‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের সূর্যোদয়’ অতঃপর বাস্তবতা
জসীম উদ্দিন : দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে গত ১৩ আগস্ট দুই আরব দেশ (সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন) ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি চুক্তি সম্পন্ন হয় যে চুক্তিপত্রে গত মঙ্গলবারে হোয়াইট হাউসে স্বাক্ষর করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এবং বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিন রাশেদ আল যিয়ানি। আর এই শান্তি চুক্তিতে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে মধ্যস্থতা করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে বিশ্ববাসীর এমনকি বিশিষ্ট আমলা, কূটনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের নজর কাড়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের কেউবা ভূয়সী প্রশংসা করছে আবার কেউবা আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতির সূত্র ধরে ট্রাম্পের সমালোচনা করছে কিংবা কেউ ট্রাম্পকে ধিক্কার জানিয়ে তীব্র নিন্দা করছে। তবে নিন্দা বা সমালোচনার বিষয়টি জনসম্মুখে বেশি না আসলেও আসছে প্রশংসার বিষয়টি। কেননা ইতোমধ্যে ট্রাম্পের এ কাজের জন্য নরওয়ের নোবেল কমিটি তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেবে বলে মনোনীত করেছে। ট্রাম্পও এ কাজে তৃতীয় পক্ষ হতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছেন এমনকি নিজের কাজের নিজেই প্রশংসা করে এ চুক্তিকে “ঐতিহাসিক চুক্তি ও নতুন মধ্যপ্রাচ্যের সূর্যোদয়” বলে অভিহিত করছেন।
এখন প্রশ্ন হল, আসলেই কি এ চুক্তিটি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি নতুন ভোরের সূর্যোদয় নাকি কালো মেঘের আকাশটা আরো বিস্তৃত হল? চলুন না একটু বাস্তবতা দেখে আসি।
১৪ মে ২০১৮ সাল, নিশ্চয়ই তারিখটি অনেকের মনে আছে। মনে থাকবে না কেন? মনে আছে, সে দিন ইসরাইলীর এক বিধ্বংসী জঙ্গি হামলায় প্যালেস্টাইন পরিণত হয়েছিল রক্তাক্ত প্রান্তরে। গাজা ছিল সে হামলার কেন্দ্রবিন্দু। রক্তের ঢেউ আর লাশের স্তূপে গাজার বুক হয়েছিল কারবালার প্রান্তরের ন্যায়। সেদিন ইসরায়েলের সেনাদের হাতে গাজার ৫৮ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল এবং তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিল। সেই দিনের ক্ষতের দাগ এখনো শুকায় নি, ভুলেনি সেদিনটি আজো প্যালেস্টাইনের মানুষেরা। শুধু তাই নয় তারা তা স্মরণ করে রাখতে প্রতিবছর এই দিনে পালন করে ‘নাকবা দিবস’ বা বিপর্যয়ের দিন। আজকে যখন সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন, ইসরায়েলের সাথে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হল তখন এ নিয়ে প্যালেস্টাইনের মাঝে ঐ ক্ষতের ব্যথার তীব্রতা দ্বিগুণ হারে প্রতিফলন হতে দেখা গেল। প্যালেস্টাইন বিশ্লেষণকরা এ চুক্তিকে নিয়ে মন্তব্য করছেন "ওরা ছিল আমাদের ঘরের শত্রু বিভীষণ"। তাছাড়া হামাস মন্তব্য করেছে "ওরা আমাদের পিঠে ছুরি মেরেছে। এ চুক্তি ইসরাইলের আগ্রাসন নীতি। “শুধু তারাই নয় স্বয়ং প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও এ চুক্তির তীব্র নিন্দা করে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এই চুক্তিটি জেরুসালেম, আল-আকসা এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। ” তবে শুধু মন্তব্য করেই প্যালেস্টাইন থেমে যায়নি। চুক্তিপত্রে সাক্ষর করার দিনই ইসলামপন্থী সংগঠন হামাস একটি রকেট ছোড়ে ইসরায়েলের উপকূলীয় শহর আশদোদে হামলা চালায় এতে নিহত হয় ২ জন। অন্যদিকে ইসরাইলও প্রতিশোধ নিতে পরেরদিন বুধবারে প্যালেস্টাইনে ১০ টি বিমান হামলা চালায়। পাল্টা হামাস আবারো ১৫ টি রকেট ছুঁড়ে মারে ইসরায়েলের বুকে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে প্যালেস্টাইন ও ইসরায়লের মধ্যে নব যুদ্ধের দামামা। শুধু তাই নয় ইতোমধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য প্যালেস্টাইন বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে। এমনকি প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রদূত সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর মানে নির্ঘাত যুদ্ধ।
উপরন্তু আল জাজিরা প্রকাশ করেছে বাহরাইন ও আমিরাতে মধ্যবর্তী দেশ কাতারের এ চুক্তি নিয়ে নিজস্ব প্রতিক্রিয়া। কাতার স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে তারা কখন ওদের মত বিশ্বাসঘাতকতা করবে না অর্থাৎ ইসরায়েলের সাথে সমঝোতার চুক্তি স্থাপন করবে না। কাতার এ চুক্তির নিন্দা জানায়। দুই আরব দেশের মধ্যবর্তী থেকে যখন কাতার বিপরীতমুখী মনোভাব প্রকাশ করে তখন স্পষ্ট বুঝা যায় তাদের সাথে কাতারের কূটনীতিক সম্পর্ক কেমন হবে। নিশ্চয়ই সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ হবে না। ভূ-রাজনৈতিক রোষানল সর্বত্র লেগে থাকবে এমনটা বুঝায়।
