জীবন যুদ্ধে হার না মানা আসমার গল্প

খুলনা অফিস : জন্মের পর থেকে আমৃত্যু কেউ সুখে বসবাস করেন আবার কাউকে সারা জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। তাদের জীবনের সংগ্রাম যেন শেষ হয় না। এমনই এক সংগ্রামী নারী খুলনার আসমা খাতুন।
৫০ বছর বয়সী আসমা থাকেন খুলনা শহরের উপকণ্ঠে বটিয়াঘাটার হোগলা ডাঙ্গা এলাকায়। ১০ বছর আগে স্বামী আব্দুস সালাম মারা যান। তার দু’টি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। এখন তিনি একা। কিন্তু পেট তো চালাতে হবে। অভাবের তাড়নায় জীবনের তাগিদে প্লাস্টিক সামগ্রী মাথায় করে নিয়ে শহর ও গ্রামের আনাচে কানাচে বোরকা পরে ছুটে বেড়ান বিক্রির জন্য।
আজকাল সবক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ সমানভাবে থাকলেও ফেরিওয়ালার কাজে সাধারণত তাদের দেখা যায় না। কিন্তু খুলনার আসমা মেয়ে জামাইদের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে এ কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন।
প্রথমে কিছু লোক তার এ পেশাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। অনেকেই হাসি-ঠাট্টা ও সমালোচনা করতো। আবার কিছু লোক তাকে সহযোগিতাও করেছেন।
আসমা খাতুন জানান, জন্ম হয় বাবার অভাবের সংসারে। বিয়েও হয়েছিল এক দিনমজুরের সঙ্গে। সেখানেও অভাব। সংসারও বেশিদিন স্থায়ী হলো না। ১০ বছর আগে স্বামী মারা যায় দুই মেয়ে রেখে। অনেক কষ্টে তাদের বিয়ে দেয়া হয়েছে।
নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, স্বামীরে আল্লায় নিয়ে গেছে। তার মরার পরে চোহে মুহে অন্ধকার নেমে আসে। কোনো একটা কাজ জোগারে মরিয়া হইয়ে উঠি। মানসের বাসায় কাম করি। দুই মেয়ে অল্প বয়সে পরেরে দিয়ে দিছি। সামান্য কিছু টাহা জোগাইয়ে ব্যবসায় নামছি। জামাইগে বোজা অইতি চাই না। হাত পায় এহনও বল আছে। তাই তো ফেরি কইরা খাই।
কেমন বেচা কেনা হয় জানতে চাইলে আসমা বলেন, কোনোদিন ভালো বেচাকেনা অয়, কোনোদিন আবার অয় না। বেচাকেনা ভালো হলে দুপুরে খেতে পারি হোটেলে। তা না হলে না খেয়ে থাকতে হয়। মাঝে মধ্যে দু’একজন খেতে বলে। প্লাস্টিকের জিনিস বেচি। এগুলা সংসারে কামে লাগে। কিন্তু বেচাকেনা খুব কম অয়। কোনোদিন হয়তো ২০০-৩০০ টাহা বেচাকেনা অয়, আবার মোটেও অয় না। আমি তো বেশি মাল নিতে পারি না। যেটুকু পারি সেই টুকু নেই। অনেকে খোঁজে নামি দামি প্লাস্টিকের জিনিস। সেই গুলাতে লাভ কম অয়। আমার অত টাহা নেই যে একটা দোহান দেব। যা ইনকাম অয় তা দিয়ে কষ্ট কইরে চলতে অয়। নিজের বাড়ি নাই জমি নাই। পরের জায়গায় থাহি কোনো রকম ঘর তুইলে। ভালো করে ঘর উঠাইতেও পারি না, টাহা নাই বলে।
জীবন যুদ্ধে হার না মানা এ নারীর মতে, দেশের সব নারীকে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। লোকে কী বললো তার দিকে না তাকিয়ে কাজ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তার কর্মজীবনেও প্রথম প্রথম কাজ করতে তিনি অস্বস্তি বোধ করতেন। ভাবতেন লোকজন কে কী বলবে। এখন তার কাছে সেটা আর কোনো ব্যাপার বলে মনে হয় না।
বটিয়াঘাটার হোগলা ডাঙ্গায় বসবাসের আগে আসমা খাতুন প্রায় দীর্ঘ দুই যুগ মহানগরীর বসুপাড়া এলাকায় বসবাস করতেন।
ওই এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী সুমন শাহনেওয়াজ বলেন, আসমা খাতুনকে আমরা ছোট বেলা থেকে দেখেছি। অবিরাম জীবন যুদ্ধে হার না মানা এক নারী তিনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে প্রতিনিয়ত বেঁচে আছেন। এক সময় তিনি আমাদের বাসায় কাজ করতেন। আমরা তাকে আসমা খালা বলে ডাকতাম। এখন নিজেই প্লাস্টিক সামগ্রী ফেরি করেন।
তিনি আরও বলেন, কোনো কাজকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। নারীরা অনেক সময় চক্ষুলজ্জার ভয়ে ঘর থেকে বের হতে চান না। কিন্তু আসমা খালা সেসব কথায় কান নিয়ে নিজেই নিজের মতো করে কাজ করে চলেছেন।