শুক্রবার ৩১ মার্চ ২০২৩
Online Edition

খুলনায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করোনার মধ্যেও বাণিজ্য

খুলনা অফিস : খুলনায় এ পর্যন্ত ২০০৬ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছিল ১৮৯৫ জন। আর করোনায় মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের। এ সময় সুস্থ হয়েছেন ২৬৬ জন। খুলনা মেডিকেল কলেজের (খুমেক) আরটি-পিসিআর ল্যাবে মঙ্গলবার ১২৩ জনের করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। শনাক্তদের মধ্যে ১১৬ জনই খুলনা জেলা ও মহানগরীর। এছাড়াও পিরোজপুরে ও বাগেরহাটে ২ জন এবং ১ জন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে নওগা, সাতক্ষীরা ও গোপালগঞ্জে।
খুলনা মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. মেহেদী নেওয়াজ জানান, মঙ্গলবার খুমেকের পিসিআর মেশিনে মোট ২৮২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। মোট নমুনায় করোনা পজেটিভ রিপোর্ট এসেছে ১২৩ জনের। যার খুলনারই পজেটিভ ১১৬টি। এরমধ্যে ৫ জন ফলোআপ রিপোর্ট পুনরায় করোনা পজেটিভ ধরা পড়েছে। মঙ্গলবার খুলনার নমুনা ছিলো ২৭১টি। তিনি আরও জানান, খুলনা ছাড়াও ২ জন করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে পিরোজপুরে ও বাগেরহাটে। আর একজন শনাক্ত হয়েছে নওগা, সাতক্ষীরা ও গোপালগঞ্জ জেলায়। খুলনায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১৩ এপ্রিল। নগরীর করিমনগর এলাকার অবসর প্রাপ্ত ব্যাংকার আজিজুর রহমান।
এদিকে খুলনা মহানগরীর বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো অধিকাংশ করোনা ভাইরাসের মধ্যেও রোগীদের সেবা দেওয়ার নামে করছে প্রতারণা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে নগরীর বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়গনিস্টিক সেন্টার। তাছাড়া নগরীতে বেশ কয়েকটি নামি দামি হাসপাতাল করোনার ভয়ে আধা লকডাউন থাকলেও চিকিৎসক শূন্য রয়েছে। অসুস্থ্য সেবা প্রত্যাশিত রোগীরা জরুরী ভিক্তিতে চিকিৎসা সেবা নিতে গেলে পাচ্ছেন না চিকিৎসকদের সিরিয়াল।
নগরীর ময়লাপোতা মোড়ে সিটি মেডিকেল কলেজে রোগী বাগেরহাট বৈটপুর এলাকা থেকে আঞ্জিরা বেগম কিডনি পয়েন্ট বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়েছিলেন চিকিৎসক আরশাদুল আজিমের কাছে। অথচ কাউন্টার থেকে বলে দিয়েছে তার অনেক সিরিয়াল পড়ে আছে। এই মহূর্তে রোগী দেখবেন না। এক সপ্তাহ পরে আসেন। এই সুযোগে ওই হাসপাতালের এক কর্মচারি তাকে বাবু খান রোডে দেশ ডায়গনিস্টিক সেন্টারের কার্ড দিয়ে পাঠিয়ে দেন এবং বলেন এখন শহরে একজনও চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি দ্রæত এই ঠিকানায় চলে যান। সেখানে আরশাদুল আজীম অনকলে এসে রোগী দেখেন। তাছাড়া সেখানে ভাল ডাক্তার আছে। পরবর্তিতে দুই ঘন্টা অপেক্ষায় থাকার পর একজন ওই ডায়গনিষ্টিক সেন্টারের নিয়ে যায় এবং একজন লোক তাকে দেখে বলেন আগে কিছু টেস্ট করেন আপনার জন্য সহজ হবে। তাই বলে সে একটি কাগজে কয়েকটি পরীক্ষা করতে দেয় এবং পরীক্ষা বাবদ তার কাছ থেকে ৪৭০০ টাকা নেন। পরে পরীক্ষা করলেও চিকিৎসক আরশাদুল আজীমকে দেখাতে পারেননি। পরবর্তিতে এক স্বজন এর মাধ্যমে দশ টাকা শেখ আবু নাসের হাসপাতালে চিকিৎসক আরশাদুল আজীমকে দেখায়। এবিষয়ে দেশ ডায়গনিস্টিক সেন্টারের মালিক নাসির উদ্দিন বলেন, আমি এই বিষয়ে কিছুই জানি না। আমার প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং এর লোক আছে। যারা মাসিক বেতনভুক্ত। তাদের কাজ রোগীদের নিয়ে আসা। তাছাড়া এখন তো অনেক ডাক্তার আসছেন না। আপনি পরূীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে আসেন। দেখি তাদের কিছু সম্মান করা যায় কিনা।
মূলত নগরীর মধ্যে প্রায় কয়েকশ’ অবৈধ ডায়গনিস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। এই সেন্টারগুলো মার্কেটিং এ কিছু মহিলা ও পুরুষ নিয়োগ দেয়। মাসিক বেতনে, আবার কাউকে শতকর ৪০% কমিশনে। এদের কাজ সরকারি হাসপাতালের সামনে দাড়িয়ে থাকা এবং ব্যক্তি বুঝে রোগীদের টার্গেট করা।
আহসান আহমেদ রোডে লাইফ কেয়ার ডায়গনিস্টিক সেন্টারের মার্কেটিং রাজ হোসেন বলেন, বর্তমান করোনার ভয়ে তেমন ভালো কোন ডাক্তার প্রাইভেট হাসপাতাল বা ডায়গনিস্টিক সেন্টরে আসছেন না। তাই ইনকাম অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু ছোট ছোট ডায়গনিস্টিক সেন্টারগুলোর ব্যবসা কমেনি। সদর হাসপাতারে অনেক ডাক্তার আসে না। তাই অসুস্থ হলেও রোগীরা সেবা পেতে বিলম্ব হচ্ছে। বাইরে প্রাইভেট হাসপাতালে এক প্রকার বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, আমার আওতাধীন কোন হাসপাতালের মধ্যে মার্কেটিং এর লোক বলেন আর দালাল বলেন আমি কাউকে প্রশ্রয় দিব না। আমি হাসপাতালগুলো দালাল মুক্ত চাই। এজন্য প্রয়োজোনে র‌্যাব পুলিশের সহোযোগীতা নিব। তাছাড়া বেশ কয়েকট অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল ডায়গনিস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব।
