রাহুল গান্ধীর পদত্যাগ প্রসঙ্গে
ভারতের সবচেয়ে পুরনো এবং দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন রাহুল গান্ধী। ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পরপর, গত ২৫ মে তিনি প্রথমবারের মতো পদত্যাগপত্র পেশ করেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি তা গ্রহণ করেনি। রাহুল গান্ধীকে বরং পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেয়ার এবং সভাপতির পদে বহাল থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যসহ দলের সিনিয়র নেতারা শুধু নন, কংগ্রেস শাসিত পাঁচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও এই অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন।
অন্যদিকে রাহুল গান্ধী তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার যেমন করেননি, তেমনি দলের পক্ষে নেতৃত্বের ভূমিকা পালনের প্রস্তাবেও সম্মত হননি। সবশেষে গত ৩ জুলাই এক টুইটার বার্তার মাধ্যমে তিনি পদত্যাগ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, টুইটার হ্যান্ডেল থেকে ‘কংগ্রেস সভাপতি’ শব্দ দুটি তুলে নেয়ার মাধ্যমেও স্পষ্ট করেছেন, তার পদত্যাগের ব্যাপারে কারো মনে কোনো সংশয় থাকা উচিত নয়।
টুইটার বার্তায় রাহুল গান্ধী যে বক্তব্য রেখেছেন তাকেও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির জন্য নিজেকে সম্পূর্ণরূপে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করে এই বার্তায় রাহুল গান্ধী বলেছেন, কংগ্রেসকে আপাদমস্তক পাল্টাতে এবং নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে। বিজেপি সরকার যেভাবে মানুষের কণ্ঠরোধ করে চলেছে তার বিরুদ্ধে কংগ্রেসকেই লড়াই ও আন্দোলন করতে হবে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে তথা সভাপতির পদে তার মা সোনিয়া এবং বোন প্রিয়াংকা গান্ধীসহ গান্ধী পরিবারের কাউকে নির্বাচিত না করার আহবান জানিয়ে রাহুল গান্ধী আরো বলেছেন, এটা একটি অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ক্ষমতাধররাই সব সময় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবেন। ক্ষমতার এই লোভ এবং ইচ্ছাকে ত্যাগ না করতে পারলে কংগ্রেসের পক্ষে কখনোই প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে না।
ভবিষ্যতে ভারতের সম্ভাব্য রাজনীতি প্রসঙ্গেও রাহুল গান্ধী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা পাওয়ার পর বিজেপি সারা ভারতে হিংসা ছড়িয়ে দেবে। দেশকে নিয়ে যাবে এমন এক ভয়ংকর ও অভাবনীয় অবস্থার মধ্যে, যার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারবো না। দলিত ও উপজাতিসহ সংখ্যালঘুরা বিজেপির ছড়িয়ে দেয়া সে হিংসার শিকার হবে। বিজেপি যাতে তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করতে পারে সে লক্ষ্যে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে কংগ্রেসকে।
রাহুল গান্ধীর শেষ কথাগুলোও গণমাধ্যমে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। বক্তব্যের এই পর্যায়ে তিনি লিখেছেন, তার সংগ্রাম ছিল প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং আরএসএস-এর বিরুদ্ধে। কারণ, তিনি দেশকে ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে। কিন্তু মোদি এবং আরএসএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে এক সময় তিনি সম্পূর্ণ একলা হয়ে পড়েছিলেন। এজন্য গর্ববোধ করলেও কংগ্রেসের মতো বিরাট দলের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা নেই বলেই তাকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
শুধু পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কারণে নয়, টুইট বার্তার বক্তব্যের কারণেও রাহুল গান্ধীকে নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। এর কারণ, দীর্ঘ ১৯ বছর কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সোনিয়া গান্ধী যখন তার এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীর একমাত্র ছেলে রাহুল গান্ধীকে দলের সভাপতি পদে নিযুক্তি দিয়েছিলেন তখন থেকেই তার সাফল্যের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রবীণ বাঙালি নেতা প্রণব মুখার্জিকে বিদায় করার গোপন উদ্দেশ্য থেকে সোনিয়া গান্ধী একদিকে প্রণবের অধীনে ব্যাংকে চাকরি করা ড. মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন, অন্যদিকে মাত্র ৪৮ বছর বয়সী রাহুলকে