চট্টগ্রামে জনতা ব্যাংকের চার শতাধিক কর্মকর্তা বৈষম্যের শিকার
নুরুল আমিন মিন্টু, চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রামে জনতা ব্যাংকের চার শতাধিক কর্মকর্তা বৈষম্যের শিকার। এরমধ্যে তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ হলো ক্যাশ অফিসার। যুগের পর যুগ তারা ক্যাশ অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। একেকজন ক্যাশ অফিসার ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে একই পদে কাজ করে আসছেন। আর কয়েক বছর পরে তারা অবসরে যাবেন। সবার বয়স পঞ্চাশের ওপরে। কিন্তু পদোন্নতিতে তাদের অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। মুল্যায়ন করা হচ্ছে, তত্ত্বীয় তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাংকিং ডিপ্লোমাধারীদের। পদোন্নতির দ্বৈতনীতির নীতিমালার কারণে বার বার বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এসব অভিজ্ঞ কর্মকর্তা। অভিযোগ রয়েছে, সাক্ষাৎকার কমিটির হাতে থাকা নম্বরের ভিত্তিতে স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক তদবির! ফলে জ্যেষ্ঠ ও মেধাবী কর্মকর্তারা পদোন্নতিতে পিছিয়ে পড়ছেন। এতে ব্যাংকিংখাতে এক ধরনের অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
জনতা ব্যাংক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জনতা ব্যাংক চট্টগ্রাম বিভাগে ৮১ শাখা রয়েছে। এরমধ্যে এ জোনে ২৬টি, বি জোনে ২১টি, সি জোনে ১৭টি ও কক্সবাজার জোনে ১৩টি শাখা রয়েছে। এছাড়া প্রথম শ্রেনির করপোরেট (মিলিত) শাখা রয়েছে ৪টি। এসব শাখায় কাজ করছেন সাড়ে ৮শত কর্মকর্তা। এরমধ্যে অন্তত ৪শত কর্মকর্তা ব্যাংকিং ডিপ্লোমা নেই। তাদের মধ্যে অন্তত তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ রয়েছে ক্যাশ অফিসার। তাদের রয়েছে ভাল কর্মক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা।
জনতা ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা হয় চট্টগ্রাম অঞ্চলে। কিন্তু পদোন্নতির ক্ষেত্রে চট্টগ্রামে কর্মরত লোকজনের সঙ্গে বিমাতাসূলভ আচরণ করা হচ্ছে। নিয়োগপত্রে লেখা রয়েছে প্রতি তিন বছর পরপর বদলি আদেশ মেনে নিতে হবে। চট্টগ্রামে কর্মরত অনেক কর্মকর্ত-কর্মচারি পদোন্নতি হওয়ার পরেও বছরের পর বছর একই চেয়ারে বসে রয়েছেন এবং এতে শাখার অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারিদে সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন।
এ--জোনের উপ-মহাব্যবস্থাপক হুমাহুন কবির চৌধুরী বলেন, যাদের ব্যাংকিং ডিপ্লোমা আছে, তারা ৬ মার্কে এগিয়ে থাকে। যাদের ব্যাংকিং ডিপ্লোমা নেই তারা পিছিয়ে রয়েছেন। যারা এগিয়ে আছেন, তাদের পদোন্নতি হবে। এটাই স্বাভাবিক। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বিসিএসসহ সব সরকারি চাকরিতে এভাবেই পদোন্নতি হয়।
বি-জোনের উপ-মহাব্যবস্থাপক ফারুক আহমেদ জানান, পদোন্নতি হয় নীতিমালা অনুযায়ী। এটি বোর্ড অনুমোদিত। আমার শাখায় অনেক কর্মকর্তা আছে, যারা এমবিএ পাশ। তারা বছরের পর বছর ধরে কাজ করছেন। কিন্তু ব্যাংকিং ডিপ্লোমা না থাকায় পদোন্নতি হচ্ছে না। তাদের জন্য আমারও খারাপ লাগে। কিন্তু কিছুই করার নেই।
সি-জোনের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাকারিয়া বলেন, ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পাশ না করায় তারা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছেন। আমরাও চাই, তারা পদোন্নতিপাক। কিন্তু নীতিমালার কারণে এটা হচ্ছে না। অ্যাসেসমেন্টে তো আমরা কেউ থাকি না। থাকেন আমাদের ডিজিএম। যার কারণে আমার বক্তব্য দিয়ে এখানে কোনো কাজ হবে না।
কক্সবাজার জোনের ডিজিএম মো.মোস্তাফা আনোয়ার বলেন, ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে জন্য ব্যাংকিং ডিপ্লোমা দরকার। এটা দরকার বিধায় নীতিমালায় আনা হয়েছে। সব ব্যাংকের জন্য এটা প্রযোজ্য। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, চিকিৎসা সেবার জন্য এমবিবিএস দরকার হয়। তেমনি ব্যাংকিং সেবার জন্য ব্যাংকিং ডিপ্লোমা দরকার। যারা এটা করতে পারেনি, তারা পিছিয়ে যাবে এটা স্বাভাবিক।
জানতে চাইলে জনতা ব্যাংক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক কামরুল আহসান বলেন, চাকরি হওয়ার পরে অনেকে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা করেননি। নতুনরা চাকরি হওয়ার পরে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা করছেন। ১শ নম্বরের মধ্যে তারা ৫ নম্বরে এগিয়ে থাকছেন। এজন্য তারা পদোন্নতিতেও এগিয়ে রয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক। তবে সিনিয়রদের পদোন্নতিতেও ভাল কর্মক্ষমতা রয়েছে, এমন কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। পদোন্নতি নীতিমালা অনুযায়ী সঠিক ও স্বচ্ছভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
জনতা ব্যাংকের ডিপুটি জেনারেল ম্যানেজার (এডমিন) আনোয়ার হোসেন জানান, যাদের বেশি নম্বর থাকে, ক্রমান্বয়ে তাদেরকে পদোন্নতি দেয়া হয়। যাদের কম নম্বর রয়েছে তারা পিছিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। অনেকের ব্যাংকিং ডিপ্লোমা নেই, কিন্তু অভিজ্ঞতার আছে, পদোন্নতিতে তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এটা পলিসিগত ব্যাপার, পলিসি মেকাররা ভালো বলতে পারবেন। পদোন্নতি স্বচ্ছ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়।
প্রসঙ্গত, জনতা ব্যাংকের পদোন্নতিতে ১শ’ নম্বর বিবেচনায় নেওয়া হয়। এরমধ্যে ব্যাংকিং ডিপ্লোমাধারীদের জন্য ৬ নম্বর বেশি থাকে। এতে সিনিয়র কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের কাছ থেকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা এগিয়ে থাকছে। ফলে ভাল কর্মক্ষমতা দেখে অভিজ্ঞদের পদোন্নতি না দিয়ে তত্ত্বীয়তার ওপর নির্ভর করে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা পদোন্নতি পাচ্ছেন। নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা পদোন্নতি পেয়ে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের ওপর খড়ক বসাচ্ছেন। উল্লেখ, সোনালী ব্যাংকে যারা মাঠ পর্যায়ে ভোল্ট ইনচার্জ অর্থাৎ কী হোল্ডার তাদের জন্য অতিরিক্ত পয়েন্টের ব্যবস্থা আছে। অথচ জনতা ব্যাংকে এই ব্যবস্থা নেই। একই ক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান অথচ দ্বৈতনীতি বহাল রয়েছে। যারা ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে এখানে চাকরি করছেন, তাদেরকে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পদোন্নতি না দিয়ে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা কেন প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।
জনতা ব্যাংকের পদোন্নতি নীতিমালা (নির্দেশ বিজ্ঞপ্তি ৮১৫/১৮ তারিখ-২০ মে ১৮) অনুযায়ী পদোন্নতির নম্বরের বিভাজন হলো : বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর)-৫০, শিক্ষাগত যোগ্যতা-১৩, ব্যাংকিং ডিপ্লোমা (প্রথম পর্বের জন্য-৩, দ্বিতীয় পর্বের জন্য-৩)-৬, বর্তমান গ্রেডে চাকরির মেয়াদকাল : ক্যান্ডোরের বছরে প্রতি ত্রৈমাসে দশমিক ৬০ হারে ও প্রতি বছর ২ দশমিক ৪০ হারে প্রথম ৫ বছরে সর্বোচ্চ ১২ এবং পরবর্তী প্রতি বছর দশমিক ৫০ হারে ৮ বছরে সর্বোচ্চ ৪। শাখায় কার্যকাল : সমগ্র চাকরি জীবনে যে কোনো গ্রেডে ভিত্তি তারিখ পর্যন্ত অন্যুন ৩ বছর শাখায় কাজ করার জন্য ২। ভালো কাজের জন্য প্রতি প্রশংসাপত্রে ১, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ২, সাক্ষাৎকার/ মূল্যায়ন ১০ নম্বর। সব মিলিয়ে ১০০ নম্বরের ওপর ভাল কর্মক্ষমতা বিবেচনা করা হয়।