মানহীন সুরক্ষা সামগ্রী করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে পারছে না :  মানহীন সুরক্ষা সামগ্রী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম উৎস হিসেবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নিম্ন মানের এসব মাস্ক, হ্যান্ডগøাভস, স্যানিটাইজার, পিপিই ব্যবহার করে সুফল পাচ্ছে না মানুষ। যার কারণে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এসব পণ্য এখন পাওয়া যাচ্ছে পানের দোকান, মুদি দোকান, ভ্রাম্যমাণ ভ্যান এবং ইজিবাইকেও। সংশ্লিষ্টদের দাবি এসব পণ্যের মেয়াদ, উৎপাদন এবং বিপনন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ বাজারজাত না করলে তা ব্যবহারে মানুষের সুফল বয়ে আনবে না।
সরেজমিন দেখা গেছে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ব্যবসা। আর চাহিদা বেড়েছে মাস্ক ও সুরক্ষা সামগ্রীর। জীবন বাঁচাতে মানুষ আসল-নকল যাচাই করেই কেনার চেষ্টা করছে। বাজারে এত বেশি নকল পণ্য সরবরাহ হয়েছে যে নকলটাই আসল ভেবে কিনছেন ক্রেতারা।
ডাক্তারদের সূত্র জানিয়েছে, কেএন-৯৫ মাস্ক যেকোন ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত রোধ করতে পারে। ৫ লেয়ার সমৃদ্ধ এ মাস্ক চীন, আমেরিকাসহ উন্নত দেশেই তৈরি হয়ে থাকে। তবে করোনার এই সময়ে সেই মাস্ক এখন পাওয়া দুষ্কর। বাজার হরহামেশা ৯৫ নাম ব্যবহার করে মাস্ক বিক্রি হচ্ছে। মানুষও দেদারকে কিনে ব্যবহার করছে। স্বাভাবিক সময়ে তিন লেয়ারের মানসম্মত সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি হতো ৫ টাকায়। সেই মাস্ক এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরিবর্তে একই ধরনের মাস্ক বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ২০ টাকায়। একই অবস্থা স্যানিটাইজারের ক্ষেত্রেও। বোতলে স্পিরিটের সাথে রং মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে স্যানিটাইজার হিসেবে।
মনিরুল নামে এক ক্রেতা বলেন, আসল নকল তো আমার চেনার কথা নয়। ফার্মেসী ও মুদি দোকানে গিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার চাচ্ছি তারা দিচ্ছে। যা দিচ্ছে সেটাই আসল বলেই ব্যবহার করছি। উপায় নেই।
ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে করে এসব সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি করা মনিরুল ইসলাম বলেন, সব ব্যবসা বন্ধ। সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। তাই কিছু করে সংসার চালানোর ব্যবস্থা করছি। তার মত ব্যবসায়ীরা নকল (কপি) কেএন-৯৫, এন-৯৫ মাস্ক বিক্রি করায় চরম হুমকির মুখে পড়ছে জন-জীবন। এসব পণ্য যারা উৎপাদন করছে তারা নিজেদের লাভের চিন্তা করইে করছে। অথচ ঝুঁকি বাড়ছে ছাড়া কমছে না।
খুলনার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইউসুফ আলী জানান, মাস্ক না পরার জন্য চার মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। রাস্তা থেকে মাস্ক কিনবেন না। স¤প্রতি নগরীর হেরাজ মার্কেটে স্যানিটাইজারের দাম বেশি নেয়ার অভিযোগে অভিযান চালানো হয়। এরপরও যততত্র মাস্ক, স্যানিটাইজার বিক্রি না করার বিষয়ে অভিযান চালানো হবে।
যত্রতত্র এসব মানহীন পণ্যের ভিড়ে আসল পন্য যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। কয়েকটি ফার্মেসি ছাড়া বেশির ভাগ জায়গায় বিক্রি হওয়া সুরক্ষা সামগ্রী খুবই নিম্নমানের, যা ব্যবহারে সুরক্ষার থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি।
খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, মানুষের মধ্যে সচেতনা বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা আগে মাস্ক পরতো না তারাও এখন পরছে। মাস্ক এবং স্যানিটাইজার ব্যবহারে ধুলি জীবানুসহ বিভিন্ন রোগের উপসর্গ মানবদেহে কম প্রবেশ করে। তবে এসব পণ্য যদি মানহীন হয় তবে অর্থের ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে জীবানুও মানবদেহে প্রবেশ করছে।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, আমরা মানুষকে সচেতন করছি। অন্যদিকে মানহীন এসব পণ্যের বিষয়ে আমরা প্রশাসনের সাথে কথা বলেছি। তারা অভিযান চলমান রেখেছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