স্বাধীনতার মাস

স্টাফ রিপোর্টার : আজ টালমাটাল মার্চের ২০ তারিখ শুক্রবার। ঊনিশশ একাত্তর সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেনারেল ইয়াহিয়া খান চতুর্থ দিনের মতো বৈঠকে বসেন। শুধুই কালক্ষেপণ, এদিনও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। এদিনও বঙ্গবন্ধুর সাথে তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান ও ড. কামাল হোসেন ছিলেন। ইয়াহিয়ার সাথে ছিলেন বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবুল হামিদ খান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা, মেজর জেনারেল ওমর, মেজর জেনারেল সাদিম হোসেন রাজা, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী প্রমুখ। আগের দিনের বৈঠকে শেখ মুজিব তার চার দফা দাবি প্রশ্নে যে অনড়, অটল মনোভাব ব্যক্ত করে ছিলেন, তা থেকে তাকে বিচ্যুত করা যায় কি-না এদিনের বৈঠকের উদ্দেশ্যটা তাই ছিলো। সোয়া দু’ঘণ্টা বৈঠক চলেছিলো। বৈঠকের এক পর্যায়ে বিচারপতি কর্নেলিয়াস বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ধরুন আপনার দাবি মতো জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো, তা না হয় চলতে পারে। কিন্তু সামরিক আইন যদি সংবিধান জারির আগে প্রত্যাহার করা হয় তবে দেশ কোন আইনে চলবে? বঙ্গবন্ধু জবাব দিলেন, দেশের প্রশাসনসহ সবকিছু তখন নিয়ন্ত্রণ করবে জাতীয় পরিষদ আর আমাদের সংবিধানের খসড়া তো তৈরিই আছে। বঙ্গবন্ধুর এই জবাবে জেনারেল ইয়াহিয়া নির্লিপ্ত থাকলেও অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তারা ভ্রূ কুঁচকালেন। প্রায় একশ’ মিনিট আলোচনা শেষে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে সোজা তার ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে চলে যান। সেখানে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে তাকে কখনো বেশ উৎফুল্ল কখনো বা বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো। তিনি জানালেন, আলোচনার কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। এর বেশি আর বলবো না। এদিন দুপুরের খাবার গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথাবার্তা বলে কাটালেন। একপর্যায়ে তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে চলে যান। এর ঘণ্টা দুয়েক পরে উভয়েই বেরিয়ে আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শেখ মুজিব একান্তে আলোচনার জন্য মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে দেখা করতে টাঙ্গাইলের সন্তোষের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। সেখানে রাতের খাবার সেরে রাত প্রায় সাড়ে ১০টায় ঢাকা ফিরলেন তিনি। এদিন গাজীপুরের জয়দেবপুরে শ্রমিক-জনতার বিক্ষোভ দমাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ম্যারাথন কারফিউ জারি করেছিলো। রাত সাড়ে ১১টায় তা প্রত্যাহার করা হয়। জয়দেবপুরের ঘটনার প্রতিবাদে নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য শেখ মোহাম্মদ মোবারক হোসেন তাকে দেয়া ‘তখমা-ই-পাকিস্তান' খেতাব বর্জন করেন। ঢাকায় তুমুল চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় যখন ছাত্র ইউনিয়নের সুসজ্জিত গণবাহিনী রাজপথে বন্দুক উঁচিয়ে সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজে অংশ নেয়। প্রায় পাঁচশ’ সদস্য-সদস্যা এই মার্চ পাস্টে শামিল হন। হাজার হাজার উৎসুক মানুষ রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে বিপুল করতালি, হর্ষধ্বনি ও শ্লোগানে শ্লোগানে তাদের স্বাগত জানায়। বিবিসির এক সংবাদ ভাষ্যে সম্প্রতি দেয়া ভুট্টোর প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করা হয়। ঐ ভাষ্যে এ মর্মে আভাস দেয়া হয় যে, আওয়ামী লীগ, দৌলতানার কাউন্সিল মুসিলম লীগ, ন্যাপ (ওয়ালী) ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা খুবই বেশি। বিবিসির এই ভাষ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বর্তমান অবস্থাকে ঢেঁকিকলে আটক স্থিরভাবে অবস্থানের চেষ্টায় গলদঘর্ম ব্যক্তির সাথে তুলনা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সাথে এদিন প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠকের পর ‘পাকিস্তানের প্রেসারে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু' হিসেবে পরিচিত পাঞ্জাবের মিয়াজী মমতাজ দৌলতানা ও শওকত হায়াত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঢাকায় যতক্ষণ সম্ভব আলোচনা চলবে। কাউন্সিল লীগ নেতা দওলতানা বলেন, মুজিব আমার ভাইয়ের মতো। করাচীতে ভুট্টো বলেন, তিনি প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য নতুন করে আশ্বাস পেয়েছেন। তিনি পরদিন ঢাকা পৌঁছবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকে বসেন। প্রাক্তন নৌবাহিনী সদস্যরা স্বাধীনতার দাবিতে রাজপথে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এদিন রাত ৯টায় পুরান ঢাকার র্যাংকিং স্ট্রীটে দৈনিক সংগ্রাম অফিসে হাতবোমা নিক্ষেপ করা হয়।