উপমহাদেশের প্রথম ঘুষের উদ্ভাবক লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল : বাংলা অভিধানে “ঘুষ” শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- নিজের কোন অন্যায় কাজকে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে যে অর্থ প্রদান করা হয়। অথবা কোন কাজে সাহায্য লাভের জন্য বা কার্যসিদ্ধির জন্য গোপনে দেওয়া পুরস্কার বা অর্থ। শুদ্ধ বাংলায় ঘুষের অপর নাম উৎকোচ। যে ব্যক্তি ঘুষ নেয় তাকে বলা হয় ঘুষখোর। প্রাচীন যুুগের রাজা-বাদশাদের দরবারে সাক্ষাতের সময় ভেট বা নজরানা-উপঢৌকন দেওয়ার প্রচলন ছিল। এই ভেট প্রথা সেই সময় ছিল একটি সামাজিক রীতি। ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে, রোম সেনাপতি জুলিয়াস যখন মিসর দখল করেন, তখন মিশর সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রা নিজেকেই ভেট হিসেবে পেশ করেছিলেন সিজারের কাছে।
আমাদের এই উপমহাদেশেও অতীতে রাজা-বাদশাদের দরবারে ভেট প্রথার প্রচলন ছিল। ভেট বা ঘুষের মধ্যে প্রকাশ্যে সাক্ষাতের সময় যে উপহার প্রদান করা হয় সেটি ভেট, আর ঘুষ হলো অন্যায় কাজ সিদ্ধির জন্য গোপন অর্থ। অবিশ্বাস হলেও সত্য যে, ইংরেজরা আমাদের এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ঘুষ বা উৎকোচ নেওয়ার রীতি প্রচলন করে।
১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যাহ্নের সময় নবাব মীর জাফর আলী খান মুর্শিদাবাদে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ঐতিহাসিক Caraciollio এর মতে মুন্নি বেগম তার আপন পুত্রের জন্য সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিশ্চিত ও নিরাপদ করার অভিপ্রায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধিনায়ককে মোটা অংকের ঘুষ প্রদান করেছিলেন। তারপর কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মন্ত্রী সভা নবাব মীর জাফরের একমাত্র বৈধ সন্তান মীরণের সিংহাসনের উত্তরাধিকারীত্বের দাবী নস্যাৎ করে দিয়ে মুন্নি বেগমের ১৫ বছর বয়স্ক সন্তান নাজিম-উদ-দৌলাকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। ক্লাইভের নিকট মীর জাফরের জীবৎকালীন সময়ে রেখে যাওয়া ৫ লাখ টাকা মুন্নি বেগম কর্তৃক তার পুত্র নাজিম-উদ-দৌলার রাজত্বকালে ক্লাইভের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল।
১৭৭৫ সালের ৬ মে ভারতবর্ষের ইংরেজ গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মীরজাফরের পত্নী মনি বেগমের কাছ থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। হেস্টিংসের এই উৎকোচ গ্রহণ তার ভারতীয় সেক্রেটারি কানাই লাল বাবুকে ঘুষ গ্রহণে উৎসাহ বা প্রেরণা যোগায়। তৎকালীন বর্ধমানের রাণীর কাছ থেকে কানাইলাল বাবু ১৫ হাজার টাকা ঘুষ নেন। এই টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা হেস্টিংসকে দেওয়া হয় এবং কানাই লাল নিজে ৫ হাজার টাকা নেন।
মহারাজা নন্দকুমার সুপ্রীম কাউন্সিলে ভাষণ দানের প্রাক্কালে হেস্টিংসের বিরুদ্ধে বহু কারচুপি ও দূর্নীতির অভিযোগ আনেন এবং তাকে বহু অপ্রীতিকর ঘটনার হোতা হিসেবে প্রমাণ করেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে- ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ যে অভিযোগটি আনা হয়েছিল তা’ হলো তিনি মুন্নি বেগমের নিকট থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ করেছিলেন। মুন্নি বেগম কে বাংলার নবাব পরিবারের অবিভাবকত্বে নিয়োজিত করার প্রাক্কালে তিনি এ টাকা ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তার এ চাঞ্চল্যকর অভিযোগটি তার সব ভালো কাজের ওপর তূরুপ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। জনশ্রুতি আছে মুন্নিবেগম নবাব মীরজাফর মহিয়ষী মুন্নিবেগম কর্তৃক মোটা অংকের টাকা ঘুষ দানই ওয়ারেন হেস্টিংসকে তার অন্ধ সমর্থকে পরিণত করেছিল।
কানাই লাল বাবুই প্রথম ভারতীয় অফিসার হিসেবে ঘুষ গ্রহণ করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছিলেন। এ ঘুষ নেওয়ার অপরাধে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পিট ভারতের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে ইম্পিচ করেন। এই ইম্পিচমেন্টের ফলে প্রায় সাত বছর ধরে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় হেস্টিংস সর্বখান্ত হয়ে যান। তবুও এদেশে ঘুষের এ ধারা রোধ না হয়ে ক্রমাগত বেড়েই চলে। এই প্রচলন ভারতবর্ষে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের ভেতরে ক্যান্সারের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। (তথ্যসূত্র : ইম্পিচমেন্ট অব ওয়ারেন হেস্টিংস, লেখক- লর্ড মেসিউফ। ভারতের ভারতের ইতিহাস, তৃতীয় খন্ড, লেখক-কিরণ চন্দ্র চৌধুরী, পৃষ্ঠা- ৯৭, ৯৮, ১১৩)।
ভারতীয় উপমহাদেশে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সেখানে ঘুষ, দুর্নীতি, নিচতা, স্বার্থপরতা, নৃশংসতা, নারী ধর্ষণকারী ও চরিত্রহীনতার জন্য বাংলার ইতিহাসে আজও কলঙ্কিত হয়ে রয়েছেন। প্রথম জীবনে হেস্টিংস ছিলেন কয়েক টাকার মাত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সামান্য রাইটার (কেরানী)। তারপর ধাপে ধাপে তিনি ব্রিটিশ ভারতের সর্বোচ্চ আসন গভর্নর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন।
শেষ জীবনে তিনি তার স্বদেশ ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত হেস্টিংস এ দেশে বড় লাট ছিলেন। ১৭৩২ সালে ৬ ডিসেম্বর ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তার নিজ জন্মভূমি এই ইংল্যান্ডেই ৮৭ বছর বয়সে নিদারুণ অর্থ কষ্টের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।
১৮২৮ সালে ভারতবর্ষে গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক এই ভয়াবহ ক্যান্সার থেকে প্রশাসনকে রক্ষা করার জন্য এক নতুন পন্থা অবলম্বন করেন। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চরিত্রের সততা যাচাই করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন বা অ্যানুয়াল কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট (এসিআর) গ্রহণের নিয়ম প্রবর্তন করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন আমাদের দেশে প্রচলিত আছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ঘুষ প্রকটভাবে বিরাজমান। দেশের সাম্প্রতিক ও অতীত ঘটনাই এর জলন্ত প্রমাণ। ঘুষ এতই মধুর যে, এটা গ্রহণের সময় মানুষের পাপ-পূণ্যের কোন হিসাব থাকে না। দুর্নীতিগ্রস্ত, মুনাফা খোর ও ঘুষখোর ব্যক্তিরা সবাই হয় আত্মকেন্দ্রিক। নিজেকে ছাড়া এরা আর কিছুই বোঝে না। এরা সব সময় এক ধরণের ফলস ভ্যানিটিতে আক্রান্ত থাকে।
সম্প্রতি ২০০ জন চাকরিরত এবং অবসরপ্রাপ্ত দুর্নীতিপরায়ণ ও ঘুষখোর ব্যক্তির ওপর এক গোপন সমীক্ষা চালিয়ে জানা যায়, বর্তমানে এসব দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি এক দুর্বিষহ ও ভয়ংকর জীবন যাপন করছেন। এই পার্থিব জীবনেই তারা ভোগ করেছেন তাদের সাজা ও প্রায়শ্চিত্ত।
ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহর বিধান মেনে সৎ পথে চললেই জীবনে আসে অপার শান্তি। কিন্তু অতীব, দুঃখের বিষয়, আল্লাহর বিধানকে লঙ্ঘন করে অনেকে দুর্নীতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেন। মুনাফার লোভে ভেজাল মেশায়, ঘুষ খায়, অঢেল টাকার জোয়ারে আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতার অপব্যবহারে নিজেদের জীবনের রথযাত্রাকে টেনে নেয় ক্ষনিকের মোহচ্ছন্ন এক আনন্দঘন পরিবেশে। তারা নিজেদের ভাবে তারাই ঈশ্বর, তারাই দেবতা। এ যেন কবির ভাষায়-
‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম
ভক্তরা লুটিয়ে পথে করিছে প্রণাম
পদ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি
মুর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী।
তথ্যসূত্র :
১। ঘুষের প্রকারভেদ : হামিদুল হক।
২। ওয়ারেন হেস্টিংস : ঢাকা আর্কাইভস, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা।
৩। আমাদের মুক্তি সংগ্রাম : মোহাম্মদ ওয়ালি উল্লাহ।
৪। মীর জাফরের পত্নী ‘মনি বেগম’: ড. আব্দুর রহীম।
লেখক : কলামিষ্ট, সাহিত্যিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
jewelwriter53@gmail.com