কিন্তু সৌদি আরব এখনো বেশ নীরব দর্শকরে ভূমিকা পালন করছে। আমেরিকার ভয়ে নাকি অন্য কিছু তা এখনো বুঝা যাচ্ছে না। তবে নীরবতা হতে পারে সৌদি আরবে নতুন ডিপ্লোম্যাসি। কিন্তু জর্ডান সরকার আবার এ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। আর মিশরের ইঙ্গিতটা তো স্পষ্ট, ১৯৭৯ সালে যখন আনোয়ার সাদাত ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল মানে সমঝোতার চুক্তি করেছিল তখনই মিশরের মানুষ তা মানতে নারাজ ছিল। যে কারণে দেখা গিয়েছিল মিশরের মানুষ প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের প্রাণ কেড়ে নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। মানে বুঝাতে চাচ্ছি যখন নিজ দেশের মানুষ ইসরায়েলকে সম্মতি দিতে গিয়ে প্রাণ হারালো অর্থাৎ তখনি যেহেতু মিশর ইসরায়েলের বিরোধিতা করেছিল আর এখন তো অন্য দেশ প্রসঙ্গে আরব ভূখণ্ডের অশান্তির রাশ তাহলে কিভাবে তা মেনে নিবে? ফলে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে এক রকম একপাশে করে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ। তবে শুধু একপেশেই করে নি করেছে বন্ধুর সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত। এতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য এখন ডুবে আছে অন্তর্দ্বন্দ্বে। আর সেখানে প্রতিনিয়তই বিষের মন্ত্র ঢালছে যুক্তরাষ্ট্র।
অপরদিকে ইরাক বাহরাইনের দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক আরো দ্বিগুণ শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠবে বলে মনে করছি। কেননা ইরাক চেয়েছিল বাহরাইন তার হউক বা চেয়েছিল আমেরিকা যেন মধ্যপ্রাচ্যে ছলে, বলে, কৌশলে ঢুকতে না পারে। জায়োনিজম যেন বিস্তার না করতে পারে। কিন্তু বাহরাইন যেহেতু তা নস্যাৎ করে দিল ফলে ইরাক প্যালেস্টাইনের পক্ষ নিয়ে এ চুক্তিকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিপদ’ বলে অভিহিত করেছে। ইরাক আরও বলেছে প্যালেস্টাইনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কোনোদিন ক্ষমা পাবে না বাহরাইন। আর সে প্রসঙ্গেই যখন বাহরাইন আমেরিকার মদদপুষ্ট ইসরাইলকে সে সুযোগটা করে দিয়েছে তখন তাহলে ইরাক-বাহরাইন সম্পর্কটা কেমন হতে পারে আপনারই বলেন। আবার তুরস্কও এই চুক্তিতে দুই আরব দেশের প্রতি বেশ ক্ষিপ্ত। মানে এটা স্পষ্ট, ইসলামিক দেশ আর ইহুদিবাদে বিশ্বাসী দেশ নতুন ঠান্ডা লড়ায়ের ইঙ্গিত বহন করছে আর তারাই মধ্যপ্রাচ্যকে অন্তর্দ্বন্দ্বে দ্বিখণ্ডিত করছে। যেখানে এখন মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ততটা আশা করা যাচ্ছে না।
আমরা জানি দু’পক্ষ লড়াই করলে তৃতীয় পক্ষের জয় সুনিশ্চিত। আমারিকাও সেই নীতির বিশ্বাসী। তাই ইসরায়েলের দ্বারা সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনকে পুঁজি করে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে ঢুকে প্যালেস্টাইনকে নিজের করে নিতে বেশ তৎপর। কারণটা সবার জানা, প্যালেস্টাইন ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের জন্য সমান তীর্থ মর্যাদার স্থান। যেকারণে তা দখল করতে আমেরিকার লড়াই অতীত হতে আজ বর্তমান অবধি। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন (ইউরোপের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যে ‘জায়োনিজম/ইহুদিবাদ প্রতিষ্ঠা হউক) এ চুক্তিতে সফল হবে। সর্বোপরি দেখা গেল আমেরিকা সুযোগ লুটে মধ্যপ্রাচ্যকে দুই ভাগে ভাগ করে সৃষ্টি করছে মধ্যপ্রাচ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব। তাহলে প্রশ্ন আসে এ চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে কিভাবে নতুন ভোরের শান্তির সূর্যোদয় হল?
বিশ্লেষকরা বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামীর (৩রা নভেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন) নির্বাচনকে চাঙ্গা করতে এমন ইস্যু হাতে নিয়েছে। আমারও তাই মনে হয় কেননা আমেরিকা যতই সমঝোতা করে বিরল দৃষ্টান্ত রাখুক ইসরায়েলের মনোভাব তার প্রমাণ বহন করে না। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এখনো বলে যাচ্ছে, তিনি পশ্চিম তীরের (সংযুক্ত আরব আমিরাত দিকে) কিছু অংশ ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা স্থগিত রাখলেও তা বাতিল করেন নি, এই পরিকল্পনা এখনো আছে। এমন মনোভাব যদি এখনো থেকেই থাকে তাহলে চুক্তির থাকা সত্ত্বেও বিপদে পড়বে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ফলে বিশ্লেষণের পরিভাষায় বলা যায়, এ চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে নব ভোরের সূর্যোদয় নয় বরং বিপদ ডেকে আনছে। তারপরেও কি বলা চলে, এ চুক্তি নতুন মধ্যপ্রাচ্যে সূর্যোদয়?