নন্দিত বিজ্ঞানী প্রফেসর ইমেরিটাস ড. জামাল নজরুল ইসলাম

মুহাম্মদ এহছানুল হক মিলন:
এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার এসেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে, ভারতের শ্রেষ্ঠ দশজন বিজ্ঞানীর চারজনই হলো আমাদের মাটি থেকে। সুতরাং হীনম্মন্যতায় ভোগার কোন কারণ নেই। যে দেশ পৃথিবীর এক সহস্রাংশ ভূখন্ডে চব্বিশ সহস্রাংশ মানুষের অন্ন জোগায়, সে দেশে আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকা ঠিক নয়।
উপর্যুক্ত কথাগুলো পড়ে আমিখুব গর্ববোধ করছিলাম-বাংলার চার প্রথিতযশা বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু’র কথা মনে করে। এঁদেরই যোগ্য উত্তরসূরী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম।
বিজ্ঞানীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এক বক্তৃতায় আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, এই সৃষ্টির সকল কিছুকে বুঝতে হবে, জানতে হবে এবং পরিপূর্ণভাবে তাকে উপভোগ করতে হবে। এই জন্যই শ্রদ্ধা হয় এযুগের বৈজ্ঞানিকদের প্রতি। তাঁরা চেয়েছেন সৃষ্টি রহস্য আবিষ্কার করতে। কী দুর্জয় তাদের প্রতিজ্ঞা ও আত্মশক্তিতে বিশ্বাস। সকল বিশ্বকে সকল সৃষ্টিকে জানব, বুঝব ও উপলব্ধি করব-এই আত্ম বিশ্বাস আমাদের তরুণদের জীবনে রূপায়িত হোক। ... ...
এই বৃহৎকে বুঝবার সাধনাই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা।
অধ্যাপক ইসলাম সারা জীবন এই বৃহৎকে বুঝবার সাধনাই করেগেছেন। গবেষণা করেছেন আমাদের অপূর্ব মহাবিশ্ব নিয়ে। আমরা এখন তাঁর স্মরণে কিছুটা সময়ের জন্য মহাবিশ্ব এবং মহাবিশ্বের দার্শনিক ভাবনার জগৎ থেকে ঘুরে আসি। দেখি কে কি ভাবছেন!
দর্শনের উৎস ও সূচনা সম্পর্কে এ উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ ও বড় মাপের রাজনীতিবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ পারস্য দেশের একজন কবির উদ্ধৃতি দিয়ে সুন্দর একটি বক্তব্য রেখেছিলেন। বক্তব্যটি এ রকম,
বিশ্বের ইতিহাস একটি পান্ডুলিপির মত। যেটার প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা হারিয়ে গেছে। দর্শন হ’ল সেই হারিয়ে যাওয়া দুটো পৃষ্ঠার সন্ধান।
আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, রহস্যই সর্বাতীত সৌন্দর্যের প্রতীক, এই অনুভূতির সাথে যার পরিচয় ঘটেনি, অনন্ত রহস্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও যার মন অপার বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়নি-ধরে নিতে হবে তার মৃত্যু হয়েছে, মন আর চোখ দুয়েরই।
আসলে বৃহত্তের কাছে মানব মন সবসময়ই কেন জানি পরাস্ত হয়। কিন্তু একই সাথে কার্য কারণ সম্পর্কও মানুষ ঠিক খুঁজে বের করে। এটি ক্রিটিকাল থিঙ্কিঙের ফল। রহস্য (Mystery) ও ক্রিটিকাল চিন্তা, এ দু’য়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ প্রশ্ন করেছে এবং সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছে এই সেদিন; জ্ঞান সমুদ্রের বালুকাবেলায়-দীপ্ত পদচারণের মধ্য দিয়ে। মেধা খাঁটিয়ে, চিন্তাÑবুদ্ধিÑজ্ঞান দিয়ে। এ প্রসঙ্গে একটি দার্শনিক চিন্তা প্রসূত প্রশ্ন হল: The Universe is either a chaos or a cosmos। আসলে এটি একটি ভ্রমাত্মক ধারনা; ইংরেজিতে যাকে Fallacy’ বলা হয়। কুরআন শরীফের একটি আয়াতে বলা হয়েছে,
তুমি ... ... ... সৃষ্টিতে কোন ত্রুটি দেখতে পাবেনা। তুমি আবার দৃষ্টি নিক্ষেপ কর, তোমার দৃষ্টি তোমারই কাছে ফিরে আসবে ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে।
