ক্রিকেটে কূটিল রাজনীতি
ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠানরত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর থেকে বাংলাদেশের বিদায় নিশ্চিত হয়েছে গত ২ জুলাই। সেদিনের খেলায় ভারতের কাছে ২৮ রানে হেরেছেন এদেশের ক্রিকেট যোদ্ধারা। টসে জিতে ভারতীয়রা প্রথমে ব্যাটিং নেয় এবং পুরো ৫০ ওভার খেলে ৩১৪ রান সংগ্রহ করে। ভারতকে অবশ্য সহজে ছাড় দেননি বাংলাদেশের বোলাররা। নয়টি উইকেট ফেলেছেন তারা। অন্যদিকে ৩১৫ রানের টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে হতাশ করেছেন ব্যাটসম্যানরা। একমাত্র সাকিব আল হাসান ৫০-এর ঘর পেরিয়ে ৬৬ পর্যন্ত করতে পেরেছেন। দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকারের পাশাপাশি মুশফিকুর রহিম ও লিটন দাসসহ কোনো ব্যাটসম্যানই দর্শক-সমর্থকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন নি।
শেষদিকে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন অবশ্য আশার আলো জ্বালিয়ে তুলেছিলেন। পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও জীবনের মাত্র দ্বিতীয় খেলায় ৩৮ বলে নয়টি চারসহ ৫১ রান করেছেন তিনি। বড়কথা, ভারতীয়রা তাকে আউট করতে পারেনি। ক্রিকেটবোদ্ধারা বলেছেন, নির্ভরযোগ্য কাউকে সঙ্গী হিসেবে পেলে সাইফউদ্দিন একাই বাংলাদেশকে জিতিয়ে আনতে পারতেন। কিন্তু একের পর এক আউট হয়ে গেছেন অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যানরা। সবশেষে বোলার মুস্তাফিজুর রহমান আউট হয়েছেন আসতে না আসতেই। অথচ এই মুস্তাফিজই ভারতের পাঁচ-পাঁচটি উইকেট নিয়েছিলেন। সে একই মুস্তাফিজ বাজেভাবে আউট হয়ে যাওয়ার ফলে দুই ওভার বাকি থাকতেই বাংলাদেশকে হেরে যেতে হয়েছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসরে বাংলাদেশ যে সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল ভারতের বিরুদ্ধে মঙ্গলবারের একটি মাত্র খেলার ব্যর্থতার কারণে সে অবস্থান যথেষ্ট নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। এর কারণ শুধু পরাজয় নয়। ব্যাটিং-এরও আগে বোলিং ও ফিল্ডিং-এর উভয় ক্ষেত্রেই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন খেলোয়াড়রা। ভারতের সেঞ্চুরি হাঁকানো ব্যাটসম্যান রোাহিত শর্মার একটি সহজ ক্যাচ ছেড়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে বাজে ফিল্ডিং-এর সূচনা করেছিলেন তামিম ইকবাল। বাকি সময়টুকুতে এরই ধারাবাহিকতা বজায় থাকতে দেখা গেছে। এত খারাপ ফিল্ডিং বাংলাদেশ আর কখনো করেছে কি না সে প্রশ্ন উঠেছে দর্শক-সমর্থকদের মধ্যে। অন্যদিকে অমন অবস্থার সুযোগ নিয়েই ভারত রানের পাহাড় তৈরি করেছে। বোলিং-এর ক্ষেত্রেও একমাত্র মুস্তাফিজ ছাড়া কেউই সফলতা দেখাতে পারেননি। ব্যাটিং-এর কথা বেশি না বলাই ভালো। সব মিলিয়ে বলা যায়, ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পারফরমেন্স অত্যন্ত খারাপ হয়েছে। যোগ্যতর দল হিসেবেই জিতে গেছে ভারত।
ক্রিকেটবোদ্ধারা অবশ্য অন্য কিছু কারণেরও উল্লেখ করেছেন। এরকম একটি প্রধান কারণ হিসেবে ভারতের কূটিল রাজনীতির কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী জয় এবং অর্জিত পয়েন্টের ভিত্তিতে শীর্ষ চার দলের অবস্থানে উঠে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। ভারত ও ইংল্যান্ডের ম্যাচ পর্যন্ত অবস্থা এমন ছিল যে, হারলে ইংল্যান্ড যেমন পিছিয়ে পড়বে তেমনি আবার বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আর ভারতকে যদি হারাতে পারে তাহলে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলা নিশ্চিত হবে। শুধু তা-ই নয়, কারো কারো হিসাবে ভারতকে হারানোর চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হয়ে উঠতে পারতো ভারতের কাছে ইংল্যান্ডের পরাজয়।
অন্যদিকে ঠিক এ পর্যায়ে এসেই ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কূটিল রাজনীতি করেছে। বলা হচ্ছে, ইংল্যান্ডের কাছে ইচ্ছা করেই হেরে গেছে ভারত। দেশ দুটির খেলা যারা দেখেছেন তাদের সকলেই একবাক্যে কথাটার সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। পর্যালোচনায়ও দেখা গেছে, ভারতীয়রা বোলিং এবং ফিল্ডিং-এর উভয় ক্ষেত্রেই অত্যন্ত ঢিলেঢালা ছিল। দেখে মনেই হয়নি যে, তারা ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী কোনো দলের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছে। ভারতীয়দের এই ‘ছাড়’-এর সুযোগ নিয়েই ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা ৩৩৭ রান সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল ভারতীয়দের ব্যাটিং। ৫০ ওভারের ম্যাচে সাধারণত প্রথম ১০ ওভারেই যতো বেশি সম্ভব রান ওঠানোর চেষ্টা করেন ওপেনাররা। অন্যদিকে ভারতের সাড়া জাগানো ব্যাটসম্যান রাহুল আউট হয়েছেন শূন্য রানে। পরের দু’জন রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি মিলেও ১০ ওভারে ৩০ রানের বেশি করেননি। সন্দেহও তখনই ঘনীভূত হয়েছিল। এ সন্দেহকেই দৃঢ়ভিত্তি দিয়েছিলেন বিশেষ করে এম এস ধোনি- যাকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান বলা হয়। পাঁচ-পাঁচটি উইকেট হাতে থাকতেও তিনি এমনভাবে খেলছিলেন যেন ওটা কোনো পাঁচদিনের টেস্ট ম্যাচ ছিল! বোঝাই যাচ্ছিল, অন্তরালে কোনো বিশেষ আয়োজন রয়েছে বলেই বল চলে যাওয়ারও অনেক পরে ধোনি তার ব্যাট চালাচ্ছিলেন- যেন তিনি ‘ছক্কা’ হাঁকাবেন!
অন্য সকলের তো বটেই, এম এস ধোনির খেলার এই ধরন দেখে সংশয় প্রকাশ করেছেন এমনকি খোদ ভারতের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীও। তিনি বলেছেন, পাঁচটি উইকেট হাতে থাকার পরও ধোনি কেন কচ্ছপ গতিতে খেললেন এবং ভারতীয়রা কেন ম্যাচ হেরে গেলো তা নিয়ে ভাবতে হবে। ধোনির সঙ্গে আরেক তুখোড় ব্যাটসম্যান কেদার যাদবও শেষ পাঁচ ওভারে যথেষ্ট ধীরেসুস্থেই খেলেছেন। সে ব্যাটিং দেখে মনেই হয়নি যে, তাদের মধ্যে জেতার সামান্য আগ্রহও রয়েছে! উল্লেখযোগ্য অন্যদের মধ্যে ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক নাসের হুসেইনও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। সমালোচনার ঝড় উঠেছে ভারতেও। কারণ, পাঁচটি উইকেটসহ সকল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ৩৩৭ রানের জবাবে ভারত ৩০৬ রানেই থেমে গিয়েছিল। সৌরভ গাঙ্গুলী এবং অন্য ক্রিকেটবোদ্ধারা বলেছেন, এভাবে হেরে যাওয়ার চাইতে ভারতীয়রা যদি ৩০০ রানে অল আউটও হয়ে যেতো তাহলেও আপত্তির কারণ ঘটতো না।
এখানেই এসেছে হিসাব-নিকাশ এবং কূটিল রাজনীতির পালা। বলা হচ্ছে, ইংল্যান্ডকে জিতিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ভারত আসলে একই সঙ্গে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সম্ভাবনা নষ্ট করতে চেয়েছে। কারণ, অর্জিত পয়েন্ট অনুযায়ী দুটি দেশেরই সেমি ফাইনাল পর্যন্ত ওঠার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ড জিতে যাওয়ায় এবং ভারতের কাছে পরাজিত হওয়ায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে গেছে। একথা অবশ্যই বলা দরকার, ক্রিকেটের মতো ‘ভদ্রলোকের খেলা’ নিয়েও যে কূটিল রাজনীতি হয় সেটা এরই মধ্যে সমগ্র বিশ্ব জেনে গেছে।
সবশেষে বলা দরকার, বিশ্বকাপের আসর থেকে বিদায় নিলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট যোদ্ধারা যথেষ্ট সম্মানজনক অবস্থান অর্জন করেছেন। তাদের এই অভিযাত্রা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বলেই আমরা আশা করতে চাই।