠো অন্ন জুগিয়ে বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রামে নেমে পড়েন। এরপর থেকেই মূলত শুরু হয় তার জীবন যুদ্ধ। তিনি বাড়ি বাড়ি কাজের পাশাপাশি হোটেল রেস্তোরায়ও কাজ করেছেন। এমনকি বড় বাজারের কালিবাড়ি এলাকায় ট্রাক থেকে তেলের ড্রাম নামানোর সময় রাস্তায় গড়িয়ে পড়া ফোটা ফোটা তেল ধূলা-বালুর মধ্যে থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে সংগ্রহ করেও দু’টি অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করেছেন। এভাবেই তার চলে গেছে কতগুলো বছর।
সর্বশেষ তিনি খুলনা সদর থানা কোয়াটারে গৃহপরিচারিকার কাজ নেন। এতেও কেটে যায় কয়েক বছর। কিন্তু পা পিছলে পড়ে গিয়ে তার ডান হাতটি ভেঙ্গে যাওয়ায় কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তিনি। ফলশ্রুতিতে বাড়িওয়ালা নতুন লোক নিয়োগ দেয়। আর কাজ হারান তিনি। ওই ভাঙ্গা হাত নিয়েই পিচঢালা সড়কের ফুটপাতেই অবস্থান নেন তিনি। এভাবেই কেটে গেছে ১৫ থেকে ২০ টি বছর। ফুটপাতেই তার থাকা-খাওয়া ঘুম, দিনরাত সবই কেটে যাচ্ছে। সঙ্গে আট-নয় বছর ধরে যুক্ত হন সবুরন্নেসা নামে আরও এক বৃদ্ধা। তিনি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার কৈয়া এলাকার বাসিন্দা। সবুরুন্নেসা ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন নূরজাহান বেগমকে। ফুটপাথে কিভাবে থাকেন এবং কি-ই বা খান- এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেই নুরজাহান বেগম বলেন, ‘মানুষ যা দেয় তাই খাই, না দিলে না খেয়ে থাকি। মানুষ কাপড়-চোপড় দেয় তাই পরি। এখানে থাকি, এখানে ঘুমাই, এখানেই সবকিছু’। কোন অসুবিধা হয় না-জানতে চাইলে বলেন, ‘অসুবিধা হলেও থাকতে হবে, না হলেও থাকতে হবে, কি করব, কোথায় যাব? অভিমানের সুরে বলেই ফেললেন ‘আর কোন জায়গায় যাব না, মৃত্যু পর্যন্ত এখানেই থাকবো।’ তবে সবুরুন্নেসা খুব একটা কথা বলার আগ্রহ দেখাননি।
এ সময় মোহাম্মদ টুকু শেখ নামে থানা কোয়ার্টারের কেয়ারটেকারকে এসে এ দুই বৃদ্ধার খোঁজখবর করতে দেখা যায়। জানতে চাইলে টুকু শেখ বলেন, তিনি ১৫ বছর ধরে নূরজাহান বেগমকে এই ফুটপাতেই দেখছেন, আর সাত-আট বছর হল সবুরুন্নেসা এসেছে। তিনি নূরজাহান বেগমকে ‘নজু বু’ বলে ডাকেন। তিনি বলেন, ‘নজু বু’ র স্বামী ও একটি ছেলে ছিল। তারা মারা গেছে। সবুরুন্নেসা তাকে মা বলে ডাকে। মানুষের কাছ থেকে জা পায় দু’জনে ভাগ করে খায়। আর আমি পানিসহ অন্য অন্য কিছু এনে দেই। করোনার মধ্যে তারা অসুস্থ ছিল, কেউ ভয়ে আসেনি, আমি কাপড় ধুয়ে দিয়েছি। তারা এখানে থাকে, আমি দেখাশোনা করি। কোন কিছু লাগলে এনে দিই। আমি তো আর তাদের বাড়িতে নিয়ে রাখতে পারিনা, আমার সে সামর্থ্য নেই। অসহায়ত্ব প্রকাশ করে টুকু শেখ বলেন, সরকারি অফিসাররা যদি কোন ব্যবস্থা না করে আমি কি করতে পারি। তাদের দেখে কষ্ট লাগে। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। সরকার যদি তাদের জন্য কোন আশ্রয় এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে তাহলে কিছুটা হলেও তারা শেষ জীবনটুকু শান্তিতে কাটাতে পারবে বলে মনে করেন তিনি। এ ব্যাপারে খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, এ ধরণের অনেককেই পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা থাকতে চায় না। চলে আসে। তারপরও এ দু’ বৃদ্ধার পুনর্বাসনের বিষয়টি দেখা হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