করেছিলেন কংগ্রেসের সভাপতি। তখনই বলা হয়েছিল, গান্ধী পরিবারের হাতে ক্ষমতা ধরে রাখার উদ্দেশ্য থেকে সভাপতি বানানো হলেও ১৩৩ বছরের দল কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা রাহুলের নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সে অনুমানই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, অনিচ্ছুক ও রাজনীতিতে অপরিপক্ব হলেও ১৯৯৮ সালে সভাপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার পর সোনিয়া গান্ধী কিন্তু সাফল্যের প্রমাণ রেখেছিলেন। সে সময় কংগ্রেস চারটি মাত্র ক্ষুদ্র ও কম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল। বিজেপির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স- এনডিএ জোটের প্রচন্ড দাপটের বিরুদ্ধে রীতিমতো লড়াই করেছিলেন সোনিয়া গান্ধী। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সোনিয়ার নেতৃত্বে কংগ্রেস বিরাট বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় গিয়েছিল। ২০০৯ সালের নির্বাচনেও কংগ্রেসের নেতৃত্বে গঠিত ইউনাইটেড পিপ্লস অ্যালায়েন্স বা ইউপিএ জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছিল। ৫৪৩ আসনের লোকসভায় কংগ্রেস একাই জিতেছিল ২০৬টি আসনে। সেবার সোনিয়া গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর দাবি উঠেছিল জোরেশোরে। কিন্তু বিজেপির কঠোর বিরোধিতার মুখে ‘অন্তরাত্মা’র দোহাই দিয়ে সোনিয়া গান্ধী পিছু হঠেছিলেন।
প্রণব মুখার্জিকে সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে ড. মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর পাশাপাশি এ সময় থেকেই সোনিয়া গান্ধী তার ছেলে রাহুল গান্ধীকে কংগ্রেসের সভাপতি পদে নিযুক্তি দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। ২০১৭ সালে এমন এক সময়ে রাহুলকে সভাপতি করা হয়েছিল যখন কংগ্রেসের ব্যর্থতার কারণে সারা ভারতে ‘মোদি জোয়ার’ বইতে শুরু করেছিল। তার আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি একাই জিতেছিল ২৮২টি আসনে। অন্যদিকে কংগ্রেস এমনকি প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানেও যেতে পারেনি। কেন্দ্রে শুধু নয়, রাজ্যগুলোতেও কংগ্রেস ক্ষমতায় আসতে পারেনি। বেশ কিছু রাজ্যে দলটি ক্ষমতাও হারিয়েছিল।
অমন এক প্রতিকূল অবস্থায় দরকার যেখানে ছিল প্রণব মুখার্জির মতো প্রবীণ কোনো নেতাকে সভাপতি বানানো সোনিয়া গান্ধী সেখানে তার নিজের অপরিপক্ব ছেলেকে প্রধান নেতার আসনে বসিয়েছিলেন। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে শুধু নয়, সিদ্ধান্তটি ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনেও ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল গান্ধী পরিবারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বিরুদ্ধে। ওদিকে রাহুল গান্ধী নিজেও বিশেষ করে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে চরম ব্যর্থতার নজীর স্থাপন করেছেন। সবশেষে সুন্দরী বোন প্রিয়াংকা গান্ধীকে নেতৃত্বে এনেও তিনি কংগ্রেসকে সাফল্যের মুখ দেখাতে পারেননি। বিগত নির্বাচনে ২০১৪ সালের চাইতে লোকসভায় মাত্র চারটি আসন বেশি পেয়েছে কংগ্রেস।
তখনই রাহুল গান্ধীকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার দাবি উঠেছিল। একই কারণে বলা হচ্ছে, টুইট বার্তায় বিনয়ের প্রকাশ ঘটালেও রাহুল আসলে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেননি। তিনি বরং কংগ্রেসের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মনের কথা বুঝতে পেরেছেন বলেই পদত্যাগ করার সম্মানজনক পথ বেছে নিয়েছেন।
রাহুল গান্ধীকে সত্যিই সরে যেতে হবে কি না এবং তিনি নিজেও লোভ সংবরণ করতে পারবেন কি নাÑ এ ধরনের প্রশ্নের অনুমান নির্ভর উত্তর খোঁজার পরিবর্তে তার টুইট বার্তার মূলকথাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে আমরা মনে করি। কারণ, তিনি বলেছেন, দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি সারা ভারতে হিংসা ছড়িয়ে দেবেÑ যার শিকার হবে দলিত, উপজাতি এবং সংখ্যালঘু মুসলিমরা। রাহুলের এই আশংকা যে মিথ্যা নয় তার প্রমাণ এরই মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা আশা করতে চাই, কংগ্রেসের সভাপতির পদ নিয়ে মাতামাতি করার পরিবর্তে দলনির্বিশেষে ভারতীয়রা বিজেপির ছড়িয়ে দেয়া হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠবে।