কক্সবাজারে শতাধিক মহালে শুঁটকি তৈরির ধুম ॥ উৎপাদনে ব্যস্ত হাজার হাজার শ্রমিক
কামাল হোসেন আজাদ, কক্সবাজার: কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে শুঁটকি উৎপাদনের ধুম পড়েছে। শতাধিক মহালে এখন শুঁটকি উৎপাদনের মূল ক্ষেত্র মাছের হলা কিংবা মাচা তৈরির প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। শরতের শেষদিকে শীতের শুরু দিকটাকে শুঁটকি উৎপাদনের উপযুক্ত সময় উল্লেখ করে মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তাই এই মৌসুমকে কেন্দ্র করে জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের শুঁটকি মহালগুলোতে মানসম্মত শুঁটকি উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছে হাজার হাজার শ্রমিক। এসব শুঁটকি মহালে পুরুষ শ্রমিকদের সাথে পাল্লা দিয়ে নারী-শিশু শ্রমিকও তাদের শ্রম নিয়োগ করে যাচ্ছে।
সূত্রে জানা গেছে, জেলার উপকূলীয় এলাকা কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়ার মগনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া, শহরের নাজিরারটেক, নুনিয়ারছড়া, মগচিতাপাড়া ও টেকনাফের উপকূলীয় এলাকায় শুঁটকি উৎপাদনের কাজকর্ম শুরু হয়েছে। সমুদ্র উপকূলে কাঁচা মাছ রোদে শুকিয়ে ‘শুঁটকি মাছ’ উৎপাদন হয় জেলার ওইসব এলাকাসমূহে।
জেলার কয়েকশ মহালে শুঁটকি উৎপাদন চলছে। শুঁটকি উৎপাদনের চাহিদায় রয়েছে লইট্যা, ছুরি, পোপা, মাইট্যা, কামিলা, ফাইস্যা, রূপচান্দাসহ বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ। সংশ্লিষ্টরা জানান, শীত মৌসুমে উৎপাদিত শুঁটকির কদর দেশব্যাপি। পুরোনো শুঁটকির তুলনায় নতুন শুঁটকির দাম বেশি।
চাহিদার আলোকে শুঁটকি বাজার দর প্রতি কেজি ছুরি শুঁটকি ৭’শ থেকে ১২’শ টাকা, রূপচান্দা ৯’শ থেকে ২হাজার, মাইট্যা ৬’শ থেকে ১৭’শ, লইট্যা ৪’শ থেকে ৮’শ, কোরাল ৮’শ থেকে ১৪’শ, পোপা ৪’শ থেকে ৮’শ, চিংড়ি ১হাজার থেকে ১৫’শ টাকা এবং অন্যান্য ছোট মাছ ২’শ থেকে সাড়ে ৪’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জেলার প্রায় ৬ হাজার ট্রলার সাগরে গিয়ে ইলিশ, কোরাল, লাক্ষা, চাপা, কামিলা, রুপচাঁদা, পোপাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরে আনছে। এসব মাছের বড় একটা অংশ যাচ্ছে শুঁটকি মহালে। শহরের নাজিরারটেক এলাকার প্রায় ৬০টির মতো মহাল রয়েছে। এরমধ্যে পুরুষদের পাশাপাশি শ্রম নিয়োগ করছে নারী ও শিশু শ্রমিকও।
নাজিরারটেক এলাকার পাশের ফদনারডেইল, নুনিয়ারছড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, মগচিতাপাড়া উপকূলেও অসংখ্য মহালে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ চলছে। রোদ যত বেশি শুঁটকি উৎপাদনও তত বেশি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করে থাকেন, রোদ মানেই শুঁটকি। রোদে পুড়িয়েই মূলত ভোজন রসিকদের চাহিদা নির্ভর উৎকৃষ্ট মানের শুঁটকি তৈরি হচ্ছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানায়, শহরের নাজিরারটেক, ফদনারডেইল, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া থেকে প্রতি সপ্তাহে এই উপকূল থেকে অন্তত ৫কোটি টাকার শুঁটকি দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে। শুঁটকি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত আছে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক।
শুঁটকি ব্যবসায়ী সূত্র আরো জানায়, কুতুবদিয়া, মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া, ধলঘাটা, কক্সবাজার সদর উপজেলার চৌফলদন্ডি, খুরুশকুল, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, বাহারছড়া এলাকায় প্রতি বছরই শুঁটকি উৎপাদন হয়ে থাকে।
নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ আতাউর রহমান কায়সার জানান, প্রতি সপ্তাহে নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল থেকে ৪’শ মণের বেশি শুঁটকি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে সরবরাহ দেয়া হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, শুঁটকির জোগান দিতে বহু ব্যবসায়ী টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ ছাড়া খুলনার সুন্দরবন, নোয়াখালীর হাতিয়া, রাঙ্গাবালীসহ বিভিন্ন উপকূল থেকে এখানে শুঁটকি এনে চড়া মূল্যে বিক্রি করছেন।
একাধিক শুঁটকি ব্যবসায়ী জানান, কক্সবাজারে ভ্রমণে আসা পর্যটকের উল্লেখযোগ্য অংশ বাড়ি ফেরার সময় সখের বসে কয়েক কেজি করে শুঁটকি কিনে নেন। শহরের ছোট-বড় ছয় শতাধিক হোটেল-রেস্তোরাঁয়ও মুখরোচক রেসিপি হিসেবে পর্যটকের জন্য খাবারের সঙ্গে রুচি জুড়ে দিতে শুঁটকির ভর্তা রাখতে হচ্ছে।
জেলার ৩৭টি মহাল থেকে হংকং, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় শুধু পোপা শুঁটকি রপ্তানি করে প্রায় শত কোটি টাকা আয় করা হয়। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে এ বছর শুঁটকি রপ্তানি থেকে হাজার কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।