মঙ্গলবার ২১ মার্চ ২০২৩
Online Edition

নাগালের বাইরে জনগণের ক্রয় ক্ষমতা

এইচ এম আকতার : সিন্ডিকেটের কবলে দেশের নিত্যপণ্যের বাজার। সরকার কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসেনি। দেশের বাজারব্যবস্থা জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তবে এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আশা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে আলু, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচসহ নিত্যপণ্যের এই ধরনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। এমনিতেই করোনায় অনেকের আয় কমে গেছে, কেউ বেকার হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো নেমে এসেছে নিত্যপণ্যসামগ্রীর অস্বাভাবিক গতি। এতে করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ম আয়ের লোকজন চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৫০ টাকা। অন্য সবজির তুলনায় এ দামকে বেশি বলার সুযোগ নেই। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে ৩৫ থেকে আলুর দাম ৫০ টাকায় পৌঁছার কারণ কী তা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ভোক্তারা। বাণিজ্যমন্ত্রী আলুর দাম প্রতিকেজি ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও তা মান্য করার প্রয়োজন বোধ করছে না কেউ। চলতি বছর আলুর উৎপাদন হয়েছে কিছুটা কম। তবে এ পরিমাণ স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু একদিকে করোনাকাল অন্যদিকে একের পর এক বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে অন্য সব সবজি নষ্ট হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আলুর ওপর চাপ পড়েছে। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর আলুর ব্যবহার বেড়েছে অন্তত ১০ ভাগ বেশি। এ বছর বিপুল পরিমাণ আলু বিদেশে বিশেষত নেপালে রফতানি হয়েছে।
আলু রফতানিতে রফতানিকারকদের শতকরা ২০ ভাগ প্রণোদনা দেওয়ায় বিদেশি আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে আলু কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছে। এ মুহূর্তে দেশের হিমাগারগুলোয় যে আলু রয়েছে তাতে সংকট হওয়ার কথা নয়। তবে মজুদকারীরা আলু বিক্রিতে ধীরে চল নীতি গ্রহণ করায় বাজারে তার প্রভাব পড়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দাম ভোক্তাদের ক্ষমতার মধ্যে রাখতে টিসিবির উদ্যোগে আলু বিক্রি শুরু হয়েছে ২৫ টাকা কেজিতে, যা একটি ভালো উদ্যোগ। আলুর দাম বৃদ্ধিতে অস্বাভাবিকতা না থাকলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যথাযথ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি। তাদের উচিত ছিল অন্য সব সবজির ফলন মার খাওয়ায় আলু যে শেষ ভরসা তা বুঝে সময় থাকতে রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। দেরিতে হলেও রফতানিতে বাদসাধা হয়েছে। কিন্তু এ বিলম্বই যে এ নিত্যপণ্যটির দাম রাতারাতি বৃদ্ধি করেছে তা এক বড় সত্য। এ ব্যাপারে কর্তাব্যক্তিরা ভবিষ্যতে চোখ-কান খোলা রাখবেন এমনটিই প্রত্যাশিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্বনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আলু, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মধ্যবিত্ত সমাজ। বিশেষ করে নিম্ম আয়ের যাদের তারা খুবই করুন জীবন যাপন করছেন। পাশাপাশি নিম্ন মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্টির দুর্ভোগও চরম আকার ধারণ করছে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে অনেকের আয়ের উৎস কমে গেছে, কারো আয় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক চাকরিজীবীর বেতনভাতা কমেও গেছে কিংবা অনিয়মিত হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিটা খুবই অপ্রত্যাশিত এবং উদ্বেগজনক। এতে মানুষের জীবনযাত্রার মানের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, বিষয়টা এমন হয়নি যে চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে কিন্তু বাজারে পণ্য সরবরাহ নেই। বরং বাজারে প্রচুর আলু, পেঁয়াজসহ সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ রয়েছে। তারপরেও কেন দাম বাড়ছে? এর কারণ হলো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এইক্ষেত্রে খুচরা ও পাইকারী উভয় ব্যবসায়ীরাও মিলেই এই কারসাজিটা করছে। ফলে পণ্যর দাম মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর বলেন, সরকার কোনোভাবেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। মাঝে মাঝে মোবইলকোর্ট পরিচালনা করে ১/২ জনকে জরিমানা করলেও তা কোন কাজে আসছে না। কারণ হাজার হাজার লোকের মাঝে ১/২ জনকে জরিমানা করলে কি আসে যায় বরং জরিমানার পরে তারা আবার দাম বাড়িয়ে তা পুষিয়ে নেয়। ফলে মোবাইল কোর্ট কোনো সমাধান না। সমাধান হলো সার্বক্ষনিক বাজার মনিটরিং করতে হবে। সরকারকে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে সব ধরনের সিন্ডিকেট পরিচালনাকারীদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। এই ধরনের কঠোর অবস্থান না নিলে তা কোনো কাজে আসবে না।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যের দাম কিছুটা বেড়ে থাকতে পারে। ক্রান আগে যে ট্রাক ভাড়া ৫ হাজার টাকা ছিলো সেটা কোন কোন ক্ষেত্রে ১০/১২ হাজার টাকা হয়ে গেছে। দাম বাড়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে। তবে আশেপাশের এলাকা থেকে কিংবা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ার কথা না। কিন্তু বর্তমানে সব স্থানে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। এতে বলা যায় দাম বাড়ার প্রধান কারণ সিন্ডিকেট। তাই সরকারকে যে কোন মূল্যে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। এটা করতে না পারলে করোনার সময়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি খাদ্য ঝুঁকি, পুষ্টি ঝুঁকি তথা দারিদ্র্যও বেড়ে যাবে।
অন্যদিকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে কম বেশি সমাজের সব স্তরের মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।কারণ আলু, পেঁয়াজ কোন বিলাসিতার পণ্য না।
তিনি বলেন, করোনার কারণে সমাজের অনেক মানুষের আয় কমে গেছে। কেউ পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েছেন।এই অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিকল্প সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে কঠোর থেখে আরও কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। শুধু ধমক দিয়ে দাম কমানো যাবে না।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, বাজারে পণ্যের কোন ঘাটতি নেই, তারপরেও কেন দাম বাড়ছে? এর কারণ হতে পারে বাজারের প্রতি নিয়ন্ত্রণ নেই। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে বিকল্প সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
উল্লেখ্য দেশে পর্যাপ্ত আলু মজুদ থাকলেও নানা ধরনের সিন্ডিকেটের কারণে প্রতি কেজি আলুর ৫০ থেকে ৬০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা, কাঁচামরিচের কেজি ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