আর কার্ল সাগান এর সাড়া জাগানো বই ‘কসমস’ (cosmos) এ বলেছেন, বিশ্বব্রক্ষান্ত নিয়ে সামান্যতম চিন্তাও আমাদের বিচলিত করে - মেরুদন্ডে শিহরণ জাগায়, হঠাৎ চুপ করে যেতে ইচ্ছে হয়। এমন একটা ক্ষীণ অনুভূতি আসে যেন বহু উঁচু থেকে পড়ার একটা দূরবর্তী স্মৃতি-বোঝা যায় যে আমরা গভীরতম রহস্যের দিকে এগিয়ে চলছি।
বন্ধুরা! আমরাও সেই সাথে বক্তব্যের গভীরতম রহস্যের দিকে এগিয়ে চলছি।
খৃষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর গ্রীক কবি হোসিওড লিখিত বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ ‘থিওগোনী’তে প্রাচীন গ্রীসের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। এর বর্ণনানুসারে জানা যায় প্রাচীন গ্রীকরা বিশ্বাস করত সৃষ্টির প্রথম অবস্থা ছিল ‘chaos’ (বিশৃঙ্খলা)। এটি সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হওয়ার পর chaos নাইট নামক দেবীর সাথে মিলিত হয়। অন্যান্য দেবতা ও মানুষ আসলে এদেরই সন্তান-সন্ততি। বিশৃঙ্খলা বা chaos থেকে তৈরী বিশ্ব ছিল সেই গ্রীক বিশ্বাসের অনুসারী যে অবাধ্য প্রকৃতি খেয়ালী দেবতাদের মর্জিমাফিক চলে।
খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে আয়োনিয়ায় মানব সভ্যতার প্রথম জ্ঞানের স্ফুরণ ঘটল। দেখা গেল প্রকৃতিকে জানা সম্ভব। প্রকৃতির অন্তরালে রয়েছে নিয়মতান্ত্রিকতার এক সুদৃঢ় ভিত্তি। এমন কিছু বিধি আছে যা প্রকৃতিও অনুসরণ করতে বাধ্য। বিশ্বের এই নিয়মতান্ত্রিক আচরণকে বলা হল ‘Cosmos’। মহাবিস্ফোরণের প্রথম কয়েক মুহূর্তে সেই চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা (chaos) সময়ের বিবর্তনে বর্তমানে সুশৃঙ্খল বিশ্বব্রহ্মান্ড (cosmos) পরিণত হয়েছে। কাজেই ব্রহ্মান্ড এককভাবে ‘chaose’ ও নয় ‘cosmos’ ও নয় দুয়ে মিলে এক অনন্য সত্তা; যাকে আমরা singularity বলে থাকি।
chaos থেকে cosmos বিশ্বের এই বিবর্তন একই সাথে অন্ধকার থেকে যুক্তির আলোয় জ্ঞানের উত্তরণও বটে। প্রায় ছয় হাজার বছর আগে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে আমরা পেয়েছি পৃথিবী কেন্দ্রীক বিশ্বচিত্রকেই বলা হয় সৌর জগৎ (solar system)।
এভাবে আজ আমরা সৌরজগৎ ছেড়ে তারকা জগৎ তারকা জগৎ ছেড়ে বিশ্ব জগৎ নিয়ে ভাবছি। যেমনটি ভেবেছিলেন আমাদের অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক হারুন অর রশিদ স্যারের কথা বলতে হয়। তিনি বলেছেন, অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯-১৬মার্চ ২০১৩) ছোট দেশের বড় বিজ্ঞানী’ হিসেবে আমাদের দেশের মানুষের নিকট সমধিক পরিচিত। তিনি খুব উঁচুমানের একজন গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী। যাঁকে ‘বাংলার হকিং’ বললে ও খুব একটা ভুল হবে না। মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি সংক্রান্ত মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি বিশেষভাবে খ্যাত। এছাড়াও তিনি বেশকিছু গাণিতিক সূত্র ও জটিল গাণিতিক তত্ত্বের সহজ পন্থার উদ্ভাবকও বটে। ক্যামব্রিজের সোয়ালাখ টাকার বেতনের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীকালে সেখানেই গড়ে তোলেন বিশ্বমানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। উক্ত প্রতিষ্ঠানে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীসহ বিখ্যাত ব্যক্তিদের আগমন ঘটেছে। তাঁরা গবেষণা কেন্দ্রটি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন এবং কেন্দ্রের শিক্ষক, গবেষকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিজ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেন।
স্বাধীনতার পরবর্তী দেশে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে গবেষণা কেন্দ্রটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম শুধু বিশুদ্ধ বিজ্ঞান গবেষণায় ব্যাপৃত ছিলেন না, মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বিজ্ঞান গবেষণায় ব্যস্ত থেকেও তিনি সারাক্ষণ সাধারণ মানুষের কথাই ভেবেছেন। এমন মানুষ কালেভদ্রে দু’একজন জন্মায়। অধ্যাপক ইসলাম ছিলেন এক বড় হৃদয়ের মানুষ, যেখানে সকলেই অনায়াসে আশ্রয় পেতেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে তাঁর মতো একজন বড় হৃদয়ের মানুষ বিদেশের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এমনকি নোবেল প্রাপ্তির সকল সম্ভাবনাকে বিসর্জন দিয়ে এক কাপড়ে দেশে ফিরে এসেছেন। ধন্য করেছেন এ বঙ্গ জননীকে।
অধ্যাপক ইসলাম সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁরই এক প্রিয় বন্ধু বিখ্যাত আমেরিকান বিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন বলেছেন, বিশ্বের অনেক লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করে তিনি তাঁর জন্মস্থান চট্টগ্রামে থাকতে পেরেছেন এবং বিজ্ঞানচর্চাকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
হিমালয়ের মতো বিপুলচিত্ত মানুষটির জীবনাদর্শ আমরা যতই আলোচনা করি ততই বিস্ময়াপন্ন হতে হয়। পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলব, ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহান।’
তিনি একাধারে সেতার শিল্পী, কন্ঠশিল্পী সর্বোপরি ভালো পিয়ানো বাজাতে পারতেন। তিনি সংস্কৃত জানতেন, ভালোবাসতেন গজল। বাহাদুর শাহ জাফরের গজল তাঁর ছিল প্রিয়। তিনি প্রায় সময় গেয়ে শোনাতেন,
উমর-ই-দরাজ মাঙ্গ কার লায়ে, থে চারদিন
দো আরজু মে কাট গায়ে, দো ইন্তেজার মে।
অর্থাৎ (আমি চারদিনের আয়ু খুঁজে নিয়ে এসেছিলাম।
দুদিন কেটে গেল আশায়, আর দুদিন অপেক্ষায়)।
বন্ধুর ছোট মেয়েটিকে প্রতি শুক্রবার পিয়ানো বাজিয়ে ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ’ এই গানটি বাজিয়ে শোনাতেন।
১৯৬৫ সালে ক্যামব্রিজে ওস্তাদ বেলায়েত খানের একটি সেতার পরিবেশনার আয়োজন করার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। সেই সময় তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ছোট বেলা থেকে অধ্যাপক ইসলাম গান শোনার পাশাপাশি ছবি আঁকতেন। বিয়ের পর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বিশেষ করে রাতের খাবার খাওয়ার পর গান গাইতে বসতেন। আন্দাজ ছবির, ‘তু কাহে আগার জীবনভর ম্যায় গীত শুনাতা যায়ু’ গানটি মাঝে মাঝে গাইতেন। এর সঙ্গে দুজনে মিলে গাইতেন রবীন্দ্রনাথের ‘আমার মাথানত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে’ গানটি।
তিনি দীর্ঘদিন নিষ্ঠার সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিয়জিত থেকে গণিত সাধনার সাথে সংগীত সাধনার মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাই তো তিনি লিখেছেন, ... ... ... That beauty which a mathematician sees in a mathematical theorem. (তেমন সৌন্দর্য যা একজন গণিতবিদ একটি গাণিতিক উপপাদ্যে দেখেন।)
আরেক জায়গায় অধ্যাপক ইসলাম পদার্থ বিজ্ঞানী ল্যান্ডাও’র উদাহরণ টেনে বলেছেন, লেভ দাভিদোভিচ ল্যান্ডাও ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সোভিয়েত পদার্থবিদ। তিনি কঠোর পরিশ্রম করতেন বছরের পর বছর। তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি এত পরিশ্রম কী করে করেন। তিনি হেসে বললেন, ‘পদার্থবিদ্যার একটি সমস্যা সমাধানে চিন্তা করা এবং সেটাকে গাণিতিক রূপ দেওয়া এর চেয়ে বড় আনন্দ তাঁর জানা নেই।’
ল্যান্ডাত্ত এর পর্যায়ে পৌছাতে হলে প্রয়োজন হয় দীর্ঘদিনের সাধনা। সংগীতেও যাঁরা উচ্চ পর্যায়ে যেতে পেরেছেন, তাঁরাও আনন্দের সাথে পরিশ্রম করতে পারেন এবং সেটার জন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘদিনের এমনকি আজীবন সাধনা।